১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে কুমিল্লায় বীর জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধ

প্রকাশিত: ৩:০২ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৫, ২০২২

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে কুমিল্লায় বীর জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধ

কামাল আতাতুর্ক মিসেল | কুমিল্লা (দক্ষিণ), ২৫ মার্চ ২০২২ : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন কুমিল্লার বীর জনতা। এই যুদ্ধে চারজন শহীদ হন। পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে পঙ্গুত্ব বরণ করেন আরও অনেকে।

জেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিউল আহমেদ বাবুল আহমেদ বলেন, ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক এ কে এম সামসুল হক খান (সিএসপি) পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধে অগ্রিম সমন্বিত প্রতিরোধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ওই সময় তিনি তার সরকারি অফিস ও বাসভবন ছেড়ে কুমিল্লা সার্কিট হাউসে অবস্থান নেন। এতে তৎকালীন পুলিশ সুপার শহীদ মুন্সী কবির উদ্দিন আহমেদ কুমিল্লা সার্কিট হাউসে অবস্থান নেয়া জেলা প্রশাসক সামসুল হক খানের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন।
যুদ্ধের শুরুতে কুমিল্লার পুলিশ সুপার মুন্সী কবির উদ্দিন আহমেদ, ড. আব্দুস সাত্তার, অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমসিএ এবং আহমেদ আলী এমসিএ প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে সামসুল হক খান জেলা প্রশাসকের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন। সামসুল হক খান সেদিন সরকারি কর্মকর্তাদের এক সভায় দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেন- আমাদের দেশমাতৃকার জন্য সংগ্রাম করার সময় এসেছে। যদিও আমরা এই চরম ত্যাগের ফল ভোগ করতে পারব না। কিন্তু আমাদের আত্মত্যাগ ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য স্বর্ণদ্বার খুলে দেবে। সামসুল হক খান প্রশাসনে চাকরির প্রলোভন, সরকারি নীতি ও আদেশকে তুচ্ছ করে দেশপ্রেম এবং কর্তব্যবোধের শানিত চেতনায় বলীয়ান হয়ে বাঙালীর মহত্তম সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। তখন প্রশাসকের ভূমিকা ছেড়ে তিনি রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁর নির্দেশে কুমিল্লা সেনানিবাসে রেশন, বিদ্যুত, পানি ও যানবাহনের জন্য জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এক পর্যায়ে কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির নেতৃত্বে সেনাসদস্যরা পুলিশের অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করতে গেলে পুলিশ সুপার মুন্সি কবির উদ্দিন আহমেদ জেলা প্রশাসকের নির্দেশ ছাড়া স্টোরের চাবি হস্তান্তর করতে অপারগতা জানান। পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য স্থানীয় সামরিক আইন প্রশাসক ডেকে পাঠালে বেসামরিক প্রশাসনের জেলা প্রধান সামসুল হক খান তাতেও অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তার এ আচরণে পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তারা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এ কারণেই ক্ষিপ্ত পাকিস্তানি সেনারা ২৫ মার্চ প্রতিরোধ সত্ত্বেও রাত ১২টার পর ময়নামতি সেনানিবাস থেকে শহরের পুলিশ লাইনে বর্বরোচিত হামলা চালায়। এরপর হানাদার বাহিনী কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন এলাকায় তান্ডব চালায়।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মেজর আগা ও ক্যাপ্টেন বোখারীর নেতৃত্বে সামসুল হক খান এবং পুলিশ সুপার মুন্সি কবির উদ্দিন আহমেদকে গ্রেফতার করে সেনানিবাসের টর্চার সেলে বন্দী রেখে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। পরে ৩০ মার্চ সেনানিবাসের ৪০ ফিল্ড এ্যাম্বুলেন্সের সামনে চোখ বেঁধে গুলি করে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তবে তাদের অবস্থান ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি হওয়ায় অনেকেই অনুরোধ করেছিলেন কুমিল্লা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার জন্য।