‘ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম অমর হোক’

প্রকাশিত: ৫:০৭ পূর্বাহ্ণ, মে ১৩, ২০২০

‘ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম অমর হোক’

মহি উদ্দিন মহিম, ১৩ মে ২০২০ : ভারতবর্ষের ইতিহাসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রথম গণঅভ্যুত্থান দিবস ১৮৫৭ সালের ১০ মে। এইদিনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর হতে ভারতবর্ষে বৃটিশ বেনিয়াদের শাসন শোষণ লুণ্ঠন নিপীড়নের ফলে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক সামাজিক কাঠামো চূর্ণ বিচূর্ণ ও জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। বিভিন্ন জাতি উপজাতি বর্ণ ধর্ম, সার্বভৌম রাজ্য ও প্রদেশ নিয়ে ভারতবর্ষ।

ভারতের হিন্দু মুসলিম সহমর্মিতাপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করতো। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এই সম্প্রীতি ধ্বংশ করে দেয়। বিভক্তি করে শাসন করো- এই কুটচালের ভিত্তিতে চলে শাসন শোষণ লুণ্ঠন নিপীড়ন। ব্রিটিশ শাসক শোষকরা ভারতের স্বনির্ভর অর্থব্যবস্থা- কৃষি,তাঁত, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প, নগর সব ধ্বংশ করে। ফলে কোটি কোটি কৃষক কারিগর মেহনতি জনতা রিক্ত নিঃস্ব হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে, ‘প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা -যুদ্ধ’ – বইতে মহামতি কার্ল মার্কস বলেন, “অবশ্য এতে সন্দেহ নেই যে বৃটিশরা হিন্দুস্তানের উপর যে দুর্দশা চাপিয়েছে তা হিন্দুস্তানের আগের সমস্ত দুর্দশার চাইতে মূলগতভাবে পৃথক এবং অনেক বেশি তীব্র।” মার্কস আরও বলেন,” কিন্তু ইংল্যান্ড ভারতীয় সমাজের সমগ্র কাঠামোটাই ভেঙ্গে দিয়েছে, পুনর্গঠনের কোন লক্ষণ এখনও অদৃশ্য। পুরাণো জগতের অপহৃতি অথচ নতুন জগতের এই অপ্রাপ্তির ফলে হিন্দুদের বর্তমান দুর্দশার ওপর এক অদ্ভুত রকমের শোকের আবির্ভাব ঘটে। বৃটেন-শাসিত হিন্দুস্তান তার অতীত ঐতিহ্য, তার সমগ্র অতীত ইতিহাস থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছে।” ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিজ দেশে গণতন্ত্র চর্চা, সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা কায়েম করলেও ভারতবর্ষে সামন্তবাদী ব্যবস্থা ভেঙ্গে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র কায়েম হোক তার দিকে কখনও নজর দেয়নি। বরং ভারতবর্ষে শাসন শোষণ লুণ্ঠন নিপীড়ন বজায় রাখার জন্য এখানে তারা সামন্তবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদের সাথে আপোষ করে অতিমাত্রায় শোষণ লুণ্ঠন নিপীড়ন করেছিল। এবং ভারতবর্ষে সামন্তবাদী ব্যবস্থা বজায় রাখা সামন্ত- সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিকে লালন পালন করেছে। এ প্রসঙ্গে মার্কস বলেন,” স্বদেশে যারা ভদ্ররূপ নেয় এবং উপনিবেশে গেলেই তা নগ্ন হয়ে আত্মপ্রকাশ করে সেই বুর্জোয়া সভ্যতার প্রগাঢ় কপটতা এবং অঙ্গাঙ্গী বর্বরতা আমাদের সামনে অনাবৃত।” তখনকার সময়ে ভারতবর্ষের কৃষক মেহনতি জনতার উপর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন শোষন লুণ্ঠন নিপীড়ন চরম আকার ধারণ করেছিল। চরম অত্যাচার অবিচারে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এসব