রুচির দুর্ভিক্ষ

প্রকাশিত: ৭:২১ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ২৮, ২০২৩

রুচির দুর্ভিক্ষ

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল |

“রুচির দুর্ভিক্ষ” নিয়ে মন্তব্য করায় কিছু মানুষ দেখলাম শ্রদ্ধেয় মামুনুর রশিদের উপরে বেজায় চটেছেন । তবে এই দুর্ভিক্ষের দায় মামুনুর রশিদের মত সামনের সারিতে থাকা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ কতটা এড়াতে পারেন , সেটাও এক বিরাট প্রশ্ন! রুচির দুর্ভিক্ষ” কথাটা প্রথম বলেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সেই ৭০ এর দশকে। সেই সময়ে বসে তিনি এটা অনুভব করতে পেরেছিলেন, এখন বেঁচে থাকলে এই সময় নিয়ে তিনি কি ভাবতেন কে জানে !

ধরুন আপনি একজন সঙ্গীত শিল্পী, দৈনিক ৪-৫ ঘন্টা সুর,তাল, লয় নিয়ে সাধনা করেন, নিজে লেখেন, সুর করেন , দারুন একটা কন্ঠ আপনার। কিন্তু আপনাকে কোন টিভি চ্যানেল বা রেডিও ডাকে না, কোন পত্রিকাতে আপনার ছবি ছাপা হয় না। নিজে গান করে সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ করেন, ১০০-২০০ মানুষের বেশী শোনে না সে‌ই গান। আপনার সন্তান প্রতিদিন আপনার ব্যর্থ এবং হতাশা গ্রস্থ চেহারা দেখতে দেখতে বড় হয়। ওদিকে সন্তান এখন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। সে দেখে কোন একজন মানুষ বেসুরো গান এবং উদ্ভট নৃত্য পরিবেশনের ভিডিও প্রকাশ করে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেছে। আপনার সন্তান তাহলে দৈনিক ঘুম থেকে উঠে ৪-৫ ঘন্টা সাধনা করবে , না কি উদ্ভট কিছু করার সহজ পদ্ধতি বেছে নেবে?

সমাজ এবং পৃথিবী এগিয়েছে না কি পিছিয়েছে জানি না। তবে সোশ্যাল মিডিয়া বিপ্লবের ফলে সকলের অবাধ মত প্রকাশের সুযোগ তৈরী হয়েছে । এক জন সচেতন নাগরিক হিসাবে আমিও ফ্রিডম অফ স্পিচ , ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশনের দাবিতে গলা ফাটাই । সেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা গণ মত যদি একজন হিরো আলমকে বেঁছে নেয় , সেটা নিশ্চয়ই সেই সময়ের মানুষের ভাবনা-চিন্তা এবং রুচি বোধের প্রতিফলন। এখন সেই রুচি উন্নত না কি নিম্ন মানের সেই বিতর্কে আমি যাব না। কারণ গণিতের মত কোন নির্দিষ্ট মান দন্ডে রুচি বা শিক্ষার পরিমাপ করা যায় না।
হতেই পারে বেসুরো গান গাইতে পারা, বা উদ্ভট রকমের নৃত্য পরিবেশনের ক্ষমতাকে এই সমকালের মানুষ যোগ্যতা হিসাবে বিবেচনা করেন!
এই জাতীয় উপস্থাপনার মানুষ গুলো কে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে অনেকে এটাকে প্রান্তিক মানুষের বিপ্লব বলে দাবী করে থাকেন। সেটা ঘটে থাকলে তো আনন্দের কথা, বিপ্লব মানেই তো কোনএকটা অচলায়তন ভেঙ্গে নতুন কিছু সৃষ্টি করা।

কিন্তু এই প্রান্তিক নায়কের সাথে আরজ আলী মাতুব্বরের কোন মিল খুঁজে পাই না। আরজ আলী মাতুব্বর একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে ছিলেন। তিনি নিজেও কৃষি কাজ দিয়ে নিজের কর্ম জীবন শুরু করেন। পরবর্তিতে একজন দার্শনিক, চিন্তাবিদ এবং গুরুত্বপুর্ণ লেখক হয়ে ওঠেন। গ্রামের মক্তবে কিছুকাল পড়াশোনা করেন, যেখানে শুধু কোরান ও অন্যান্য ইসলামিক শিক্ষা দেয়া হত। তিনি নিজ চেষ্টা ও সাধনায় বিজ্ঞান , ইতিহাস ধর্ম ও দর্শন বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করেন।ধর্ম, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নানামুখী জিজ্ঞাসা তার লেখায় উঠে এসেছে। তিনি তার ৮৬ বছরের জীবনকালে ৭০ বছরই লাইব্রেরিতে কাটিয়েছেন পড়াশোনা করে। জ্ঞান বিতরণের জন্য তিনি তার অর্জিত সম্পদ দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি’।আমার মত পিছিয়ে থাকা মানুষেরা নিশ্চয়ই জানেন আরজ আলী মাতুব্বর বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক এবং জ্ঞান তাপস। যার লেখা আমার মত অজশ্র পাঠককে আলোকিত করেছে।

যারা নাচ গানের বিকৃত উপস্থপনা করা মানুষটিকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির উত্থানের নায়ক বলে দাবী করেন তারা নিজের এবং নিজের পরবর্তি প্রজন্মের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে এই নায়রককেই ধরে নিয়েছেন বলে বিশ্বাস করি। ফলে যে বা যারা কিছুই না পারার যোগ্যতায় মহানায়ক হয়ে উঠেছেন আমি তাদের কোন দোষ দেখি না। কাউকে আপনি নায়ক বানাতে চাইলে সে কি বলবে -“আমি নায়ক হতে চাই না“? কাউকে যদি আপনি দেশের রাজনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন – সে কি বলবে না আমি জনপ্রতিনিধি হতে চাই না? ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার , ব্যারিস্টার, বিজ্ঞানী, কর্পোরেট বা অধ্যাপকদের সমাজ যদি তাঁদেরকে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়ে একজন হিরো আলমকে যোগ্য নেতা হিসাবে বিবেচনা করেন, সে তো এক বিরাট বিপ্লবই বটে!

যারা এমন নায়ক তৈরী করে নিয়েছেন -তার এবং তার পরবর্তি প্রজন্মের পথ প্রদর্শক কিন্তু এরাই। কারণ বিষয়টা নিছক বিনোদনে আর আটকে নেই, এই ব্যক্তি কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলে তাকে নিয়ে জনাব মির্জা ফখরুল আর জনাব ওবায়দুল কাদেরকে পাল্টাপাল্টি মন্তব্য করতে দেখা যায়! ফলে নিশ্চিত ভাবেই এই সময়ের একটা বিরাট জনগোষ্ঠী এই ব্যক্তিকে নায়ক হিসাবে বেছে নিয়েছে। আমার সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য কি না জানি না – আমি নায়ক হিসাবে পেয়েছি মাস্টার দা সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম, জহির রায়হান, জয়নুল আবেদিন, এস.এম সুলতান, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র মত অসংখ্য বাতিঘরকে।

_মাসুদ হাসান উজ্জ্বল
২৮.০৩.২০২৩

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