পুনশ্চ কথোপকথন (পূর্ণেন্দু পত্রী শ্রদ্ধাস্পদেষু)

প্রকাশিত: ২:২৪ অপরাহ্ণ, জুন ৭, ২০২০

পুনশ্চ কথোপকথন (পূর্ণেন্দু পত্রী শ্রদ্ধাস্পদেষু)

Manual6 Ad Code

কমলকলি চৌধুরী, শ্রীমঙ্গল, ০৭ জুন ২০২০ :

–এতোদিন কোথায় ছিলে নন্দিনী?

–তোমাকে কে বলেছে আমি নন্দিনী?

–আমার দেখা মিথ্যে হয় না।
শরীরে একআধটু মেঘের মতো মেদ জমেছে বটে
তবু আমার নন্দিনীর হাসিটি যে তেমনি আছে
দীর্ঘ অদেখায় ম্লান হয়নি মোটে।
আচ্ছা, এবার চলো…

–কোথায়!

–একটা সুন্দর জীবনের পথে,
এতোদিন যা দিতে পারিনি, ভেবেছি কেবল।

–ভেবো না শুধু তুমিই ভেবেছো,
আমিও কি ভাবিনি বলো!
যেদিন কাগজে তোমার কবিতা পড়লাম,
সেদিনই আবার এত দিনকার বন্ধ দুয়ার খুলে দিলাম।
অথচ দেখো, কখনো কি ভেবেছি তুমি কবি হবে!
আমাদের দুজনের দুটো আকাশ হবে?

–না, ভাবিনি, কখনো ভাবিনি, ভাবিনি তোমার
শরীরধোওয়া বৃষ্টিজল আমাকে ছুঁবে না!

–অথচ দেখো, এমনটাই হলো!
আমার আকাশ অচেনা তারার তিমিরে ঢেকে গেলো!
তোমার আকাশ রঙধনু হয়ে রাঙিয়ে দিলো অচেনা আলো!

Manual7 Ad Code

–নন্দিনী, নীলশাড়ি, নীলচুড়ি আর নীলটিপে
তোমাকে বড় অপরূপা লাগছে আজ।

–রূপের আগে অপ জুড়ে দিলে, রূপ যে বেড়ে যায়,
খেয়াল করিনি আগে, অথচ দেখো, অপ তো অপয়া!
সত্যি আমি বড় অপয়া শুভঙ্কর।

–অপয়া নও নন্দিনী, অসহ্য সুন্দর তুমি।
বুকের ভেতর উথালপাথাল ঢেউ তোলো,
পৃথিবীটা ওলটপালট করে দাও!
মেঘ ডাকে না, চেয়ে থাকে চাঁদ,
তারা খসে পড়ে, থেমে যায় হাওয়া!

–তাই বুঝি? হাহাহাহা!
দেখো শুভঙ্কর, কতো বছর পর আমাদের দেখা, তাই না?
অথচ, তুমি এখনো আগের শুভঙ্করই আছো,
আমার শুভঙ্কর! বদলাওনি এতোটুকু!

–তুমিওতো দূরের মানুষ হয়ে যাওনি নন্দিনী!
আসো, আবার আমরা দুজনে মিলে
নতুন করে আঁকি জীবনের জলছবি।

–সব মানুষই এমন চায় শুভঙ্কর।
সতত সুন্দর জীবনের আকাঙ্ক্ষায় কাটায়
বিনিদ্র দিন বিনিদ্র রাত।
মানুষের চাওয়াটাতো অসুন্দর নয়,
কুৎসিত নয় কস্মিনকালেও। কিন্তু…

–কিন্তু?

–কিন্তু একটা সুন্দর জীবনের আকাঙ্ক্ষায়
মানুষের কাজগুলো বড়ই অসুন্দর, কুৎসিত!

–এমন কথা কেনো বলছো নন্দিনী?

–কাগজে তোমার কবিতা পড়ে খুলে দিয়েছি রুদ্ধ দুয়ার!

–খুলে দাও খুলে দাও সব দ্বার, যত দ্বার আজ রুদ্ধ
আলোয় আলোয় ভরে তোলো আজ, জীবনকে করো শুদ্ধ!

–কিন্তু দরজার ওপাশেও একটা জীবন আছে শুভঙ্কর।
আমার জীবন থেকে আলো শুষে আলোকিত হয়েছে যে জীবন!
আমার নিঃশ্বাস থেকে বাতাস লুণ্ঠন করে বেড়ে উঠেছে যে জীবন!
সেইতো এখন জীবনের পরম সত্য।
আমি চাইলেই কি আর অবহেলা করতে পারি তারে?

Manual1 Ad Code

–তুমি কুৎসিতের কথা কী যেনো বলছিলে নন্দিনী?

–দেখো শুভঙ্কর, আমাদের জীবন সুন্দর হোক, তাইতো আমরা চাই?

–হ্যাঁ চাই।

–কিন্তু

–আবার কিন্তু?

–হাহাহাহা! হ্যাঁ আবার কিন্তু।
ভেবে দেখো শুভঙ্কর, দরজার এপাশে
আমরা আমাদের জীবন সুন্দর করতে পারি
কিন্তু, ওপাশের জীবনের কী হবে তবে?
ওপাশটা যে অসুন্দরে ঢেকে যাবে!
সুন্দরের বিপরীতে ওই অসুন্দর বড় কুৎসিত শুভঙ্কর।

Manual1 Ad Code

–সেই অসুন্দরের দায় কি তোমার? নাকি আমার?
নিজেদের জীবন সুন্দর করবো,
এই অধিকারটুকুও নেই আমাদের?

–সে কি আর আমি বুঝিনে বলো।

–কেনো তবে আজ এসব কথা?
অনন্তকালের অদেখার পর
প্রথম দেখার এই উৎসবের দিন
অসুন্দরের স্পর্শে কেনো করছো মলিন!

Manual7 Ad Code

–আমি তোমাকে কেবল
জীবনের দুটো রূপ দেখাতে চেয়েছি শুভঙ্কর।
সত্য আর মিথ্যার মিশ্রণ এ জীবন!
ন্যায় আর অন্যায়ের নিরন্তর লুকোচুরি!
দরজার ওপাশে যে জীবন,
সমাজের কাছে তা-ই সত্য! অথচ,
এর চেয়ে অসত্য আর কী আছে বলো!
আমার সত্য যে সমাজের সত্য নয় শুভঙ্কর,
আমার ন্যায় যে নয় সমাজের ন্যায়!

–“ন্যায় অন্যায় জানি নে জানি নে জানি নে
শুধু তোমারে জানি, তোমারে জানি…”

–হাহাহাহা!
এখনো এখানে সাজানো খেলাঘর
এখনো এখানে ফুল-পাখি-ঘাস
এখনো এখানে অবিরাম সুকান্ত বাতাস!

–হ্যাঁ নন্দিনী, আসো,
আজ আমরা নতুন করে খেলাঘর সাজাই
আজ আমরা ফুল-পাখি-ঘাস হয়ে যাই
হয়ে যাই হাওয়া, মুক্ত আকাশ,
হয়ে যাই নদী, পালতোলা নাও, চাঁদের আলো!
আসো, হাত ধরো নন্দিনী, চলো।

[আধুনিক কাব্যসাহিত্যে সংলাপের মাধ্যমে কবিতার সূচনা রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই। তাঁর ‘বিদায় অভিশাপ’, ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’, ‘গান্ধারীর আবেদন’ এজাতীয় কাব্য। কিন্তু যৌবনে, পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন আমার মতো অনেককেই গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিলো। এরপর অনেকেই এই ধারায় অনেক কবিতা লিখেছেন। কিন্তু পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কথোপকথন’কে অতিক্রম করতে পারেননি। তাই ভাবলাম, এই ধারায়ই যদি লিখবো, তবে ‘শুভঙ্কর-নন্দিনী’ই বা নয় কেনো। এটা সেই ‘কথোপকথন’-এর বিস্তার হিসেবেই ধরে নেয়া যায়। এর পাত্র-পাত্রী এক, কিন্তু গল্প আলাদা।]

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code