আমার শৈশবের ঈদের স্মৃতি: একান্তই চুটকি পিঠার অধিক স্বাদ নয়; তথাপি অপার আনন্দের!

প্রকাশিত: ১:৩১ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ৩০, ২০২৫

আমার শৈশবের ঈদের স্মৃতি: একান্তই চুটকি পিঠার অধিক স্বাদ নয়; তথাপি অপার আনন্দের!

Manual7 Ad Code

শরীফ শমশির |

আমার শৈশবের ঈদের স্মৃতি একান্তই গ্রামীণ। এখন আমি ষাটোর্ধ। বয়স একটা সংখ্যা মাত্র হলেও সামাজিক রাজনৈতিক হিসেবে প্রাচীনের দলে পড়ি। কারণ এই বয়সে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজের।
কদিন আগেও বাংলাদেশকে একটা গ্রাম বলা হতো কিন্তু এখন তা গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে অর্থাৎ বাংলাদেশের গ্রাম এখন বৈশ্বিকভাবে যুক্ত। যেমন, প্রবাস থেকে গ্রামে রেমিট্যান্স আসছে, গ্রামের ঈদের আনন্দকে বাড়িয়ে দিচ্ছে, আবার প্রবাসী সন্তান বা পরিবার একদিন আগে ঈদ করছে ; ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে গ্রীনিস সময় অনুসরণ করে। অন্য দিকে, ঈদের প্রাক্কালে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর থেকে যে পরিমাণে মানুষ গ্রামে যায় তাতে মনে হয় ঈদের আনন্দ সেখানেই সম্পূর্ণ হয়। আর শহরের ঈদের আনন্দ তার আদি বাসিন্দাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ভাড়াটে বাসিন্দাদের সামাজিক আনন্দ সীমিত।
আমার জন্ম গন্ডগ্রামে। পুকুরের জল ফিটকিরি দিয়ে স্বচ্ছ করে পান করতে হতো। খুব ভোরে বা সন্ধ্যায় এই পানি সংগ্রহ করতে হতো, নারীদের। পুরুষদের গোসলের আগে বা যখন সন্ধ্যার পর পানি থিতু হতো। এই পুকুরের পানি সংগ্রহের সাথে নারীদের পর্দা মানারও সম্পর্ক ছিল। এছাড়া, হারিকেন ও কুপি ছিল রাতের আলো, তাই পূর্ণিমার জোছনার আলোর মূল্য ছিল। বর্ষায় কাদা, শীতে ছেঁড়া কাঁথা বা আত্মীয় আসলে ভালো খাবার – এর মধ্যেই জীবন চক্রাকারে ঘুরতো। তবে, সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন আনন্দ বেদনার মধ্যে ছিল।
আমি প্রথম বিজলি বাতি দেখি মহেশখালী দ্বীপে। সেখানে সন্ধ্যার পর থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত সীমিত পরিসরে জেনারেটরের আলো বাজারটা আলোকিত করে রাখতো। টমাস আলভা এডিসনের নাম তখনো শুনিনি। এটা ছিল ১৯৬৯,১৯৭০-১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। এই সময় সামাজিক রাজনৈতিক ঘটনার আবর্তে ঈদের স্মৃতি তেমন আমার মনে নেই। ১৯৭৩-৭৪ সালে একপ্রকার খাদ্যাভাব চলছিল। নিম্ন চাকরিজীবীর সন্তান এবং অনেক ভাই বোন থাকায় ঈদুল ফিতরের সময় কিছু আনন্দ থাকলেও ঈদুল আজহা ছিল বেশ প্রতিকূল। কোরবানির সামর্থ্য না থাকলে অদ্যাবদি গ্রামীণ পরিবারে আনন্দ তেমন থাকে না। সামর্থ্যবানদের বাড়ি গিয়ে মাংসের স্বাদ নেওয়া তেমন সুখকর ও সম্মানজনক ছিল না। তাই ঈদুল ফিতর আমার স্মৃতিতে আনন্দের পরিমাণ একটু বেশি দিতো।
