বিশ্বশান্তি ও নৈতিকতার অগ্রদূত মহীয়সী বিজ্ঞানী মাদাম কুরি স্মরণে

প্রকাশিত: ৪:২৫ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৮, ২০২১

বিশ্বশান্তি ও নৈতিকতার অগ্রদূত মহীয়সী বিজ্ঞানী মাদাম কুরি স্মরণে

Manual6 Ad Code

নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা, ০৮ নভেম্বর ২০২১ : উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ফরাসি বিজ্ঞানী বেকারেল পরীক্ষা করে দেখালেন কোনওরকম কোন বাহ্যিক ক্রিয়া ছাড়াই ইউরেনিয়াম নামক পদার্থ থেকে অনবরত অজানা এক রশ্মির বিকিরণ হচ্ছে। পরবর্তীতে এই বিকিরণ রহস্যের দ্বার উন্মোচন করে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় “তেজস্ক্রিয়তা”র সূচনা করেন কুরি দম্পতি মাদাম কুরি ও পিয়ের কুরি। প্রকৃতপক্ষে “তেজস্ক্রিয়তা” এই নামটা তাঁদেরই দেওয়া। ৪ জুলাই মাদাম কুরির স্মরণ দিবস। তিনি একদিকে ছিলেন একনিষ্ঠ বিজ্ঞান সাধক, অন্যদিকে তিনি মানবিক মূল্যবোধে, সমাজ চেতনায়, নাম-যশ-আর্থিক প্রলোভনের প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন, সত্যনিষ্ঠ এক উজ্জ্বল চরিত্রের চিরস্মরণীয় দৃষ্টান্ত।

Manual1 Ad Code

জন্ম ১৮৬৭ সালের ৭ই নভেম্বর পোল্যান্ডের ওয়ারশ এ। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি। তাঁর বাবা মা দুজনেই ছিলেন শিক্ষক। শিক্ষাজীবনের শুরুতে মারি একটি বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হন এবং শিক্ষানুরাগী বাবার তত্ত্বাবধানে বাড়িতে বিজ্ঞান চর্চাও চলতে থাকে। ১৮৮৩ সালে তিনি স্বর্ণপদকসহ স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। কিন্তু জার শাসিত পোল্যান্ডে মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেই, তার জন্য যেতে হবে প্যারিস।

অত্যন্ত দারিদ্রের সাথে লড়তে লড়তেই চলতে থাকে তাঁর লেখাপড়া। ১৮৯৩ সালে পদার্থবিদ্যায় এবং ১৮৯৪ সালে আলেকজান্দ্রেভিচ স্কলারশিপের টাকায় গণিতে স্নাতকোত্তর পাশ করলেন, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরবর্তীকালে চাকরি পাওয়ার পরই আলেকজান্দ্রেভিচ স্কলারশিপের টাকা সেই কর্তৃপক্ষের হাতে ফিরিয়ে দেন, যাতে তাঁর মতোই দরিদ্র ছাত্রদের সুবিধা হয়।

Manual6 Ad Code

পরবর্তীতে গবেষণার আঙিনায় পিয়েরের সাথে পরিচয়। পিয়ের কুরি তখন বেশ নামকরা পদার্থবিদ। ইতিমধ্যেই তিনি দেখিয়েছেন যে, চৌম্বক পদার্থ একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় হঠাৎ করেই অচৌম্বক পদার্থে পরিণত হয়। এই তাপমাত্রাকে তাঁর সম্মানার্থে কুরি তাপমাত্রা নামে পরিগণিত হয়। মাদাম কুরি প্যারিসে ‘দ্য সোসাইটি ফর দ্য এনকারেজমেন্ট অব ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রি’-র সহায়তায় বিভিন্ন পদার্থের চুম্বকত্বের ওপর গবেষণা করতে থাকেন। পিয়েরের সাথে মাদামের গভীর সম্পর্ক আসলে বিজ্ঞান ও গবেষণার প্রতি অগাধ ভালোবাসার এক জ্বলন্ত নিদর্শন।

