নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারের সুপারিশ টিআইবির

প্রকাশিত: ৬:০৯ অপরাহ্ণ, জুন ১৩, ২০২২

নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারের সুপারিশ টিআইবির

Manual4 Ad Code

নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা, ১৩ জুন ২০২২: নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের নিরপেক্ষ ও স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত ভূমিকা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় আইনের সংস্কারের জন্য নির্বাচন কমিশনকে আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। আজ সোমবার (১৩ জুন ২০২২) নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিতে সুপারিশমালা তুলে ধরে টিআইবি।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়েরসহ ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল বৈঠকে অংশগ্রহণ করে নির্বাচন কমিশনকে এই সুযোগ দানের জন্য ধন্যবাদ জানায়। বৈঠকে টিআইবির গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে নির্বাচন কমিশনের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জসমূহ তুলে ধরে আলোচনা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে- নির্বাচন সবার জন্য অংশগ্রহণমূলক করা, নির্বাচনে সবার জন্য সমান ক্ষেত্র নিশ্চিত করা, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং আইনি সীমাবদ্ধতা থেকে উত্তরণ।

Manual1 Ad Code

বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনে সবার জন্য সমান ক্ষেত্র নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্র, আচরণ, আকার এবং গঠন কি হবে তা নিয়ে দেশবাসীর প্রত্যাশা এবং উদ্বেগ রয়েছে। তাই নির্বাচনকালীন সরকারের আচরণ কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্বাচন কমিশন তার সুচিন্তিত পরামর্শ দিতে পারে। একই ভাবে প্রয়োজনীয় আইনের সংস্কার করার প্রস্তাবও দিতে পারে নির্বাচন কমিশন। ক্ষমতাসীন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যগণ পদত্যাগ না করেই নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ গ্রহণ করলে অন্যান্য প্রার্থীদের সাথে তাদের প্রতিযোগিতার সমান ক্ষেত্র নিশ্চিতে আইন সংস্কারের প্রস্তাব রাখতে পারে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া আমাদের সুপারিশ হলো- নির্বাচনকালে তথ্য প্রকাশ যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়। গণমাধ্যমসহ দেশি বিদেশি পর্যবেক্ষকগণ যাতে অবাধ ও বাধাহীন পরিবেশে কার্যক্রম চালাতে পারে। নির্বাচনের সময় ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ না রাখার নিশ্চয়তা দিতে হবে। ইভিএম যেন কারিগরিভাবে নির্ভুল হয় এবং সকল অংশীজনের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, তা নিশ্চিত করেই নির্বাচন কমিশন এটিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করবে- আমাদের এই প্রত্যাশার কথাও নির্বাচন কমিশনকে জানানো হয়েছে।”

ড. জামান আরও বলেন, “নির্বাচন কমিশনের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এটি করার জন্য তাদের নিজস্ব বিশ্লেষণে তারা যদি মনে করেন কোনো আইন সংস্কারের প্রয়োজন, তাহলে তা প্রস্তাব করতে পারেন। কোনো আইন কিন্তু পাথরে খোদাই করে লেখা না, সংবিধানও পাথরে খোদাই করে লেখা নয়। সংবিধান এবং আইন এখন পর্যন্ত যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, তা পরিবর্তনের মাধ্যমেই হয়েছে। কাজেই এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে যদি নির্বাচন কমিশন মনে করে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক করার স্বার্থে কোনো ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বা আইন সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে, তাহলে তারা সেই প্রস্তাব করবেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবেন কি-না তা পরে বিবেচনার বিষয়।”

অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে নি¤œলিখিত সুপারিশ প্রদান করেছে টিআইবি। সেগুলো হলো-

১. আইনি সংস্কার: নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের নিরপেক্ষ ও স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত ভূমিকা নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট আইনের সংস্কার করা। ক্ষমতাসীন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যগণ পদত্যাগ না করেই নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ গ্রহণ করলে অন্যান্য প্রার্থীদের সাথে তাদের প্রতিযোগিতার সমান ক্ষেত্র নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বিধায় প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং নির্বাচনকালীন সরকারের এখতিয়ার, দায়িত্ব, গঠন ও আচরণ সম্পর্কে সকল অংশীজনের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

