প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির প্রেরণার আর এক নাম শহিদ ডাঃ জামিল আকতার রতন

প্রকাশিত: ৬:৫৯ অপরাহ্ণ, মে ৩০, ২০২০

প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির প্রেরণার আর এক নাম শহিদ ডাঃ জামিল আকতার রতন

Manual4 Ad Code

ইয়াসিন আলী, ৩১ মে ২০২০ : শহিদ ডাঃ জামিল আকতার রতন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের একজন মেধাবী ছাত্র। যাকে নিয়ে পিতা মাতার স্বপ্ন ছিল, সে একদিন দেশের খ্যাতিমান চিকিৎসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, পরিবারের মুখ উজ্জল করবে, দেশের মানুষের সেবা করবে। কিন্তু ছাত্র শিবির নামক হায়নার দল তাদের সে স্বপ্নকে অত্যন্ত নির্মম ও নিষ্ঠুরতার সাথে হত্যা করে রক্ত সাগরে ভাসিয়ে দেয়।

Manual7 Ad Code

৩১ মে ১৯৮৮ সালে প্রকাশ্য দিবালোকে বহু শিক্ষক ও শতশত ছাত্রছাত্রীর সামনে জল্লাদেরা জামিল আকতার রতনের উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে উল্লাসে মেতে উঠে ।

জামিল আকতার রতন কেন মৌলবাদী সন্ত্রাসী রগকাটা ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের টার্গেট এ পরিণত হয়? পড়ালেখার পাশাপাশি সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে ঘুনেধরা সমাজকে পাল্টিয়ে নতুন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সাথে সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর রাজনৈতিক মতাদর্শে উজ্জীবিত হয় এবং এক সময় তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রমৈত্রীর সভাপতির দায়িত্ব নিতে হয়। আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ঐতিহ্যের উত্তরসূরী বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীকে ছাত্র সমাজের মাঝে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে ছাত্র সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সাধারন ছাত্রদের মাঝে প্রিয় পাত্র হিসেবে নিজেকে তৈরী করে। পাশাপাশি স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন এবং মৌলবাদ বিরোধী সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সে নিজেকে যোগ্য নেতার আসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। ১৯৮৮ সালের ১১ মে তৎকালীন স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের আমলে জাতীয় সংসদে “রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম” সম্পর্কিত বিল উত্থাপিত হলে সারাদেশে ছাত্রমৈত্রীসহ অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনসমূহ এর প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়। তারই অংশ হিসেবে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে জামিল আকতার রতনের নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে । ফলে এরশাদ সরকারের মদদপুষ্ট ইসলামী ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাসী রগকাটা ক্যাডার বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয় সে।
৩১ মে ১৯৮৮ সাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজে তুমুল উত্তেজনা চলছে। রগকাটা বাহিনী হিসেবে খ্যাত শিবিরের সন্ত্রাসী বাহিনী ক্যাম্পাসে ত্রাস সৃষ্টি করে ছাত্রদের জিম্মি করে রাখে। কলেজ হোস্টেলে তারা সন্ত্রাসী হামলা চালায়। এ অবস্থায় সাধারন ছাত্রদের রক্ষা করার জন্য জামিল আকতার এগিয়ে গেলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হুইসেল বাজিয়ে তার উপর হামলা চালায় এবং উপর্যুপরি ছুড়ি চাকু দিয়ে কোপাতে থাকে। এক পর্যায়ে ইট দিয়ে তার মাথা থেতলিয়ে দেয়। ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হলে তারা ‘নারায়ে তাকবীর’ ধ্বনি দিয়ে উল্লাস করতে থাকে। জামিল আকতারের নিথর দেহ মাটিতেই পরে থাকে । কেউ এগিয়ে আসার সাহস পায় নি। বেশ কিছুদিন ধরেই তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে শিবিরের ক্যাডার বাহিনী। শিবিরের নৃসংসতার কথা জানা থাকলেও জামিল আকতার ভীত না হয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে নেতৃত্বদান অব্যাহত রাখে। কেননা তার সামনে যে আদর্শ হয়ে আছেন এদেশের বাম ছাত্র রাজনীতির অন্যতম পুরোধা জননেতা কমরেড রাশেদ খান মেনন, কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা, কমরেড নূর আহম্মদ বকুল প্রমুখ সাবেক ছাত্র নেতারা ।

Manual4 Ad Code

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির এক অশুভ শক্তি ইসলামী ছাত্র শিবির ধর্মের নামে পবিত্র ইসলামকে ব্যবহার করে কোমলমতি ছাত্রদের সংগঠনে সামিল করে এবং স্বাধীনতার পক্ষে থাকা অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার মনোভাব তৈরী করে এবং তাদের ট্রেনিং দিয়ে সন্ত্রাসী ক্যাডার তৈরী করে। রগকাটা, চোরাগুপ্তা হামলা, নৃশংস হত্যাকাণ্ড, জবাই করা, পরিকল্পিত ও ঠান্ডা মাথায় হত্যাযজ্ঞ সংগঠিত করে ত্রাস সৃষ্টি করা তাদের অন্যতম ঘৃণ্য রাজনৈতিক কৌশল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধীতাকারী পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসর জামাআতে ইসলামীর নেতৃত্ব স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে নিজেদের সামুকের মত লুকিয়ে রাখে। ১৯৭৫ এর পট-পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়ার ছত্রছায়ায় অনুকুল পরিবেশে আবার তারা মাথা চারা দিয়ে উঠে এবং নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটায়। শিবিরের ক্যাডাররা ১৯৮১ সাল থেকে একের পর এক রগকাটা, সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ড শুরু করে। প্রথমত চট্টগ্রাম সিটি কলেজ এর ছাত্রলীগ নেতা তবারক হোসেনকে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস তাদের দখলে নেবার জন্য রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্যাডার বাহিনী সংগ্রহ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজীদে জমায়েত হয় এবং প্রগতিশীল ছাত্রনেতা ও সাধারন ছাত্রদের উপর অতর্কিত হামলা চালায় । কিন্তু সেদিন সাধারন ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে পরে তারা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু সাধারন ছাত্রদের গণপিটুনিতে ৩ জন ক্যাডার নিহত হয়। ফলে হত্যা মামলায় এরশাদ সরকারের আদালতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা ছানা, রানা, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের (বর্তমান ছাত্র মৈত্রী) নেতা অনীল চন্দ্র মরন, নূর আহম্মদ বকুল, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা হেলালসহ ৮ জন ছাত্রনেতার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এ মিথ্যা মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠার এক পর্যায়ে মামলা প্রত্যাহার করা হয় ।

Manual8 Ad Code

শিবিরের ক্যাডার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের তালিকা অনেক লম্বা। ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রী, ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ ছাত্রলীগ এমনকি তাদের রাজনৈতিক মিত্র ছাত্রদলের নেতাকর্মীরাও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলে হামলা চালিয়ে জাসদ ছাত্রলীগের নেতা আইয়ুব খান, সিনেট সদস্য আহসানুল কবির, হল সংসদের ভিপি নওশাদের হাত পায়ের রগ কেটে দেয় । শেরে বাংলা হলে হামলা চালিয়ে ছাত্রমৈত্রী নেতা ঘুমন্ত অবস্থায় জুবায়ের চৌধুরী রিমুর হাত পায়ের রগ কেটে দেয় এবং তাকে কুপিয়ে হত্যা করে । পরবর্তিতে ছাত্রমৈত্রী নেতা রুদ্রর হাতের কব্জি কেটে নেয়। ১৯৯৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের মিছিলে হামলা চালিয়ে ছাত্রদলের নেতা বিশ্বজিত ও নতুনকে এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতা রিপনসহ ৫ জনকে হত্যা করে। ১৯৯৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রমৈত্রী নেতা দেবাশিষ ভট্টাচার্য রুপমকে চলন্ত বাস থামিয়ে যাত্রীদের সামনে হাত পায়ের রগ কেটে কুপিয়ে হত্যা করে। এভাবে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিবিরের ক্যাডার বাহিনীর হাতে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের অসংখ্য নেতাকর্মী নির্মম হত্যাযজ্ঞের স্বীকার হয়েছে ।

Manual6 Ad Code

বাঙালি সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা বিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পবিত্র ইসলাম ধর্মকে বিকৃত করে এদেশে পাকিস্তানি ভাবধারার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তারা অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠে। কিন্তু বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ হলেও এখানে মৌলবাদের কোন স্থান নেই। এখানকার ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজ উদার অসাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন এবং মানবতায় বিশ্বাসী। একদিকে মহান ভাষা আন্দোলন ও মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ চেতনা অন্যদিকে ফকির, আউলিয়া, দরবেশ, আলেম ও ওলামা সমৃদ্ধ উদার ইসলমিক চিন্তা ধারার দ্বারা প্রভাবিত মুসলিম সম্প্রদায়কে মৌলবাদের ভাবধারায় পরিবর্তিত করা অপচেষ্টা মাত্র। বিধায় তাদের অপচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য । ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে স্বাধীনাতা বিরোধী মৌলবাদী রাজনীতি আজ কোনঠাসা। আগামী দিনে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ডাঃ জামিল আকতার রতনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে বর্তমান ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই জামিলের আত্মা শান্তি পাবে। বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর প্রতিটি নেতা-কর্মীদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি জাতীয়ভাবে ছাত্র সমাজের সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে । শিক্ষার নামে বাণিজ্য বন্ধ, ব্যায়বহুল শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে স্বল্প ব্যয়ে সাধারন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সুযোগ, বৈষম্য দূর করা, গরীব মেধাবী ছাত্রদের শিক্ষা বৃত্তি প্রদান এবং শিক্ষা শেষে কাজের নিশ্চয়তার দাবীতে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করতে বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আর এটাই হবে ডাঃ জামিল আকতার রতনের স্মৃতির প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা প্রদর্শন।

লেখকঃ কমরেড ইয়াসিন আলী
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি
সভাপতি, ঠাকুরগাঁও জেলা ওয়ার্কার্স পার্টি

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code