১৯০৩ সালে মাদাম কুরি ডক্টরেট উপাধি পান। গবেষণার মাধ্যমে দেখান চ্যালকোলাইট এবং পিচব্লেন্ড খনিজে ইউরেনিয়াম ছাড়া আরও কোন পদার্থ আছে, যা ইউরেনিয়ামের মতোই তেজস্ক্রিয়। দুটি নতুন মৌলের অস্তিত্ব প্রমাণ করলেন – নাম দিলেন পোলোনিয়াম এবং রেডিয়াম। কিন্তু শুধু তাই নয়, ১ টন পিচব্লেন্ড থেকে ১/১০ গ্রাম রেডিয়াম ক্লোরাইড লবণ নিষ্কাশন করলেন। আরও প্রমাণ করলেন তেজস্ক্রিয়তা যৌগের না, মৌলের ধর্ম। সে বছরের ডিসেম্বর মাসে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সাইন্স হেনরি বেকেরেল, পিয়েরে কুরি ও মাদাম কুরিকে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার দেয় পদার্থবিদ্যায়। বিজ্ঞানে নোবেল প্রাপ্তি, প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী মাদাম কুরি।

১৯০৬ সালে পিয়েরের আকস্মিক মৃত্যুর পরে দুই সন্তানকে সামলেও মাদাম কুরি গবেষণা চালিয়ে যান। মাদাম কুরি সম্পর্কে তাঁর কন্যা ইভ্ কুরি বলেছেন “পারিবারিক জীবন কিংবা বৈজ্ঞানিক জীবন কোনটা বেছে নেবেন এ প্রশ্ন নিয়ে মারি কোনোদিন মাথা ঘামাননি। প্রেম, মাতৃত্ব ও বিজ্ঞান একাধারে তিনটিকে জীবনে গ্রহণ করবেন, এই ছিল তাঁর সংকল্প এবং বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন সফলতার সঙ্গেই।”

গবেষণার মাধ্যমে রেডিয়াম ধাতু নিষ্কাশন পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ১৯১১ সালে ফের নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হলেন এবং এবার এককভাবে। প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী হিসেবে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন, উভয় বিষয়ে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হওয়ার বিরল নজির তিনি।

রেডিয়াম আবিষ্কার, এবং ক্যান্সার নিরাময়ের চিকিৎসায় তার কার্যকারিতা প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যবসায়িক স্বার্থে মুনাফার উদ্দেশ্যে নিষ্কাশন ও বিক্রি শুরু হয়। বিপুল অর্থের বিনিময়ে আবিষ্কারের পেটেন্ট নেওয়ার সুযোগ এলে, বিজ্ঞান নৈতিকতার পরিপন্থী পেটেন্ট প্রস্তাব তিনি প্রবল ঘৃণার সাথে বর্জন করেন। অবশ্য একথা অনস্বীকার্য যে, তাঁর এই আবিষ্কার আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী দিক নির্দেশক হিসেবে নিদর্শন হয়ে রয়েছে বিজ্ঞানের ইতিহাসে। এক্ষেত্রে স্মরণ করতে হয় তাঁর চিন্তা “কারোর ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করা রেডিয়ামের উদ্দেশ্য নয়। সমাজের মধ্যে আহরিত জ্ঞানের দ্বারা আবিষ্কৃত রেডিয়াম, একটি মৌলিক আবিষ্কার। বিজ্ঞান জগতে যেকোন আবিষ্কারের মালিকানা হীন ব্যক্তিস্বার্থে হতে পারে না। সমাজের জন্য বিজ্ঞান, মানুষের জন্য আবিষ্কার এবং তার মালিকানাও সামাজিক।”

