আগামী বাজেট কেমন হওয়া উচিত

প্রকাশিত: ৪:৩৯ অপরাহ্ণ, মে ১২, ২০২০

আগামী বাজেট কেমন হওয়া উচিত

Manual2 Ad Code

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, ১২ মে ২০২০ : কোভিড-১৯ সংকটের মধ্যেই আগামী মাসে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষিত হতে যাচ্ছে। এবার অর্থনীতির অস্বাভাবিক সংকোচনে প্রচলিত বাজেটীয় ব্যবস্থা থেকে সরে আসতে হবে। তিন বছর মেয়াদি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার আওতায় বাজেট প্রণয়ন বাঞ্ছনীয়। আয় সংকোচন রোধ করতে হবে এবং তা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিদ্যমান কর্মসংস্থান ধরে রাখা ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দিয়ে মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির সমন্বয় করতে হবে।

কোভিড-১৯-এর আগেই কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাসের শ্লথগতি, আমদানি-রপ্তানি হ্রাস ও রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রায় ঘাটতির চিহ্ন ছিল। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই সরকার ব্যাংক খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রার পুরো ঋণ নিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে কোভিড-১৯ মহামারি এসে অর্থনীতিতে অভিঘাতের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।

এই সংকটে নাগরিকদের সর্বজনীন মৌলিক প্রয়োজনীয়তা তথা খাদ্য, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, বাসস্থান ইত্যাদি প্রদানে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়েছে। ‘সামাজিক নিরাপত্তা জাল’ নামে কিছু কর্মসূচি আছে, কিন্তু তা খুবই অপ্রতুল, উপরন্তু দুর্নীতির শিকার। জনসেবার খাতগুলোতে বরাদ্দ দিন দিন কমেছে। কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের দুর্বলতাও এই মহামারির মধ্যে উন্মোচিত হয়েছে।

অর্থনীতির চালচিত্র

করোনার ফলে ভোগ, সরকারি ব্যয়, আমদানি ও রপ্তানি সূচক দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আরও কমে যাবে। কয়েক বছর ধরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ জিডিপির ২৩ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। কর্মহীন মানুষের আয় কমে যাওয়ায় সঞ্চয় হ্রাস পাবে; সঞ্চয় থেকে আসা বিনিয়োগ কমে যাবে। করোনার কারণে মার্চ মাসে ১২ শতাংশ প্রবাসী আয় কমেছে। প্রায় তিন লাখ প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরেছে। দেশের ভেতরে ও বাইরে এভাবে আয় কমে যাওয়ায় ভোগ ব্যয়ও অনেক কমে যাবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর প্রকট প্রভাব পড়বে। ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয় জিডিপির ৭০ শতাংশ। ছয় মাসে রপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। কৃষক তঁার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেলে পরবর্তী মৌসুমে উৎপাদনে যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং সেবা খাতের কার্যক্রমও বন্ধ।

বাজেট প্রস্তাবনা ও খাতওয়ারি ব্যয় বরাদ্দ

চলতি অর্থবছরের ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট পেশকালে ২৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকার জিডিপি ও ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল। করোনার আঘাত পড়েছে অর্থবছরের সাত-আট মাস পর। বছরের শেষ প্রান্তিকে, বিশেষ করে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ও উৎসবকেন্দ্রিক খুচরা বিক্রয় খাতে ব্যয় বাড়ে। অর্থনৈতিক সংকোচনের ফলে এবার জিডিপির সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হতে পারে। এই প্রবৃদ্ধিতে সংশোধিত জিডিপি ২৭ লাখ ৪১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা হবে। এখানে আগামী বছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ ধরে ২৯ লাখ ৬৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকার নমিনাল জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়েছে। আগামী বছরের জন্য ৭ লাখ ৬৭ হাজার ৭৪৪.৯ কোটি টাকার খসড়া বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। মন্দাকালীন বিনিয়োগ, ভোগ ব্যয় ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় সামষ্টিক চাহিদা বাড়াতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ প্রস্তাবনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সর্বজনীন মৌলিক প্রয়োজনীয়তা তথা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের বহুমুখীকরণ, উৎপাদন ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

সর্বজনীন মৌলিক প্রয়োজনীয়তা

সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও গবেষণায় ব্যয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। আয়-সহায়তা, বেকারত্ব ভাতা, শিশু প্রতিপালন ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, অবসর ভাতা, আবাসন সহায়তা, স্বাস্থ্য ভাতা বাবদ এ প্রস্তাবে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৯২৩.৯ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। এটা প্রাক্কলিত জিডিপি ও বাজেটের যথাক্রমে ৫.৫৩ এবং ২১.৩৫ শতাংশ। গত অর্থবছরে পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১.০১ এবং ৫.৬ শতাংশ মাত্র। বিভিন্ন দেশে এখাতে জিডিপির ৬-৭ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়।

শিক্ষা, প্রযুক্তি ও গবেষণায় ১ লাখ ২৫ হাজার ৯৮১.৩ কোটি টাকার বরাদ্দ ধরা হয়েছে। এটা জিডিপির ৪.২৫ শতাংশ এবং বাজেটের ১৬.৪০ শতাংশ। চলতি বছরে ছিল জিডিপি ও বাজেটের যথাক্রমে ২.৭৫ ও ১৫.২ শতাংশ।