অপকর্মের কারণেই ও এর বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ সংগঠিত রূপ নেয় ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতার যুদ্ধ। ইহাই ভারতবর্ষের সিপাহী কৃষক কারিগর মেহনতি জনতার প্রথম স্বাধীনতা ও মুক্তির সশস্ত্র লড়াই সংগ্রাম, প্রথম গণঅভ্যুত্থান। কৃষকদের লুণ্ঠন, মাত্রাতিরিক্ত কর আদায়, এজন্য কৃষকদের অমানুষিক নির্যাতন, কিছুকিছু সামন্ত জমিদারদের উচ্ছেদ, তাঁত, ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প, নগর ধ্বংশকরণ, ভারতের শেষ স্বাধীন রাজ্যগুলো গ্রাস করার নীতি, ভারতীয় ঐতিহ্য প্রথার উপর প্রভুত্ব মানসিকতা নিয়ে অর্থ-রাজনীতি-সমাজ কাঠামোতে চরম আঘাত, উপনিবেশিক সন্ত্রাস-রাজ কায়েম, এসব কারণে জনগণ প্রতিবাদী হয়ে উঠে, জনতার প্রতিবাদ প্রতিরোধ লড়াই সংগ্রাম সাংগঠনিক রূপ নেয় স্বাধীনতা ও মুক্তির গণঅভ্যুত্থানে। অযোধ্যা, রোহিলখণ্ড, বুন্দেলখণ্ড এবং সগর ও নর্মদা উত্তর ভারতের এই চারটি প্রদেশের অল্প কিছু সংখ্যক লোক ছাড়া প্রায় সকল জনগণ গণঅভ্যুত্থানে যোগ দিয়েছিলেন। মিরাট অলিপুরের জনগণ সিপাহীদের অভ্যুত্থান করতে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। যারা ব্রিটিশদের পক্ষে ছিল তাদেরকে একঘরে করে রাখা হয়েছিল।গণঅভ্যুত্থানে সিপাহীদের সাথে হাজার হাজার কৃষক কারিগর মেহনতি জনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।গণঅভ্যুত্থানের সময় সিপাহী কৃষক কারিগর মেহনতি জনতা ইংরেজ সৃষ্ট ভূমিব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। অভ্যুত্থানকারীরা জমিদারদের উচ্ছেদ, তাদের বিতাড়িত করে ভূ- সম্পত্তি দখল করে।থানা- কাছারি, তহসিল প্রভৃতি ব্রিটিশ শাসনের সকল চিহ্ন ধ্বংশ করতে থাকে। এই স্বাধীনতা সংগ্রামে উত্তর ও মধ্য ভারতের মেহনতি জনতা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই লড়াই সংগ্রামে অংশ নেয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেসব স্থানে ব্রিটিশ শাসন শূন্য অবস্থায় পরিণত হয়েছিল। অভ্যুত্থান সফলতার সাথে সাথে স্বাধীন ভারতের গণপ্রশাসন প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু হয়। মেহনতি জনতার মাঝে গণতান্ত্রিক চেতনা জেগে উঠে।
বিদ্রোহী সিপাহী, কৃষক,কর্মকার, মেহনতি জনতা সৃষ্ট এই গণঅভ্যুত্থানের যাঁরা নায়ক ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- মঙ্গল পাণ্ডে, তাঁতিয়া টোপি, রানী লক্ষীবাই, বেগম হযরত মহল, নানা সাহেব, মৌলবি আহামাদুল্লা, রাওতুলা রাম প্রমুখ। এ অভ্যুত্থান প্রথম শুরু হয় ১৮৫৭ সালের প্রথম দিকে কলিকাতার নিকটে ব্যারাকপুর থেকে। অল্প সময়ে এ অভ্যুত্থান থেমে যায়। এর তিন মাস পর উত্তর ভারতের ৪ টি প্রদেশে আবার অভ্যুত্থান শুরু হয়। ১৮৫৭ সালের ৯ মে বিপ্লবী সিপাহীদের কারাগারে নিক্ষেপ করায়, এর পরদিন ১০ মে বিপ্লবী সিপাহীরা গণঅভ্যুত্থান শুরু করেন। তাঁরা ইংরেজ সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে। ক্যান্টনমেন্ট জ্বালিয়ে দেয়। দিল্লীতেও আক্রমন করে ব্রিটিশ সেনাদের হত্যা করে। বিপ্লবীরা ১১ মে বাহাদুর শাহ কে ভারতের সম্রাট ঘোষনা করেন। অভ্যুত্থানের প্রথম দিকেই শাসনকার্য যুদ্ধ সংগ্রাম পরিচালনার জন্য বিপ্লবী সামরিক কর্মচারী থেকে ৬ জন, বেসামরিক কর্মচারী থেক ৪ জন নিয়া ১০ সদস্য বিশিষ্ট ‘রাষ্ট্রীয় সভা’ গঠন করা হয়। এই রাষ্ট্রীয় সভা সকলের মতামত ও ভোটের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহন ও পরিচালনা করত। এই গণঅভ্যুত্থানে কোটি কোটি কৃষক কারিগর, মেহনতি জনতা সিপাহীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ঐতিহাসিক কে (Kaye) তার গ্রন্থে স্বীকার করে লিখেছেন,”গঙ্গা যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে হিন্দু বা মুসলমানদের মধ্যে এমন একজন ছিলনা যে আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নাই।” এ বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করে গণশাসন প্রতিষ্ঠা করা। সিপাহী জনতা এ যুদ্ধে উত্তর মধ্য ভারতের প্রায় স্থানে ইংরেজদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংশ করে দিয়েছিল। এবং বহু খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে ইংরেজদের পরাজিত করে কৃষক অভ্যুত্থান চালিয়েছিল। বিদ্রোহীরা ইংরেজ সৃষ্ট জমিদারদের উচ্ছেদ ও বিতাড়িত করে অনেকস্থানে ভূসম্পত্তি কৃষকরা দখলে নেয়। এতে অল্প সময়ের মধ্যে উত্তর ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্য বিধ্বস্ত রূপ নেয় এবং শুরু হয় গণশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। সিপাহী কৃষক কারিগর মেহনতি জনতার এ গণঅভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা যায়নি। কোটি কোটি জনতার গণঅভ্যুত্থান যা পরিকল্পিত ঐক্যবদ্ধ সাংগঠনিক কাঠামো ভিত্তিতে করা সম্ভব হয়নি। দৃঢ়চিত্ত অভিজ্ঞ নেতৃত্বের অভাব, বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নিতে না পারা, পর্যাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায়, অভ্যুত্থান ঐক্যবদ্ধভাবে পরিচালনা করতে না পারায়, সামন্ত- রাজা-জমিদার ও তাদের সহযোগী তালুকদার, ইংরেজদের পদলেহী মধ্যবিত্ত ও কর্মচারীদের বিরোধীতা ষড়যন্ত্র বিশ্বাসঘাতকতার কারণে স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হয়নি। এ অভ্যুত্থানে হিন্দু মুসলিম একতাবদ্ধ হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, এটা ছিল একটি গণবিদ্রোহ, গণসংগ্রাম, গণঅভ্যুত্থান। সিপাহী কৃষক কারিগর মেহনতি জনতার ঐক্যের যোগসূত্র ও প্রেরণা। এই গণঅভ্যুত্থানে লাখ সিপাহী কৃষক জনতা শহীদ হয়েছেন। তাঁদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, তাঁদের আত্মত্যাগ ভারত উপমহাদেশের জনগণের জন্য স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে আদর্শিক সুদূরপ্রসারী চেতনা, যা এ উপমহাদেশের কৃষক শ্রমিক জনতার আন্দোলন সংগ্রামে গণসচেতনতা সৃষ্টি করেছে।
যাঁরা প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তির সংগ্রামে শহীদ হয়েছেন, যাঁরা আহত হয়েছেন, সম্পদ হারিয়েছেন, স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বীরদের গভীর শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করছি, তাঁদের লাল সালাম।

তথ্যসূত্র
১. মহামতি কার্ল মার্কস ও ফেডারিক এঙ্গেলস রচিত -‘প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা- যুদ্ধ’ বই থেকে,
২. সুপ্রকাশ রায় এর ‘ ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’।