মওলানা ভাসানীর আমন্ত্রণে কাগমারী সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতীয় সাংস্কৃতিক যে প্রতিনিধি দল এসেছিলেন

প্রকাশিত: ১১:৪১ পূর্বাহ্ণ, জুন ১২, ২০২০

মওলানা ভাসানীর আমন্ত্রণে কাগমারী সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতীয় সাংস্কৃতিক যে প্রতিনিধি দল এসেছিলেন

Manual2 Ad Code

অাজাদ খান ভাসানী, ১২ জুন ২০২০ : মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আমন্ত্রণে ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাগমারী সম্মেলনে যোগ দিতে যে ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল আসে তাতে ছিলেন দলনেতা হুমায়ুন কবির, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার স্যানাল, নরেন্দ্র দেব, রাধারানী দেবী, কাজী আবদুল ওদুদ প্রমূখ। সম্মেলনের আয়োজন দেখে তাঁরা আক্ষরিক অর্থেই বিস্মিত হন। প্রবোধকুমার স্যানাল তাঁর ভাষণে বলেছিলেন: ‘এখানকার সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের মধ্যে আমি প্রাণের অভিব্যক্তি দেখেছি। সম্মেলনের আশপাশে যে সভা দেখেছি তা অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর। এই সার্থকতার ব্যাকুলতা, স্নেহ ও বন্ধুত্ব, মৈত্রী ও সাম্যের প্রতি অনুরাগের বাঙালি-প্রাণের এত বড় আয়োজন আর কোথাও দেখিনি। পূর্ববাংলা আজ এক আদর্শ মিলন-মোহনায় পরিণত হয়েছে। এখানে এসে এই মিলন মোহনায় অবগাহন করলাম।

ভাষা-আন্দোলনের পাঁচ বছর পর অনুষ্ঠিত সেই সম্মেলনে তারাশঙ্কর তাঁর ভাষণে বলেন: ‘মাতৃভাষা ও সাহিত্যের জন্য রক্তদানের দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। পূর্ববাংলার মানুষ এই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, আমরা পূর্ববাংলার মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’

তারাশঙ্কর ছিলেন একজন অবিচল গান্ধীবাদী, গান্ধীর অহিংস নীতির প্রতি তাঁর ছিল পূর্ণ সমর্থন। তাঁর গল্প-উপন্যাসে গান্ধীর চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি তাঁর ভাষণে আরো বলেন: ‘অহিংসা ও সততার বাণী বুকে নিয়ে সংস্কৃতির যুক্ততীর্থে আমাদের দীর্ঘ যাত্রা পথ। সেই স্বপ্নের রাজ্যে পৌঁছাতে পারলেই আমাদের সংস্কৃতি-সাধনার সার্থকতা।’

কাগমারী সম্মেলনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্যরা দেশে গিয়ে লেখালেখি করেন এবং সভা-সমাবেশে বলেন, আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে থেকে তাঁদের কথিকা প্রচার করা হয়। সেগুলোর কিছু বেতার-জগৎ-এ প্রকাশিতও হয়। তারাশঙ্কর তার সফরের অভিজ্ঞতা অন্নদাশঙ্কর রায় ও অন্যান্যকে বলেন। সে-সম্পর্কে অন্নদশংকর বহু পরে- তারাশঙ্কর ও মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর- কিছু লিখেছেনও। ১৯৯০-এর দশকে অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে সে-সম্পর্কে আমার কথা হয়। তারাশঙ্কর যা বলেছেন তা এরকম: একদিন সন্ধ্যার আগে মওলানা তারাশঙ্করকে নিয়ে হাঁটতে বেরোন। মওলানার সঙ্গে তাল রেখে হাঁটা প্রবীণ কথাশিল্পীর পক্ষে কষ্টকর ছিল। তাঁরা গ্রামের ভেতর দিয়ে কাঁচা রাস্তায় হাঁটছিলেন। মাঝে মাঝে দু’পাশের বাড়িঘর থেকে কেউ এসে মওলানাকে পা ছুঁয়ে সালাম করছিল। হিন্দুরাও প্রণাম করছিল। দুয়েকটি জনপদ দেখিয়ে মওলানা বললেন, এই গ্রামে ওইসব বাড়িতে কয়েক ঘর হিন্দু ছিল। কয়েক বছর আগে তারা বাড়িঘর মুসলমানদের কাছে বিক্রি করে ভারতে চলে গেছে।

বাংলাদেশের বহু গ্রাম থেকেই যে অনেক হিন্দু পরিবার চলে গেছে সে সংবাদ তারাশঙ্করের অজানা ছিল না। কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ মওলানা এক গ্রামে দাঁড়ালেন। বললেন, ব্যানার্জি বাবু এখানে এসে একটা স্মৃতি মনে পড়ছে।

তারাশঙ্কর বললেন, কি স্মৃতি?

