প্রাচীন বোহেমিয়া শহরে

প্রকাশিত: ১২:৫০ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৫

প্রাচীন বোহেমিয়া শহরে

Manual2 Ad Code

ইউরোপের অন্যতম সমৃদ্ধ শহর এবং সাংস্কৃতিক রাজধানী প্রাগ। প্রতিবছর লাখো পর্যটক ভিড় করেন এখানে। ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত শহরটি ঘুরে এসেছেন এলিজা বিনতে এলাহী |

Manual4 Ad Code

মধ্যযুগের পাথুরে পথ, চার্লস ব্রিজ, প্রাচীন ক্যাথেড্রাল, গোথিক চার্চ, শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভালতাভা নদী—সব মিলিয়ে একুশ শতকেও প্রাগ যেন প্রাচীন এক শহর। এর অনেক নাম। পূর্ব ইউরোপের শহরটিকে কেউ বলে ‘সোনালি শহর’, কেউবা ডাকে ‘আ সিটি অব হান্ড্রেড স্পায়ার্স’।

নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাল্পাইড সায়েন্স-এ পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন করছি তখন।

সেমিস্টার ব্রেকে আমি আর আমার চীনা সহপাঠী বনি ডিং বের হলাম চেক প্রজাতন্ত্র ভ্রমণে। নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহর থেকে মাত্র দুই ঘণ্টায় আকাশ পাড়ি দিয়ে সকাল ১০টায় পৌঁছালাম প্রাগে। এয়ারপোর্ট থেকে মূল শহরে গেলাম ট্রেনে চেপে। হোটেলে চেক-ইন করেই বেরোলাম শহর দর্শনে।

চটজলদি হালকা নাশতা সেরে নিলাম এক রেস্তোরাঁয়। ইউরোপের শহরগুলো আসলে হেঁটে ভ্রমণ করার উপযোগী। এতে ভ্রমণ খরচও কমে, প্রাণভরে অলিগলি উপভোগ করা যায়।
গুগল ম্যাপ চেক করে বনি বলল, হোটেল থেকে মিনিট ১৫ হাঁটলেই চার্লস ব্রিজ।

প্রাগ শহরে এখনো পুরনো দিনের ট্রামগুলো চলছে। আধুনিক ট্রামও রয়েছে। লালরঙা সোভিয়েত সময়ের ট্রামও চোখে পড়ল। পথের দুই ধারের ধ্রুপদি স্থাপনাগুলো দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। অক্টোবরের মাঝামাঝি।
শীত পড়তে শুরু করেছে সবে। সামনেই ভালটাভা নদী। তার হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি চার্লস ব্রিজ।
ভালটাভা নদীর ওপর সতেরোটি সেতুর অন্যতম চার্লস ব্রিজ। চেক রাজা চতুর্থ চার্লসের নামানুসারে ১৩৫৭ সালে নির্মিত হয় এই সেতু। ১৪ শতকের বিখ্যাত চার্লস ব্রিজ হচ্ছে প্রাগের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ। এত্ত টুরিস্ট! তিলধারণের স্থান নেই। বলা হয়, প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রতিদিন এই ব্রিজ ধরে যাতায়াত করে, যাদের বেশির ভাগই পর্যটক। এত মানুষ ব্রিজের ওপর ওঠে যে একরকম ঠেলাঠেলি করেই এগিয়ে যেতে হয়। ব্রিজের ডানে-বাঁয়ে সব পিলারের মাথায় দণ্ডায়মান সারি সারি স্থাপত্য। রাজ পুরোহিত সেন্ট জন নেপোমুকের স্ট্যাচুটি সর্বপ্রধান। যে স্ট্যাচুর মাথার চারপাশ দিয়ে একটি ধাতব রিংয়ে পাঁচটি সোনালি স্টারখচিত। ব্রিজের ঠিক ওই স্থান থেকে তাঁকে নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন রাজা। কারণ পুরোহিতের কাছে রাজা তাঁর রানির স্বীকারোক্তির কথা জানতে চেয়েছিলেন। পুরোহিত তা জানাতে চাননি। এই স্ট্যাচু ছুঁয়ে দিলে নাকি মনোবাসনা পূর্ণ হয়। স্থানীয় মানুষ ব্রিজের গায়ে ছোট ছোট তালা লাগিয়ে দেয়।

ঐতিহাসিকভাবে বোহেমিয়া নামেও পরিচিত চেক প্রজাতন্ত্র। এটি একটি ভূবেষ্টিত রাষ্ট্র। চতুর্দশ শতকের দিকে প্রাগ তার সমৃদ্ধির এক নতুন যুগে এসে পৌঁছায়। প্রাগের প্রথম স্বর্ণযুগ বলে একে আখ্যায়িত করা হয়। এই সময়ে প্রাগ হয়ে ওঠে ইউরোপের অন্যতম সমৃদ্ধ শহর এবং সাংস্কৃতিক রাজধানী। ব্রিজ পার হয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে এলাম প্রাগের প্রাচীন দুর্গ দেখতে। প্রায় ২৫০ সিঁড়ি ধরে প্রাগ ক্যাসেল থেকে পুরো প্রাগ শহর ভীষণ মনোমুগ্ধকর।

Manual4 Ad Code

ড্যান্সিং বিল্ডিং হচ্ছে আরেকটা দর্শনীয় স্থান। এই বিল্ডিংয়ের দিকে তাকালে মনে হবে এর গঠনশৈলীতে হয়তো ত্রুটি রয়েছে। কী রকম আঁকাবাঁকা। আসলে এটা একটা রেস্তোরাঁ। ভেতরে প্রবেশ করিনি, কিন্তু পথে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি।