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সংগঠিত স্মরণকালের ভয়াবহ গণহত্যার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে সামসুল হক খানের খালাতো ভাই মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষাবিদ ড. এ আর মল্লিক (তৎকালীন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) টেলিফোনে তাকে বলেছিলেন, ‘আর্মিদের পেট্রোল ও রেশন বন্ধ করার পর তোমার ও এসপির কোন অবস্থাতেই ওখানে থাকা উচিত নয়। গ্রামের দিকে চলে যাও, পরে আমাদের সঙ্গে মিলিত হবে। তাকে অবস্থার গুরুত্বও বুঝিয়ে দেন। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, ‘মিয়া ভাই (ড. এ আর মল্লিক), কুমিল্লাতে একটি শক্ত অবরোধ ঘাঁটি তৈরি করেই আমি আসব। তার গাড়িচালকও তাকে বলেছিল, স্যার, চলুন আমরা বর্ডার পার হয়ে যাই। তখনও তার উত্তর ছিল, যদি চলে যাই তবে হানাদারদের বিরুদ্ধে কারা প্রতিরোধ গড়ে তুলবে? একাত্তরের ২৬ মার্চ সামসুল হক খান ও মুন্সি কবির উদ্দিন আহমেদকে গ্রেফতার করার পর তারা আর হানাদারদের বন্দীশিবির থেকে ফিরে আসেননি, ফিরবেন না কোন দিন।
১৯৭১-এর ১৩ জুন প্রখ্যাত সাংবাদিক এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় কুমিল্লার গণহত্যা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। স্বাধীনতার পর এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস বাংলাদেশ সফরে এলে ডিসি সাহেবের পরিবার তার সঙ্গে দেখা করে সামসুল হক খান সম্পর্কে তথ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিসি ওয়াজ কট এ্যান্ড ল্যাটার অন শট। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন আরও ৩০ জন পুলিশ সদস্য মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে কুমিল্লা পুলিশ সুপার ছাড়াও জেলা পুলিশের কোর্ট পুলিশ পরিদর্শক, আরআই, পিআই, দারোগা, সহকারী দারোগা, সুবেদার ও হাবিলদারসহ ৩০ জন পুলিশ সদস্য নির্মমভাবে শহীদ হয়েছেন। তারা হলেন- কুমিল্লা কোর্ট পুলিশ পরিদর্শক প্রফুল্ল কুমার দে, আর আই এবিএম আব্দুল হালিম, মুরাদনগরের পিআই যগেন্দ্র লাল চাকমা, দারোগা অর্জুন চন্দ্র দে, সহকারী দারোগা গঙ্গা রাম দে, সুবেদার রুহুল আমিন ও সুবেদার জোয়াদ আলী খান, হাবিলদার সুলতান খান ও হাবিলদার মুন্সি মিয়া এবং কনস্টেবল ফজলুল করিম, প্রতাপ চন্দ্র সিংহ, গোপেন চন্দ্র দে, জহিরুল হক, লাল মিয়া, জয়নাল আবেদীন, সাইদুল হক, মীর ইসহাক হোসেন, আবদুল হক, কুটি চাঁন্দ মিয়া, আহসান উল্যাহ, আনছার আলী, আবদুল খালেক, মুজিবুর রহমান, মোতাহের আলী, পরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী, আহসান উল্লাহ, খাজা সাইফুর রহমান, আবদুস শহীদ, মোঃ রফিক ও রহিম উদ্দিন।
এ বিষয়ে কুমিল্লার বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদানের জন্য শহীদ সামসুল হক খান ২০১০ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত হন। তার নামে কুমিল্লা শহরের একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক বাংলোর ক্যাম্পাসে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ জেলা প্রশাসক সামসুল হক খান মঞ্চ। এ বীর শহীদের স্মরণে জেলা প্রশাসক কার্যালয় ক্যাম্পাসে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতি ভাস্কর্য (আবক্ষ মূর্তি)। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রতি বছর এ ভাস্কর্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এছাড়া ঢাকার বিয়াম মিলনায়তনের ভাষণকক্ষটির নামও তার নামে করা হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম। তখন স্লোগান ওঠে কুমিল্লার পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে ওটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ।