স্বর্গরাজ্য বালি: চার্লি চ্যাপলিনের অভিজ্ঞতা থেকে

প্রকাশিত: ৬:২১ পূর্বাহ্ণ, মে ২৮, ২০২০

স্বর্গরাজ্য বালি: চার্লি চ্যাপলিনের অভিজ্ঞতা থেকে

Manual5 Ad Code

রাহমান চৌধুরী, ২৮ মে ২০২০ : সিডনিই প্রস্তাব করেছিল বালি দ্বীপে যাওয়ার জন্য। বলেছিল সেখানে এখনো আধুনিক সভ্যতার ছাপ পড়েনি। সুন্দরী মেয়েরা নাকি খোলা শরীরে ঘুরে বেড়ায়। সিঙ্গাপুর থেকে রওয়ানা হওয়ার পর জাহাজ থেকে ভোরের আলোয় দ্বীপটিকে দেখলাম। সবুজ পাহাড়গুলোকে সাদা মেঘ ঢেকে রেখেছে, পাহাড়ের মাথাগুলিই দেখা যাচ্ছিল। বালিতে তখন সমূদ্রবন্দর বা বিমানবন্দর ছিল না। জাহাজ থেকে দাঁড়টানা নৌকায় করে দ্বীপে নামতে হতো। দ্বীপে নেমে পাঁচিল ঘেরা বড় উঠোন দেখলাম, যার মধ্যে দশ থেকে কুড়িটি পরিবার বাস করে। যতই দেখি মনে হয় দেশটা কী সুন্দর। সবুজ ধানের ক্ষেত হাওয়ায় দুলছে। হঠাৎ সিডনির কনুইয়ের খোঁচা। দেখি রাস্তার ধার দিয়ে চলেছে মহিলার দল। শুধু নিম্নাঙ্গ কাপড় দিয়ে ঢাকা, উপরের অংশ অনাবৃত। ফল-ভরা ঝুড়ি মাথায় নিয়ে চলেছে।

বালিতে দেন পাসারের হোটেলে উঠলাম। বসার ঘরগুলো খোলামেলা, বারান্দার মতো। ভিতরটা খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের চিত্রশিল্পী হার্সফিল্ড স্ত্রীকে নিয়ে বালিতে আছেন দুমাস ধরে। হাসফিল্ডের বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল, সপ্তাহে পনেরো ডলার দিয়ে তিনি একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। খাবার পর হার্সফিল্ড সিডনি সহ হাঁটতে বের হলাম। রাতে বেশ গরম লাগছিল, তেমন হাওয়া নেই। ধানক্ষেতের উপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি উড়ে চলেছে। বাজনার শব্দ শোনা যাচ্ছিল, চমৎকার ছন্দে বাজছিল। হার্সফিল্ড বললো, কোথাও নাচ হচ্ছে, চলুন দেখে আসি। কিছুটা গিয়েই দেখি স্থানীয় মানুষের ভীড়। ভীড়ের মধ্যে মশালের আলোতে দেখা গেল বছর দশেক বয়সের দুটি মেয়ে, মাথায় সোনালী চুমকি বসানো মুকুট, দুজনেই উদ্যাম ভেবে নেচে চলেছে উদ্যাম সঙ্গীতের তালে তালে। বড় মাদল বাজছে, তার তালে তালে তাদের মাথা দুলছে, চোখে ভঙ্গি করছে। হাতের নানা মুদ্রা, সঙ্গীত ও তার সাথে সাথে নাচ তীব্র হয়ে উঠল। পরে আবার শান্ত হয়ে এলো, যেন নরম নদীর স্রোত। হঠাৎ যেন থেমে গেল সব। কিন্তু কোনো হাততালি নেই, প্রশংসা বাক্য নেই। বালি মানুষেরা নাকি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না। যদি কেউ ভালবাসা প্রকাশ করে বা ধন্যবাদ জানায় তারা চুপ করে থাকে।