আমি যদি শৈশবকে টেনে একটু এইচএসসি পর্যন্ত টানি তাহলে গ্রামে আমার ঈদ অভিজ্ঞতা বেশ হয়েছে। এরমধ্যে নানা গ্রামের অভিজ্ঞতা থাকলেও নিজ গ্রামের অভিজ্ঞতা বেশ স্মরণযোগ্য।
যেমন, সকালে পুকুরে খুশবু সাবান দিয়ে গোসল করা, নতুন লুঙ্গি ও শার্ট পড়া, পাজামার অভ্যাস আমার ছিল না কারণ তার নেয়ার বা সুতা গিঁট দিতে গিয়ে বিপদে পড়তাম। একবার গিঁট দিলে তা আর খুলতে পারতাম না। এটা একটা অস্বস্তি তৈরি করতো।
তারপর সমবয়সী বা ঘনিষ্ঠদের সাথে ঈদগাহ যাওয়ার প্রস্তুতি। ঈদগাহ একটু দূরে। বিশাল ধানক্ষেতের মাঝে, সামিয়ানা টাঙানো। ডাক আসতো, মাইকে, আর বেশি দেরি নেই। আমরা প্রস্তুত থাকলেও কৃষির সাথে জড়িতরা তাঁদের হাতের প বিলের কাজ সেরে ঐ ডাকের পর দৌড়ে রওয়ানা দিতেন : তাদের অনেকেই ময়দানে যাওয়ার আগে রাস্তায়ও মোনাজাত ধরতেন কারণ তখন নামাজ প্রায় শেষ।
আমাদের গ্রামের ঈদগাহ, শুনেছি একজন হিন্দু মহাজনের দেওয়া, তাঁকে আমি দাদা ডাকতাম। আবদুল করিমের গানের মতোই তখন হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির সাথে বসবাস করতেন। আমি সেই সম্প্রীতি দেখেছি।
ঈদ নামাজে শুধু নিজেদের মসজিদ নয় অন্যান্য মসজিদের জন্যও চাঁদা দিতে হতো। তারপর কোলাকুলি। ঈদের সালামী কখনো সব মিলিয়ে একটাকার বেশি পাওয়া যেতো না কারণ তখনো পয়সার চল ছিল। টাকা পেলেও লাভ নেই, দোকানে আইসক্রিম ছাড়া তেমন কিছু ছিল না। কমদামি চকলেট – এসব আরকি।
তবে হ্যাঁ, দল বেধে প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে সারাদিন ঘুরতে পারতাম। আত্মীয়, অনাত্মীয় ভেদাভেদ ছিল না।
খাবারের মধ্যে চুট্টি পিঠা বা হাতে বানানো পিঠার সাথে, দুধ নারিকেল ও চিনি বা গুড় মাখানো। জানতাম না, লাচ্ছি সেমাই কি? পিঠার মধ্যেও ধনী দরিদ্র ছিল ; বানানোর উপাদানের তারতম্যে তা বুঝা যেতো।
সকলের মনে সম্প্রীতি ছিল। ধনী দরিদ্রের পার্থক্য ঈদের দিন বাজার বা হাটের চায়ের দোকানে অনেকটা কমে আসতো। আনন্দ ছিল অপার, সাম্য ছিল, সামাজিকতা ছিল। কিছু সমস্যা থাকতো না তা নয় কিন্তু শিশু কিশোররা তার বাইরে ছিল। ধর্মীয় এই উৎসব চলতো, সেলাই করা জামায়। ঈদের দিন সকালেও এই জামা পাওয়া যেতো। ছেলেদের আনন্দ ছিল বাইরে ঘুরতে যাওয়া, মেয়েদেরও আনন্দ ছিল সব বাড়িতে যাওয়ার, রঙিন জামা আর রঙিন হাতে।
গ্রাম ছিল গ্রামের মতোই ; প্রতিটি ঘর চুট্টি পিঠা ও চাইন্না পিঠার সুবাসে ভরা। এই সুবাস এখনো গোলাপের ঘ্রাণের মতো হৃদয়জুড়ে আছে।
নগরের প্রান্তিক মানুষ হিসেবে ঈদ মানে এখনো খুশবু সাবান ও চুট্টি পিঠার স্বাদ। সব বদলে গেছে ; বদলায়নি স্মৃতির অমৃত স্বাদ।
সকলের প্রতি ঈদের শুভেচ্ছা।

Manual8 Ad Code

#
শরীফ শমশির
লেখক ও গবেষক

Manual7 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code