স্বাস্থ্য খাতে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়নি। জনবল, অবকাঠামো ও প্রশিক্ষণ ঘাটতি প্রকট। প্রথম ধাক্কাতেই স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। যৌক্তিক কারণেই প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ১ লাখ ৪৮৮.৬ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। এটা জিডিপি এবং বাজেটের যথাক্রমে ৩.৩৯ এবং ১৩.০৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ছিল যথাক্রমে ০.৮৮ এবং ৪.৯ শতাংশ।

Manual3 Ad Code

উৎপাদন বহুমুখীকরণ, প্রতিযোগিতা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা

Manual3 Ad Code

দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো কৃষির ওপর নির্ভরশীল। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ৪৪ হাজার ৪৬৩.৯৯ কোটি টাকা। এটা জিডিপি ও বাজেটের যথাক্রমে ১.৫ ও ৫.৭৯ শতাংশ। চলতি বছরে ছিল যথাক্রমে ০.৯৭ ও ৫.৪ শতাংশ। শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবাসমূহে বরাদ্দ বাড়িয়ে ২১ হাজার ৬৩৯.১৪ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা জিডিপির ০.৭৩ এবং বাজেটের ২.৮১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ০.১২ শতাংশ এবং বাজেটের ০.৭ শতাংশ। বৈচিত্র্যকরণ, সবুজ শিল্পায়ন ও গ্রামীণ অর্থনীতি উজ্জীবন সমন্বিত শিল্পায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে ইকুইটি ম্যাচিং তহবিল গঠন করা যেতে পারে। ক্ষুদ্র, মধ্যম ও নতুন উদ্যোক্তাদের প্রাধান্য প্রাপ্য। বড় উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান, পণ্যবৈচিত্র্য, মূল্য সংযোজন, সবুজায়ন, বিকল্প রপ্তানি সৃষ্টি ইত্যাদি শর্ত আরোপ করা দরকার। প্রত্যেক ধাপের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিশ্চিত করে পরবর্তী সহায়তা প্রদান করলে ঋণখেলাপি ও রুগ্‌ণ শিল্পকারখানা নিয়ে আগের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা এড়ানো সম্ভব।

Manual1 Ad Code

আয়ের উৎস ও ঘাটতি অর্থায়ন

অর্থনীতি সংকুচিত হওয়ায় আয়কর ও মূল্য সংযোজন করও কমবে, ফলে রাজস্ব কমে যাবে। এ প্রস্তাবনায় কর-রাজস্ব ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৬ হাজার ৯০৪.৮ কোটি টাকা। বিদেশি অনুদান ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৩৫৪.৯ কোটি টাকা। ৯.৯৭ শতাংশ বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের জন্য দেশি-বিদেশি ঋণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিদেশি ঋণ প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ৯২ হাজার ৮৯.৮ কোটি টাকা। দেশি উৎস থেকে ঋণ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। এখন বাজেট ঘাটতি ও জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাতের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় নয়। ঋণ-জিডিপি অনুপাত সহনীয় ৩০ শতাংশের কোঠায় আছে। মন্দায় ভোক্তার ব্যয় ও উৎপাদনের দুরবস্থায় মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা নেই।

এই পরিস্থিতিতে অর্থসংস্থানের জন্য বিভিন্ন উৎস সমন্বয়ে সমন্বিত কৌশল নিতে হবে। প্রথমত অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হবে, কিন্তু কৃচ্ছ্রতায় যাওয়া যাবে না। বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ ভর্তুকি বাদ দিতে হবে, সরকারের অতিরিক্ত জনবল ইত্যাদি বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সহজে কর আদায়ের খাতগুলো বের করতে হবে। যেমন, এ দেশে অনিবন্ধিত যে প্রায় আড়াই লাখ বিদেশি নাগরিক কাজ করছে, তাদের কাছ থেকেই প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার আয়কর আদায় সম্ভব। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিভিন্ন পন্থায় কর ফাঁকি দেয়, তাই ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল সক্রিয় করে কর আদায় বাড়ানো যেতে পারে। দেশি কোম্পানিগুলোকে যে গোষ্ঠীতান্ত্রিক করসুবিধা দেওয়া হয়, তার পুনর্নিরীক্ষণ দরকার। তৃতীয়ত, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উৎস থেকে বিদেশি অনুদান বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। চতুর্থত, দীর্ঘমেয়াদি কম সুদের হার ও গ্রেস পিরিয়ড সম্পন্ন বিদেশি ঋণই শুধু নিতে হবে। পঞ্চমত, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ব্যাংক খাত থেকে আর ঋণ নেওয়া যাবে না। কারণ, ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যেই তারল্যসংকটে আছে। ট্রেজারি বিল ও সঞ্চয়পত্রে ঋণ পরিশোধ ব্যয় বাড়াবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে সরকারের অর্থের জোগান দিতে হবে। প্রয়োজন হলে নতুন অর্থ ছাপাতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, সেই পরিমাণ তারল্যই বাজারে প্রবেশ করতে দিতে হবে, যে পরিমাণ অর্থ সংকোচন ক্ষতি পুষিয়ে দেবে বা মূল্যস্ফীতি সহনীয় অবস্থার মধ্যে রাখবে। অতএব পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। সনাতন প্রথাগত ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে এসে সৃজনশীলতা দেখাতে হবে।

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন
rt@du.ac.bd

Manual1 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code