Manual2 Ad Code

সঙ্গীতকার ও চিত্রশিল্পী ওয়াল্টার স্পাইস আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন হোটেলে। তিনি পনেরো বছর ধরে আছেন এখানে, বালির ভাষাও বলতে পারেন। বালির কিছু সুর উনি পিয়ানোতে তুলেছেন, আমাদের বাজিয়ে শোনালেন। অনেকটা বাখ-এর সুরের মতো। তিনি বললেন, বালির সঙ্গীত বেশ উচ্চস্তরের। পাশ্চাত্যের জ্যাজের সুর ওদের কাছে একঘেয়ে। বরং ওরা মনে করে মোৎসার্টের সুর বেশ আবেগপ্রবণ। বাখ-কে ওরা পছন্দ করে কারণ একমাত্র ওনার সুরের সঙ্গেই ওদের সুরের মিল আছে। কিন্তু স্পাইস যাই বলুক আমাদের মনে হলো, ওদের সঙ্গীত যেন কেমন একঘেয়ে, একটু বিরক্তিকর। দুপুরে খাওয়ার পর স্পাইস আমাদের নিয়ে গেলেন জঙ্গলে। সেখানে একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান দেখতে চললাম। মাইল চারেক পথ জঙ্গলের ভিতরে যেতে হলো। বারো ফুট উঁচু একটি বেদীকে ঘিরে প্রচুর মানুষের ভীড়। সুন্দরী অল্পবয়সী মেয়েরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নগ্ন বুক অার পরনে সুন্দর পোষাক। হাতে ফলের ঝুড়ি, সেই সঙ্গে পূজার উপকরণ। পুরোহিত সেগুলি নিয়ে বেদীর উপরে রাখছেন আর আশীর্বাদ করছেন। পুরোহিতের চেহারা দেখার মতোন। লম্বা দাড়ি প্রায় কোমর পর্যন্ত, সাদা পোষাক। মনের আনন্দে মন্দিরের চারপাশে ঘুরে বেড়ালাম। মোরগের লড়াই দেখলাম। সারাদিন রাত জুড়ে কতরকম উৎসব, কতো রকম ধর্মীয় অনুষ্ঠান। সবশেষ হলো ভোর পাঁচটায়। জানা গেল বালির মানুষদের দেবতা নাকি উৎসব প্রিয়। বালির অধিবাসীরা তাঁর পূজা করে ভয়ের সঙ্গে নয়, ভালবাসা দিয়ে।

Manual2 Ad Code

বালির মানুষরা খুব সরল আর সাদাসিদে। হিসাবনিকাশও অতো বোঝে না। সেদিন এক মহিলাকে দেখলাম মশালের আলোয় নাচছিল। মহিলাটির ছোট ছেলেটি মাকে অনুসরণ করছিল। খুব অল্পবয়সী দেখতে মহিলাটির বাবা মাঝে মাঝে মহিলাটিকে নাচের নানা তালিম দিচ্ছিলেন। স্পাইস তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, তাঁর বয়স কতো। বাবা তখন স্পাইসকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘কবে যেন ভূমিকম্প হয়েছিল।’ স্পাইস উত্তর দিলেন বারো বছর আগে। তখন মানুষটি বললেন, ‘বেশ, তখন আমার তিন সন্তানের বিয়ে হয়ে গেছে।’ তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর উত্তরে আমরা ঠিক সন্তুষ্ট হইনি। তিনি তখন আবার বললেন, ‘আমার দু হাজার ডলার বয়স।’ যার দ্বারা তিনি বোঝালেন, সারা জীবনে তিনি এই পরিমাণ অর্থ খরচ করেছেন। ঠিক এভাবেই তারা বয়স হিসেব করে।

কয়েকটা বাড়ির উঠোনেই দেখলাম নতুন লিমুজিন গাড়ি। সেগুলি মুরগির খাঁচা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্পাইসকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলাম। স্পাইস জানালো একটা চত্ত্বরের ভিতরের সমস্ত পরিবার সমবায় পদ্ধতিতে চলে। সবাই মিলে একসঙ্গে ব্যবসা করে, একসঙ্গে উপার্জন করে। গরু, মোষ বাইরে চালান দিয়ে এঁরা যে অতিরিক্ত অর্থ রোজগার করে সেটা জমিয়ে রাখে। কয়েকবছর পরে তার পরিমাণ যথেষ্ট হয় যার মালিক এইসব পরিবারগুলি যৌথভাবে। হয়তো একদিন গাড়ি কোম্পানির সেলসম্যান এসে বললো, জমানো টাকা দিয়ে ক্যাডিলাক লিমুজিন কিনে নিতে। সবাই মিলে তখন গাড়ি কিনে ফেললো। কিছুদিন খুব মজা করে চড়াও হলো। তারপর গাড়ির তেল ফুরিয়ে গেল। তখন হঠাৎ হিসেব করে দেখলো, ফূর্তি করে একদিন গাড়ি চড়ার যা খরচ, তা ওদের সারা মাসের উপার্জন। ব্যস গাড়ি পড়ে রইলো উঠোনে। কদিন পরে হয়ে গেল মুরগির খাঁচা। বালির লোকদের যথেষ্ট রসবোধ আর তার মধ্যে যৌনতাও থাকে প্রচুর পরিমাণে। আর থাকে কথার খেলা।

Manual7 Ad Code

বালি তখন স্বর্গের সমতুল্য। স্থানীয় লোকেরা চার মাস ধান চাষ করে, বাকি আট মাস গান বাজনা নাটক করে কাটায়। সারা দ্বীপ জুড়েই উৎসবের পরিবেশ। সবসময়ই দেখা যায়, এক গ্রামের লোক অন্য গ্রামে গিয়ে গান বাজনা করছে। কিন্তু সেই স্বর্গ এখন অনেকটাই বদলে যাচ্ছে। বালিতে শিক্ষার ছোঁয়া লেগেছে ঘরে ঘরে। বালির নারীরা নগ্ন বুক ঢাকছে শিখছে আর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে উৎসব প্রিয় দেবতাকেও ভুলতে বসেছে।

Manual3 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code