২. সকল অংশীজনের আস্থা অর্জন: রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট সকলের, বিশেষ করে ভোটারদের আস্থা অর্জন করার জন্য নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়া; এক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে আলোচনায় অংশগ্রহণের সুনির্দিষ্ট এজেন্ডাসহ আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করা।

৩. সবার জন্য সমান ক্ষেত্র নিশ্চিত করা: নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা সংশোধনের মাধ্যমে সবার জন্য সমান ক্ষেত্র নিশ্চিতে নির্বাচন-পূর্ববর্তী অন্তত ছয়মাস এবং নির্বাচনের পরবর্তী অন্তত তিন মাসের জন্য নির্বাচনী অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক পরিবেশ পরিবীক্ষণ করা এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহায়তায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। একই সঙ্গে সব দলের সভা-সমাবেশ করার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা এবং প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়ন প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কঠোরভাবে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা।

Manual4 Ad Code

৪. আচরণ বিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ: জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহিংসতা ও বল প্রয়োগসহ নির্বাচনী আচরণ বিধির বহুমুখী লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হবে সেগুলোর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে ও তার ওপর ভিত্তি করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আচরণ বিধি লঙ্ঘন প্রতিরোধে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার ক্ষেত্রে তার নিরপেক্ষ বিশ্লেষণমূলক তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। অন্যদিকে কমিশনের গৃহীত পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের উদ্যোগ নিতে হবে।

৫. তথ্য প্রকাশ: নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে অধিকতর স্বচ্ছ করার লক্ষ্যে বর্তমানে প্রকাশিত তথ্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন, নির্বাচনের সার্বিক তথ্য (পুনঃনির্ধারিত নির্বাচনী আসনের ভোটারসংখ্যাসহ তালিকা, কেন্দ্রভিত্তিক ভোট-সংক্রান্ত তথ্য, নির্বাচনী মামলা সংক্রান্ত তথ্য ইত্যাদি), নির্বাচন কমিশনের আয়োজিত সকল অংশীজনের সাথে সংলাপের ফলাফল বা প্রতিবেদন, নির্বাচন কমিশন বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর মনিটরিং ও মূল্যায়ন প্রতিবেদন; এবং নির্বাচন কমিশনের বিস্তারিত বাজেট, বার্ষিক নিরীক্ষাকৃত আর্থিক বিবরণীসহ সকল দলিল তথ্য নির্বাচন কমিশনকে প্রকাশ করতে হবে।

৬. সংসদ সদস্যদের আর্থিক তথ্য প্রকাশ: প্রতি বছর সংসদ সদস্যদের আর্থিক তথ্য নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হবে, যা নির্বাচন কমিশন জনগণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করবে।

Manual8 Ad Code

৭. রাজনৈতিক দলের আর্থিক তথ্য প্রকাশ: প্রতিটি রাজনৈতিক দলের বার্ষিক প্রতিবেদন এবং দলের আয়, ব্যয় এবং সম্পদের হালনাগাদকৃত তথ্য প্রকাশ করতে হবে।

৮. ডিজিটালাইজেশন: নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ (ভোটার তালিকা হালনাগাদ, মনোনয়নের জন্য আবেদনপত্র উত্তোলন ও জমা, প্রার্থীর আর্থিক তথ্য যাচাই, নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্ন দাখিল ইত্যাদি) ডিজিটালাইজ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও প্রার্থীর মনোনয়ন প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

৯. দেশি-বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ: সুস্থ, নিরাপদ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আগ্রহী সকল দেশি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের জন্য অবাধ ও সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট অনুমোদন প্রক্রিয়ায় যথাযোগ্য সংস্কার করতে হবে।

১০. তথ্য সংগ্রহে অবাধ পরিবেশ নিশ্চিত করা: নির্বাচন পর্যবেক্ষক, গবেষক ও গণ-মাধ্যমের তথ্য সংগ্রহের জন্য অবাধ পরিবেশ নিশ্চিতে নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও সংবাদ-মাধ্যমের জন্য কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাবে না। যেমন- নির্বাচনের সময়ে ইন্টারনেটের গতি হ্রাস করা, মোবাইল ফোনের জন্য ফোর-জি ও থ্রি-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখা, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মোটরচালিত যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ইত্যাদি।

Manual7 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code