বিশ্বের বিস্ময় ভিয়েতনাম 

প্রকাশিত: ৯:৪৯ পূর্বাহ্ণ, মে ১৯, ২০২১

বিশ্বের বিস্ময় ভিয়েতনাম 

Manual6 Ad Code

।।|| মৃদুল দে ||।।

আরও একটি যুদ্ধে নির্ণায়ক জয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পর এবারে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে।
শেষ একমাসে একজনেরও নতুন করে সংক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। দশ কোটির দেশে আক্রান্তের সংখ্যা সাকুল্যে ৩১৪। একজনেরও মৃত্যু নেই। ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক নান দাঙ পত্রিকা শনিবার জানিয়েছে, এর মধ্যে ২৬০ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। ৫৪ জন এখনও চিকিৎসাধীন।

আজ, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদী নেতা কমরেড হো চি মিনের ১৩১-তম জন্মবার্ষিকী। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের জনগণের দীর্ঘ বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। মানবমুক্তির লড়াইয়ে যা হয়ে রয়েছে চিরস্মরণীয়।

কমরেড হো চি মিন থেকে আজকের ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক, রাষ্ট্রপতি নগুয়েন ফু ত্রঙ। প্রবল পরাক্রান্ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ থেকে কোভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই। এক সাফল্যের উপাখ্যান।

হো চি মিন বলেছিলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদই হলো জনগণের প্রধান শত্রু।’ ভিয়েতনামের প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী ‘হো চি মিনের চিন্তাধারা’ নিয়ে পড়াশুনা করেন। দেশের এই জাতীয় মতাদর্শ দশক ধরে চলা সেই দেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতার নামেই পরিচিত। ১৯৫৮, স্বাধীনতা এবং পুনঃএকত্রিকরণের লড়াই তখন মাঝপথে, দেশের নীতি নৈতিকতা ও নৈতিক বিধি নিয়ে কেন্দ্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে হো বলছিলেন, ‘প্রত্যককে সমাজের সমস্ত কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে যৌথ শক্তির উপর অবশ্যই বিশ্বাস রাখতে হবে। তার চেয়েও বড় কথা হলো, কোনও একজন কখনোই আলাদা হয়ে থাকতে পারেন না, তাঁকে অবশ্যই সমষ্টিতে যুক্ত হতে হবে, সমাজের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে।’ সমাজের ভালোর জন্য প্রত্যেক ব্যক্তি মানুষকে কিছু আত্মত্যাগ করার জন্য আগ্রহী হতে হবে। এটাই সেই শিক্ষা, যা বিশেষ করে ভিয়েতনামকে কোভিড ১৯-র বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভালোভাবে জয়ী হতে সাহায্য করেছে।

দেশের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতি সম্পর্কে হো চি মিনের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান ছিল, মতাদর্শ ও সংগঠন সম্পর্কে ছিল স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানুষের ওপর ছিল অগাধ বিশ্বাস। মানুষকে সঙ্গে নিয়েই কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এসেছে সাফল্য।

ভিয়েতনামে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে ২৩ জানুয়ারি। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার জন্য অপেক্ষা করেনি। সেদিনই যুদ্ধের ডাক, প্রত্যেক নাগরিকই সৈন্য- ঘোষণা সরকারের, প্রস্তুতি শুরু। নামানো হয় গোটা সামরিক বাহিনী । দ্রুততার সঙ্গে প্রস্তুত করে ফেলে করোনা আক্রান্তদের জন্য স্পেশাল হাসপাতাল এবং কোয়ারেন্টাইন সেন্টার। বিদেশে আসা যাওয়ার উপর শুরুতেই জারি করে নিষেধাজ্ঞা। ব্যবসা ছাড়া সিল করে দেয় চীনের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত। বাতিল করে সমস্ত আন্তর্জাতিক উড়ান। বন্ধ করে দেয় স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্ধ হয় সমস্ত জরুরি বাদ দিয়ে সাধারণ অপ্রয়োজনীয় ব্যবসা। পাশাপাশি চলে মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রচারাভিযান। কীভাবে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে, কী করলে সুস্থ থাকা যায়— এটাই ছিল পাড়ায় পাড়ায় রাস্তায় রাস্তায় প্রচারের মূল বিষয়। ৯৭.৭ শতাংশ শিক্ষিত । দীর্ঘ অভিযানে গড়ে তোলা হয়েছে স্বাস্থ্য চেতনা ।আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নজরদারি এড়িয়ে ইউরোপ ফেরত একজন মহিলা ব্যবসায়ী ঢুকে পড়লেও, পুলিশ তাঁকে আটক করে। পরে জানা যায় তিনি করোনায় আক্রান্ত। সঙ্গে সঙ্গেই ওই মহিলা যে বিমানে এসেছিলেন, তাঁদের সবাইকে রাখা হয় কোয়ারেন্টাইনে। তিনি যে রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলেন তা জীবানুমুক্ত করা হয়। ভিয়েতনামের স্বাস্থ্যমন্ত্রক মনে করে ওই মহিলা বিমানবন্দরের স্বাস্থ্যপরীক্ষায় ফাঁকি না দিলে আক্রান্তের সংখ্যা এত বাড়ত না।