মওলানা বললেন, এই গ্রামে অনেক ঘর হিন্দু ছিল। এখানে কোনো কোনোদিন সন্ধ্যার পর খোল-করতাল বাজিয়ে কীর্তন হতো। নানান উপলক্ষে কোনোদিন সারারাত কীর্তন ও নাম-সংকীর্তন গাওয়া হতো। তখন গ্রামগুলোতে একটা প্রাণ ছিল। হিন্দুরা চলে গেল। সেই কীর্তন আর শোনা যায় না। প্রাণহীন হয়ে গেছে পল্লীগুলো।

হতবাক হয়ে যান তারাশঙ্কর। মওলানা বলেন কি? কোনো মাওলানাকে এই প্রথম কীর্তনের প্রশংসা করতে শুনলেন তিনি। এ ধরনের মওলানা যেখানে আছেন সেখানে তো কোনো সাম্প্রদায়িক গোলযোগ হতেই হতেই পারে না। টাঙ্গাইলে সে-রকম কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা কিছু হয়ওনি, তবু ভয়ে হিন্দুরা চলে যায়।

হেঁটে এসে সন্তোষ জমিদারবাড়ির নাটঘরে তাঁরা একাকী কাটান কিছুক্ষণ। তখন ভাসানী তারাশঙ্করকে বলেন: ব্যানার্জি বাবু, আপনি তো কংগ্রেস করেন। পন্ডিত নেহেরুর সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনার কথাবার্তা হয়। তাঁকে আমার কথা বলবেন যে, আমি বলেছি যে সব হিন্দু ভয়ে দেশ ত্যাগ করে চলে গেছে তারা আবার ফিরে আসুক। তাদের ফেরত আসার ব্যবস্থা যদি ভারত-পাকিস্তান সরকার করে আমি তাতে পূর্ণ সমর্থন দেবো। রাজনৈতিক-সামাজিক শান্তির স্বার্থে উপমহাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর করা দরকার। সাম্প্রদায়িকতা দূর না হলে তুই দেশের অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি হবে।

Manual1 Ad Code

মওলানা বলেন, কাশ্মীর সমস্যার মীমাংসা করা প্রয়োজন। এখন সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী, তিনি ও নেহেরু ব্যক্তিগত পর্যায়ে বন্ধু। তাঁদের পক্ষে উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। যদিও দুই দেশেই শাসক দলে বহু সম্প্রদায়িক নেতা আছেন যারা সমস্যা জিইয়ে রাখতে চান।

Manual3 Ad Code

তারাশঙ্কর কলকাতায় গিয়ে এ প্রসঙ্গে অন্নদাশঙ্করকে কে বললে অন্নদাশঙ্কর তাঁকে বলেন, মওলানার সঙ্গে তাঁর হিন্দুদের প্রসঙ্গে অথবা কাশ্মীর বিষয়ে যেসব কথাবার্তা হয়েছে তা যেন তিনি আর কারো সঙ্গে আলোচনা না করেন। এসব কথা দুই দেশের সরকারি লোকরা জানলে ওদিকে ‘ভাসানী সাহেবের জান যাবে, এদিকে আপনাকে অনেকে সন্দেহের চোখে দেখবে। এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে থাকুন।’

তারাশঙ্কর তাঁর বন্ধুর পরামর্শ শুনেছিলেন।

তারাশঙ্কর তাঁকে বলেছিলেন, মওলানা সম্পর্কে কত দুর্নাম শুনেছি। কয়েকদিন কাছে থেকে দেখে বুঝতে পারলাম ওসবের কোনো সত্যতা নেই। প্রতিপক্ষ অনেক কিছু রটায়, তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে। আসলে তিনি সোজা-সরল ধরনের মানুষ। রেখেঢেকে মেপেবুঝে কথা বলতে জানেন না। মনে যা ভাবেন তাই মুখে তাই বলে ফেলেন। খোলামেলা মানুষ। তাতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তাছাড়া তিনি মাটির মানুষের একেবারে কাছে আছেন। তাদের সুখ-দুঃখ-অনুভূতি তিনি ভাল বোঝেন, যা উপমহাদেশের আর কোন নেতা অনুভব করতে পারেন না। ভাসানীর রাজনীতি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের রাজনীতি- প্রথাগত রাজনীতির সঙ্গে যার কোনো মিল নেই।

অন্নদাশঙ্কর ভাসানীকে নিয়ে লিখেছেন একটি চমৎকার ছাড়া। ছড়াটির প্রথম দুই পঙতি হলো:

Manual3 Ad Code

মহান নেতা ভাসানী
ভারতকে দেন শাসানি।

[ভাসানী কাহিনী, পৃষ্ঠা: ৪৯]

Manual7 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code