আমাদের গন্তব্য ছিল ওল্ড টাউনের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল বা জ্যোতির্বিদ্যার ঘড়ি। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ঘড়ি পুরনো টাউন হলে টাওয়ারে দেখতে পাওয়া যাবে। ১৫ শতকের স্মৃতি নিয়ে এই ঘড়ি আজ অবধি চালু আছে। আমরা গিয়ে দেখি মেরামতের কাজ চলছে। প্রাগের অনেক সরু রাস্তা যেন আমাদের পুরান ঢাকার গলি। পার্থক্য একটাই, এই শহরের সব কিছু দারুণভাবে সংরক্ষিত। দুটি বিশ্বযুদ্ধের পরও নিজেদের অনেক ভেঙেচুরে আবারও সুন্দর করে গড়ে তুলেছে। সব কিছু চমত্কার, পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি।

Manual3 Ad Code

প্রাগের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করা যায় নিরাপদে। ট্রাফিক লাইট মেনেই চলাচল করে সবাই। যান বা মানুষ, কারোরই সে রকম তাড়া নেই। নিয়ম ভাঙার কথা তো অকল্পনীয়। এশিয়ানদের মতো রুদ্ধশ্বাস দৌড়ে চলার ছিটেফোঁটাও নেই প্রাগে।

Manual6 Ad Code

সেন্ট অ্যাগনেস মনাস্ট্রি, যার সামনে রয়েছে ‘পাউডার গেট’। এই প্রবেশদ্বার প্রাগের ওল্ড টাউনকে নিউটাউন থেকে পৃথক করেছে। সেখানেও রয়েছে উপকথা। জনশ্রুতি অনুযায়ী, সেন্ট এগনেস নামে এক রাজকন্যা আট বছর বয়সে বাগদত্তা হন দশ বছরের আরেক রাজপুত্রের। কিন্তু বিয়ের পর কৃচ্ছ্রসাধনে ব্রতী হয়ে ভক্তিমার্গে যায় তারা। ওল্ড টাউন অঙ্গনের ‘ওয়েনসডে স্কয়ার’-এর এই গল্প দারুণ জনপ্রিয়। মধ্যযুগে এখানে ঘোড়ার বাজার ছিল। তারপর বোহেমিয়ান রাজা চতুর্থ চার্লসের নিউ টাউন স্কয়ার বানানোয় তা পুরনো শহরে পরিণত হয়।

প্রাগে চোখে পড়বে অসাধারণ সব রেনেসাঁ স্থাপত্য। চারদিক স্থাপত্যকলা, ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি। লেসার টাউন স্কয়ারের ল্যান্ডমার্ক হলো রাজকীয় সেন্ট নিকোলাস চার্চ। ওল্ড টাউন স্কয়ারের কেন্দ্রবিন্দুতে এই চার্চ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চেক আর্মির ঘাঁটি ছিল এটি। চার্চটির সংরক্ষণে সেনাবাহিনীর নিরলস পরিশ্রম আর নামিদামি স্থপতিদের পরিশ্রমে শিল্পকলায় ভরে ওঠে চার্চের অন্দর ও বাইরের মহল। চার্চটি একাধারে যেমন গির্জা, অন্যদিকে ক্ল্যাসিকাল কনসার্টের মঞ্চ।

ইউনিভার্সিটি অব প্রাগ, যেখানে আলবার্ট আইনস্টাইন থিওরিটিকাল ফিজিক্সে অধ্যাপনা করেছিলেন। পাশেই চারজন মিউজিশিয়ানের অনবদ্য স্ট্যাচু, যা প্রাগের বিখ্যাত স্থাপত্যগুলোর একটি। চারজনের হাতে চারটি বাদ্যযন্ত্র। স্থপতির কল্পনায় বিশ্বের বৃহত্তম চারটি নদী আমাজন, মিসিসিপি, গঙ্গা এবং দানিয়ুয়ের এক অনবদ্য কলতান এই চার বাদ্যশিল্পী চোখ বন্ধ করে বাজিয়ে চলেছে। শিল্পীদের চোখ বাঁধা, হাতে ম্যান্ডোলিন, ভায়োলিন, বাঁশি ও ট্রামপেট।

এখানেই জন লেননের উজ্জ্বল ও বর্ণিল দেয়াল। প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের ভিড় লেগে থাকে এখানে। ষাটের দশকের জনপ্রিয় ইংরেজি গায়ক এবং বিটলস ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা জন লেনন। জর্জ হ্যারিসন এবং জন লেনন ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিটলস। ১৯৮০ সালে লেননকে হত্যা করার পর তাঁর গানের কথা, বিভিন্ন সময়ে তরুণদের উদ্দেশ করে বলা কথামালা ও রংবেরঙের গ্রাফিতি দিয়ে দেয়ালটি সজ্জিত। ইউরোপে লেননের সংগীত খুবই জনপ্রিয়।

পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র প্রাগ। রোমান স্থাপত্যকলার যুগে প্রতিষ্ঠিত হয় এই শহর। গথিক, রেনেসাঁ, বলকান ও বারোক স্থাপত্য যুগে এর বিকাশ ঘটে। প্রাগ বোহেমিয়া রাজ্যের রাজধানী এবং কয়েকজন পবিত্র রোমান সম্রাটের বাসস্থান ছিল। গির্জা আর টাওয়ার মিলিয়ে পাহাড়বেষ্টিত শহরটি অনন্য। এ জন্যই হয়তো প্রাগকে ‘এক শ চূড়ার শহর’ও বলা হয়। ১৯৯২ সালে শহরটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সন্ধ্যা নেমে এলো। ওল্ড টাউন থেকে বনি আর আমি আবারও ভালটাভার পারে গেলাম।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code