এই সময়ে কেউ অভুক্ত থাকেনি। কেউ অভুক্ত থাকছে না। লকডাউনে ভিয়েতনামে এটিএম থেকে টাকা নয়, বেরোচ্ছে চাল। দেশের মানুষের পেটে যাতে অন্তত টান না পাড়ে, তার জন্য অভিনব ব্যবস্থা নিয়েছে ভিয়েতনাম সরকার। করোনায় মানুষের রোজগার বন্ধ। তাই সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চাল এটিএম থেকে। চাল পেতে হলে দু’টি কাজ। একজনকে অপরের থেকে ৬-ফুট দূরে দাঁড়াতে হবে, আর চাল নেওয়ার সময় ব্যবহার করতে হবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। রাজধানী হো চি মিন সিটির এটিএম খোলা থাকছে সপ্তাহে সাতদিন, চব্বিশ ঘণ্টা। স্বাস্থ্যকর্মীরা যাচ্ছেন বাড়িতে বাড়িতে। গিয়ে কারো জ্বর আছে কি না দেখছেন, তাপমাত্রা পরীক্ষা করছেন।

Manual5 Ad Code

ক’দিন হলো আবার স্বাভাবিকের পথে ভিয়েতনাম। উড়ছে অন্তর্দেশীয় উড়ান। সপ্তাহখানেক হলো খুলেছে হো চিন মিন মুসোলিয়াম। মে’র প্রথম সপ্তাহ থেকে খুলেছে স্কুল-কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১১ মে বসেছে ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বাদশ অধিবেশন। বৈঠক পরিচালনা করেন নগুয়েন ফু ত্রঙ। তিনি জানিয়েছেন, ‘দক্ষিণ ভিয়েতনামের মুক্তি এবং জাতীয় একত্রিকরণের ৪৫তম বার্ষিকী, রাষ্ট্রপতি হো চি মিনের ১৩০তম জন্ম বার্ষিকী এবং কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ে বৈঠকে বিশদ আলোচনা হয়েছে, আর এতে দেখা গিয়েছে পার্টি ও জনগণের বিপুল সাফল্য।’

ভিয়েতনামের এই সাফল্যের নেপথ্যে আসলে রয়েছে সরকার- জনগণের প্রতি পারস্পরিক আস্থা ও বন্ধন । দুর্বল কাঠামো কিন্তু সর্বাত্মক সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা। জনমুখী জনস্বাস্থ্য এবং রোগের চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ করার যে কর্মসূচী নিয়ে ভিয়েতনাম বহুদিন চর্চা করে এসেছে, করোনা প্রতিরোধে তাকেই তারা বড় ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে।

Manual7 Ad Code

গতবছর রাষ্ট্রসঙ্ঘের একটি বৈঠকে দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার অভিজ্ঞতা শুনিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নগুয়েন থাই কিম। একটি স্বাধীন সংস্থার সমীক্ষার কথা শুনিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, রোগীদের ৮১ শতাংশই চিকিৎসায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাঙ্কের যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘ট্র্যাকিং ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ: ২০১৭ গ্লোবাল মনিটরিং রিপোর্ট’ প্রতিবেদন তুলে ধরে বলেছিলেন, প্রতিবেদনে পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে ১০০’র মধ্যে ভিয়েতনাম পেয়েছে ৭৩। যেখানে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার গড় ৫৯ এবং বিশ্বায়িত গড় ৬৪।

দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ স্বাস্থ্যবিমার আওতায়। এর মধ্যে গরিবদের জন্য এই বিমার প্রিমিয়ামের ১০০ শতাংশই দেয় সরকার। প্রায় গরিবদের ক্ষেত্রে এই হার ৭০ শতাংশ। ২০১৭তে, জনস্বাস্থ্যে ভিয়েতনাম খরচ করেছে জিডিপি’র সাড়ে ৭ শতাংশ।

Manual1 Ad Code

করোনাকে সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেই সায়গন দখল ও দেশের পুনরায় ঐক্যের ৪৫তম দিবস পালন করেছে ভিয়েতনাম। সায়গন এখন হো চি মিন সিটি। ৪০ লক্ষ ভিয়েনামবাসীর মৃত্যু ও মরণপণ লড়াইয়ে পরাস্ত হয়েছিল মহাশক্তিধর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। সেদিন বাংলায় স্লোগান। তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম। আজ দেশের পরিস্থিতি সামলে ভিয়েতনাম সাহায্য করে চলেছে বিশ্বের অনেক দেশকে। তার মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। ভিয়েতনামে যারা ইতিহাসের বর্বরতম সামরিক আগ্রাসনের অন্যতম চাপিয়ে দিয়েছিল। যে আগ্রাসনে ব্যবহৃত রাসায়নিক অস্ত্রের প্রভাব এখনও রয়ে গেছে। একই সঙ্গে জানুয়ারির শেষে ভিয়েতনাম ও আমেরিকায় প্রথম আক্রান্ত । কি হাল! আজ মার্কিন ভূখণ্ডে যখন ৯০ হাজার মানুষ করোনায় মারা গিয়েছেন, আক্রান্ত যখন ১৫ লক্ষের উপরে, তখন ভিয়েতনামে একজনেরও মৃত্যু হয়নি। আক্রান্তের সংখ্যা এপ্রিলে প্রায় এক জায়গায়, ৩১৪। এখানেই জনগন ও মানবতার প্রতি মনোভাবে সমাজতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। হো চি মিন তাই বলেছিলেন,” নদীর যেমন জলের উৎস থাকে, গাছের যেমন শিকড় থাকে; বিপ্লবী জনগণকে সত্যিকারের অনুপ্রাণিত হতে হবে বিপ্লবী নৈতিকতায় । যদি তা না হয় তাহলে কখনও তারা জনগণকে নেতৃত্ব দিতে পারে না ।”

Manual6 Ad Code

মহান শিক্ষকের এই শিক্ষায় ৯.৭০ কোটি মানুষের ভিয়েতনাম যে কোন অবস্থায় বিপদে আপদে ঐক্যবদ্ধ ।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code