অনেক গুলো বছর কেটে গিয়েছে, ১৯১৪ সালে আগস্ট মাসে অতর্কিতে ফ্রান্সকে আক্রমণ করে জার্মানি। নিজের আসল জন্মভূমি পোল্যান্ড হলেও, যে ফ্রান্স তাকে ছোট্ট মারিয়া স্কলোডস্কা থেকে মহিয়সী বিজ্ঞানী করেছে, সেই ফ্রান্স এর দুর্দিনে পালিয়ে যাননি তিনি। যুদ্ধবিরোধী একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের মতোই নিজের দ্বিতীয় মাতৃভূমি ফ্রান্সকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন। ফ্রান্সের বহু সৈনিক আহত হতে থাকে। রেড ক্রস পরিচালিত হাসপাতালে বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছিল না, বহু সৈনিক হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই পথেই মারা যেত। এর একটা সমাধান করার মহান উদ্দেশ্যে, দেশের ছাত্র- যুবক- শিক্ষক সহকর্মীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মানবদরদী কুরি।

তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে দীর্ঘদিন থেকে মেরির শারীরিক অবস্থা দিন দিন অবনতি ঘটেছিল। নিজের অসুস্থতাকে অগ্রাহ্য করে নিত্যদিন নিজের হাতে ‘Mobile X-ray Van’ চালিয়ে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈনিকদের হাসপাতালে পাঠানো, চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেই ভাঙ্গা হাড়ের অবস্থান নির্ণয় করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে আজ বিশ্ববাসীর বুকে এক উজ্জ্বল সাহসী মানবিক চরিত্রের দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন তিনি।

জার্মানির প্যারিস আক্রমনের সময়ে, পিয়েরের স্মৃতিতে তৈরী রেডিয়াম ইন্সটিটিউটে অতি কষ্টে নিষ্কাশিত একগ্রাম রেডিয়াম শত্রুর হাতে ছেড়ে যাননি যে ম্যারি, অন্যদিকে যখন যুদ্ধের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন তখন একগ্রাম রেডিয়াম সরকারি তহবিলে নির্দ্বিধায় দান করতে পারেন তিনিই। এখানেই তিনি নারীর গন্ডি ছাড়িয়ে হয়ে ওঠেন একজন মহীয়সী। একজন বিজ্ঞানীর অবস্থান কেবল মাত্র পরীক্ষাগারের চার দেয়ালে নিজেকে আবদ্ধ রাখা নয়, সমাজের প্রয়োজনে বিজ্ঞান, এবং বিজ্ঞানীর মূল অবদান সামাজিক, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অনন্য প্রমাণ দিয়ে গেছেন মেরি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা তাকে ব্যথিত হয়ে ছটফট করতে থাকেন ম্যারি। যুদ্ধবিরোধী ‘লীগ অফ্ নেশনস’ গড়ে সর্বসম্মত নির্বাচিত দায়িত্বশীল সভ্য হিসেবে যুদ্ধরোধে সক্রিয় দায়িত্বের ভূমিকায় দেখা যায় তাঁকে।

Manual6 Ad Code

পুরুষশাসিত সমাজে বার বার লাঞ্ছনার শিকার হলেও দমানো যায়নি কুরিকে। বহু পত্র-পত্রিকায় তাঁকে কালিমালিপ্ত করার হীনচেষ্টা হলে, অন্য এক মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন প্রতিবাদমুখর হয়েছেন। ঔজ্জ্বল্যে নক্ষত্রসম দৃঢ়প্রত্যয় সমৃদ্ধ এহেন চরিত্র শত বিপত্তি উপেক্ষা করেই তাঁর আসনে আজও উদ্দীন। তিনি শুধু সফল এক মহিলা বিজ্ঞানী এমন নয়, তাঁর জীবনসংগ্রাম ছিল নারীমুক্তির সংগ্রামেরও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এই মহান মানবতাবাদী বিজ্ঞানীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

সূত্র:
1. বিজ্ঞান ও মানবতাবাদের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মাদাম কুরী, ব্রেকথ্রু প্রকাশনা।
2. ইন্টারনেট
#RememberLifeStruggleofGreatScientist
#RememberMadamCurie
#BreakthroughScienceSociety

Manual7 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code