সিলেট ১৪ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৩:২০ অপরাহ্ণ, জুলাই ২০, ২০২৫
১৯৭৬ সালের ২১শে জুলাই ভোর রাতে ফাঁসির রায় কার্যকর করার জন্য তাহেরকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয়। এক পা তাঁর যুদ্ধে হারিয়ে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধাহত বীর উত্তম কারো সাহায্য ছাড়া শেভ করলেন। নিজে আম কেটে খেলেন এবং অন্যদের খাওয়ালেন। একটি সামরিক ট্রাইবুনালের রায়ে দেশদ্রোহী হিসেবে তাঁর ফাঁসির রায় হয়। উপস্থিত কারা সদস্যরা দেখলেন বীর উত্তম নির্বিকার। শান্ত এবং সহজ। তাঁরা ভাবলেন এ কেমন মানুষ! হ্যাঁ, তিনি ছিলেন সত্যিকার বীর উত্তম ও দেশপ্রেমিক। তার কয়েক দিন আগে বীর উত্তম বলেছিলেন, আমি জ্ঞানত কোনো পাপ বা অপরাধ করিনি। আমি একজন দেশপ্রেমিক।
কর্নেল তাহের বীর উত্তমের জন্ম ১৯৩৮ এর ১৪ নভেম্বর। নভেম্বর মাস তাঁর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে ১৯৬৫ সালে পাক- ভারত যুদ্ধের সময় বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করায় তাঁকে মেরুন প্যারাসুট উইং খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিলো। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তাঁর জুনিয়ররা ট্রাইবুনালে তাঁর ফাঁসির রায় দেয়। তাহের বীর উত্তম এসব নিয়ে নির্বিকার। কারণ তিনি ট্রাইবুনালে তাঁর বক্তব্য দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তিনি দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডগুলো কীভাবে চলেছে। ভারতীয় বাহিনীর ভূমিকা দেখেছেন এবং আওয়ামী লীগকে দেখেছেন। এগার নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন এবং কামালপুরের যুদ্ধে পা হারান। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধের পর তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসকে একটি উৎপাদনমুখী সেনাবাহিনীতে পরিণত করেছেন। এরপর বৃটিশ উপনিবেশ বিরোধী একটা উৎপাদনমুখী সেনাবাহিনী গঠন এবং সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য একটা রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য সেনাবাহিনী থেকে চলে আসেন। কর্নেল জিয়াউদ্দিনও তাঁর সাথে ছিলেন।
তিনি জাসদ এবং জিয়াউদ্দিন সর্বহারা পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৭৫ সালের পনের আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীতে বেশ ঘূর্ণন শুরু হয়। তাহের বীর উত্তম তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান গণনায়ক থেকে একনায়কে পরিণত হয়েছিলেন। এছাড়া, রক্ষীবাহিনী গঠন ছিল একটা মারাত্মক ভুল। তিনি আরও বলেছেন, মুজিব হত্যার দায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে নিহিত। তাহের বীর উত্তম বলেন, পনের আগস্টের পর তাঁকে ক্যূ এর সাথে জড়িতরা তাঁকে এবং এম এ জি ওসমানীকে সম্পৃক্ত করেন। বাংলাদেশ বেতার ও রাষ্ট্রপতি ভবনে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, রাজবন্দিদের মুক্তি, সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনা এবং বিপ্লবী সৈনিক সংঘের বার দফা দাবি আদায়। তাহেরের ভাষ্য মতে, তিনি খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে যে ক্যূ হয়েছিল তা রুশ- ভারতপন্থী বিবেচনায় ৭ই নভেম্বরের সিপাহি অভূত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন।
এই সময়কালে সেনাবাহিনীতে সিপাহি ও কর্মকর্তাদের মধ্যে বেশ বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয় বিশেষ করে সৈনিকদের বার দফা যেখানে উপনিবেশিক প্রভু- দাসের সম্পর্ক অবসানের প্রশ্নে। বেশ কয়েক জন সেনাকর্মকর্তা নিহত হন। এই পরিস্থিতি অবসানে ওসমানী ও তাহের ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু জাসদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান তাহেরকে গ্রেফতার এবং সামরিক ট্রাইবুনালে বিচার করেন। এই বিচার একটা ক্যাঙ্গারু ট্রাইবুনালে হওয়ায় তাহের প্রয়োজনীয় আইনী সহায়তা পাননি এবং তাঁর ফাঁসী মানবাধিকারের লঙ্ঘন ছিল।
এটা ঠিক, বিপ্লব বিপ্লবীদের খেয়ে ফেলে। একজন মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার বিচারিক অধিকার পাওয়ার অধিকার ছিল কারণ তিনি তখন সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন না।
একসময়, আশির দশকে তাহেরকে নিয়ে বামপন্থী দলগুলো বেশ আলোচনা করতো। একদল মনে করতেন, তাহের হঠকারী অন্যরা মনে করতেন তাহের ছিলেন একজন বিপ্লবী। তাহের বিপ্লবে সৈনিকদের কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন, অন্যরা মনে করতেন, তাহের সশস্ত্র বিপ্লবী কিন্তু তিনি সৈনিক ও জনগণের মেলবন্ধন ঘটাতে পারেননি। তাঁর দল জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। এ-ই সব আলোচনা বেশ উত্তপ্ত ছিল।
বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের পর বা তাঁর মতো একজন আবেগময় বিপ্লবী ছিলেন কর্নেল তাহের বীরউত্তম।
এমন বীর, এমন মুক্তিযোদ্ধা, এমন একজন চিন্তক যিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী হবে উৎপাদনমুখী গণবাহিনী, অনুৎপাদক ও জনগণের টাকা ভোগকারী নয়, সৈনিক ও কর্মকর্তার সম্পর্ক হবে স্বাধীন ও মানবীয়, দাসসুলভ নয়। সর্বোপরী তিনি চেয়েছিলেন একটা শোষণমুক্ত বাংলাদেশ।
তাঁর বাণী :
মৃত্যু আমাকে পরাজিত করতে পারে না। আমাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে আর বড় কোন সম্পদ নেই। আমি আমার সমগ্র জাতির মধ্যে প্রকাশিত।
#
শরীফ শমশির
লেখক ও গবেষক।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি