তখন সিনেমা: আজিমপুরের পথ খুঁজছিলেন জাফর ইকবাল

প্রকাশিত: ১১:১০ পূর্বাহ্ণ, জুন ৮, ২০২০

তখন সিনেমা: আজিমপুরের পথ খুঁজছিলেন জাফর ইকবাল

Manual3 Ad Code

ফজলুল বারী, সিডনি (অস্ট্রেলিয়া), ০৮ জুন ২০২০ : আমরা যখন সিনেমা দেখতাম আমাদের সময়ের সিনেমার আধুনিক আইকন নায়কটির নাম ছিল জাফর ইকবাল। ঢাকার ছবিতে তখন বেশ কয়েকজন নায়ক-নায়িকাকে ঘিরে নানান ধারার সিনেমা বানানো হচ্ছিল।

Manual5 Ad Code

রাজ্জাক-কবরী জুটির প্রতিষ্ঠায় লগ্নী পুজির মাথায় উত্তম-সূচিত্রা জুটির কথা ছিল। রূপবান ছবির সাফল্যের পর আজিম, জাভেদ, ওয়াসিম সহ কয়েকজন নায়ক হন ফোক চলচ্চিত্রের।
‘মালকাবানুর সাতটি ভাই অভাগা মনু মিয়ার কেহ নাই’ তখন বিপুল দর্শক প্রিয় ছবির গানের ভাষা! নিশান ছবির সাদা-কালো জমজ চরিত্রের জাভেদ তখন সুপার ডুপার হিট ছবির নায়ক!
‘আবার তোরা মানুষ হ’, বা ‘আলোর মিছিল’এর ফারুকের খোলনলচে পাল্টে ফেলা হয় ‘লাঠিয়াল’ ‘সুজনসখী’ ‘সারেং বৌ’ বা ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র গ্রামীন চরিত্রে। যে নায়ক গোলাপীর বিয়ে ভেঙ্গে দিতে তাঁর যৌতুকের সাইকেল চুরি করে!
অথবা রাতের বেলা সখীর সঙ্গে গোপনে দেখা করতে গেলে ‘দাদিরে ডাকুম?’ বলে শাসানি শুনতে হয় নায়িকার। রাজ্জাকের ছায়া হয়ে আসা উজ্জল-আলমগীরের তখন নিজের আলাদা স্বাতন্ত্র গড়ার সংগ্রাম পর্ব চলছে।
তখন একজন আলাদা ধাচের নায়ক হিসাবে আগমন ঘটে জাফর ইকবালের। বাংলাদেশের সিনেমার নায়কদের অনেকে আধুনিক হবার নানান সংজ্ঞা খোঁজেন। অথবা তাদের কাউকে কাউকে নিজেকে দাবি করে বলতে হয় ‘আমি আধুনিক’!
কিন্তু জাফর ইকবালকেই শুধু আলাদা করে আধুনিক দাবি করতে হয়নি। তাঁর চেহারা, পোশাক-পরিচ্ছদ, ফ্যাশন সচেতন এপ্রোচ সবকিছুই তাঁকে আলাদা করে নেয়। বাড়তি যোগ্যতা তাঁর গান।
আসলে ঢাকার সংস্কৃতি জগতে প্রথমে তিনি গিটার হাতে গায়ক হিসাবেই পরিচিতি পান। কারন একটি সঙ্গীত পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল। বড়ভাই সঙ্গীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজ। ছোটবোন শাহনাজ রহমত উল্লাহ। তখন শাহনাজ বেগম।
১৯৫০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জন্ম। ষোল বছর বয়সে বন্ধু ফারুক, তোতা, মাহমুদকে নিয়ে গড়ে তোলেন গানের দল ‘রোলিং স্টেশন’। ফ্যাশনে কেতা দূরস্ত তাঁকে বলা হতো বাংলার এলভিস প্রিসলি।
রাজ্জাক অভিনীত ‘বদনাম’ ছবিতে তাঁর গাওয়া ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও আমিতো এখন আর নই কারও’ তাকে বদনাম নয় সুনাম দিয়েছে। অতঃপর সেই গায়কই চলচ্চিত্রের হার্টথ্রব নায়ক।
তিনিই আমাদের ক্ষনজন্মা জাফর ইকবাল। ঢাকার সিনেমার নায়কদের অনেকে বয়স পড়তিতে পার্শ্ব চরিত্রে তাদের রুটিরুজির সংগ্রাম করেছেন। এই একজন রূপালী তারার দেশের চিত্র নায়ক জাফর ইকবালকেই সে কসরত করতে হয়নি।
বিয়োগান্তক ছবির নায়কের মতো বাস্তবেও অনন্তযাত্রা করেন আমাদের সময়ের নায়ক জাফর ইকবাল। তাই তাঁর কথা ভাবতেই আমাদের মানসপটে একজন আধুনিক নায়কের মুখই শুধু ভাসে। চোখ ঝাপসা হয়।
তিনিই আমাদের গল্পের রাজকুমার। মুক্তিযুদ্ধের আগে খান আতার ছবি ‘আপন পর’ এর মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসেন জাফর ইকবাল। নায়িকা ছিলেন কবরী। ১৯৬৯ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। এরপর চলেন যান মুক্তিযুদ্ধে।
পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েন। ভাইকে বাঁচাতে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে ছুটে গেলেন শাহনাজ রহমত উল্লাহ। সে আরেক কান্নার কাহিনী। ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’ গানের গায়িকাকে এরজন্যে আজন্ম কথা শুনতে হয়েছে।
এস এম সামাদের ‘সূর্যগ্রহন’, ‘সূর্য সংগ্রাম’ ছবিতে ববিতা তাঁর নায়িকা হয়ে আসলে বদলে যায় জাফর ইকবালের ক্যারিয়ার। ‘হারজিৎ’, ‘ফকির মজনু শাহ’, ‘এক মুঠো ভাত’ সহ তিরিশটির মতো ছবিতে এ জুটিকে অভিনয় করতে দেখা গেছে।
তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক হয়েছিল, সম্পর্কটি ভেঙ্গে যাবার পর জাফর ইকবাল অসুস্থ হয়ে পড়েন এসব প্রচারনাও আছে। বলা হয় জাফর ইকবালের হিট গানগুলোও প্রেমিকা ববিতাকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া।
‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী, হয়েও কারও ঘরনী, ‘এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কি আছে’ এসব গান তিনি নাকি ববিতাকে উদ্দেশ্য করেই গেয়েছেন। ‘নন্দিনী’, ‘হৃদয়হীনা’র বিয়ে হয়ে যাবার পর অবশ্য জাফর ইকবালও বিয়ে করেন।
তাঁর স্ত্রী হন সোনিয়া জাফর। তাদের দুটি ছেলে রয়েছে। কবরী, শাবানা, চম্পা, দিতি, রানী সহ সব নায়িকার বিপরীতেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন এই নায়ক। কিন্তু ভক্ত দর্শকদের হৃদয় মনিকোঠায় স্মৃতি হয়ে আছে শুধু ববিতা-জাফর ইকবালের ছবি।
‘মাস্তান’, দিনের পর দিন, ‘বে-দ্বীন’, ‘অংশীদার’, ‘আশীর্বাদ’, ‘অপমান’, পরিবর্তন’, ‘সিআইডি’, ‘প্রেমবিরহ’, ‘ফুলের মালা’, ‘অবুঝ হৃদয়’, ‘নয়নের আলো’ সহ দেড়শ ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন।
কুমার বিশ্বজিৎ ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কুমার বিশ্বজিৎ এক স্মৃতিচারনায় বলেছেন, ‘জাফর ইকবাল দারুন স্মার্ট ছিলেন। শুধু পোশাকে-আশাকে না, ওর রূচিবোধ, ইন্টেলেকচুয়াল হাইট, ফ্যাশন সচেতনতা সবই ছিল নজরকাড়ার মতো।
কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, এই অঙ্গনে আর কারও মধ্যে এ রকম দেখিনি। আমি নিজে দেখেছি তাঁর তিনশ রকমের জুতার সংগ্রহ। জুতার সঙ্গে মিলিয়ে ড্রেস পরতেন। এখনকার কোনো নায়কের মধ্যেও এমন ফ্যাশনসচেতনতা আছে কি না জানিনা’।
ব্যক্তি জাফর ইকবাল খুব অভিমানী, আবেগ প্রবণ, বোহেমিয়ান প্রকৃতির ছিলেন। সিনেমায় তাঁর পরিচালকরাও তাঁকে দিয়ে সে রকম বেশি বেশি শহুরে চরিত্রে অভিনয় করিয়েছেন। এরজন্য জাফর ইকবাল অভিনয় করছেন এটিই অনেকের মনে হতোনা।
মনে হতো এটিই বুঝি পর্দার বাইরের মানুষ জাফর ইকবাল। এই চির সবুজ নায়ক বেঁচে থাকতে তাঁর সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির নাম ‘লক্ষীর সংসার’। ছবির একটি দৃশ্য গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে আজিমপুর যাবার পথ খুঁজছেন জাফর ইকবাল।
ছবির একটি সংলাপ ছিল ‘ভাই আজিমপুর যাব কীভাবে’। ওই ছবি মুক্তি পাবার এক মাসের মধ্যে রোগে শোকে ভোগে জাফর ইকবাল মারা যান ১৯৯২ সালের ৮ জানুয়ারি। বাংলাদেশের অনেক মানুষ সেদিন হাউমাউ করে কেঁদেছেন।
এভাবে এক হৃদয়হীনার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে, ভালোবাসার নন্দিনী অন্য কারও ঘরনীকে সুখে থাকতে বলে মাত্র ৪১ বছর বয়সে ‘লক্ষীর সংসার’ ছেড়ে শুরু হয় তাঁর অনন্ত যাত্রা।
আজিমপুর গোরস্তানেই শেষ শয্যা হয়েছে তাঁর। লক্ষীর সংসারের নায়কের ঢাকায় এসে আজিমপুর যাবার পথ খুঁজতে ‘ভাই আজিমপুর যাব কীভাবে’ সংলাপটিও তখন ভক্তদের অনেককে কাঁদিয়েছে। ভালো থাকবেন জাফর ইকবাল।

Manual2 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code