আঞ্চলিক ভাষার অভিধান সম্পাদনায় বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

প্রকাশিত: ১:০৫ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১, ২০২৫

আঞ্চলিক ভাষার অভিধান সম্পাদনায় বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

Manual3 Ad Code

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান সম্পাদনার কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রাতঃস্মরণীয় বহুমাত্রিক পন্ডিত, বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ওইকাজের জন্যই তিনি বাংলা একাডেমীতে যোগ দিয়েছিলেন, এর ৬৫ বছর পূর্ণ হয়েছে এবার।

১৯৬০ সালের ১ জুলাই বাংলায় আঞ্চলিক ভাষাসমূহের অভিধান সম্পাদনার জন্য তিনি বাংলা একাডেমীতে যোগদান করেন।

১৯৬৫ সালে বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান (পরবর্তী নাম বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান) এক ঐতিহাসিক অবদান বটে। এই কীর্তির নেতৃপুরুষ ছিলেন নানা বিদ্যা ও ভাষায় অতুলনীয় পাণ্ডিত্যের অধিকারী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। তিনি নেতৃত্ব না দিলে এ ধরনের একটি বিশাল, জটিল ও শ্রমসাধ্য সূক্ষ্ম পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজ করা সম্ভব হতো কি না, বলা মুশকিল। ড. মুহম্মদ এনামুল হক, মুহাম্মদ আবদুল হাই, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. কাজী দীন মুহাম্মদ প্রমুখ ভাষা বিশেষজ্ঞকে উপদেষ্টা করে এ কাজটি তিনি দক্ষ হাতে সম্পন্ন করেন। পূর্ব পাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আত্মপ্রকাশ করলেও ড. শহীদুল্লাহ্ আঞ্চলিক ভাষার এই অভিধানের মাধ্যমে বাংলা ভাষা-সাহিত্য এবং বাঙালি জীবনের স্বকীয় চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যকেও এর মাধ্যমে ধারণ করার একটি দূরদর্শী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কারণ, এই অভিধানে তাঁর ভূমিকায় বাংলা, বাঙালিত্ব এবং এ অঞ্চলের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রাচীন সাহিত্যে ‘বাংলা’ বা ‘বঙ্গাল’ নাম কোথায় কোথায় পাওয়া গেছে, সেগুলোই তিনি বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন। সেই পটভূমিকাতেই তিনি পশ্চিম ও পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য নির্ধারণের প্রয়াস পেয়েছেন। অতি সংক্ষেপে উপমহাদেশের এই অঞ্চলের বাংলা ও বাঙালির গুরুত্বও তুলে ধরেছেন। তিনি যা বলেছেন, তাতে বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চল প্রাচীনকালে বৌদ্ধ ধর্মের লীলাভূমি ছিল। এই বিষয়টি ময়নামতি, মহাস্থানগড় ও পাহাড়পুরের সভ্যতার উল্লেখ করে বোঝাতে চেয়েছেন। তিনি এ কথাও বলেছেন, বৌদ্ধ রাজারা দেশীয় ভাষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সংস্কৃতেরও বিরোধী ছিলেন না। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গ বা রাঢ় দেশে প্রথমে সুর রাজবংশ এবং পরে সেন রাজবংশ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিল। সে জন্য তারা দেশি ভাষাকে অবজ্ঞা করত, উৎসাহ দিত সংস্কৃত ভাষার চর্চা ও বিকাশের। এ কারণে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের সূচনা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ বা প্রাচীন রাঢ় বঙ্গে হয়নি। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশ অর্থাৎ বরেন্দ্র এবং বঙ্গ—যাকে একসময় পূর্ববঙ্গ এবং বর্তমানে বাংলাদেশ বলা হয়, সেখানেই হয়েছে। বাংলা ভাষার এই উৎস মুসলমানদের এ অঞ্চল অধিকারের আগেই। ১৩৩৭ খ্রিষ্টাব্দে আমির খসরু দেশীয় ভাষাগুলোর মধ্যে গৌড় ও বঙ্গালের নাম উল্লেখ করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায়ের বাংলা ব্যাকরণের নাম ছিল গৌড়ীয় ভাষার ব্যাকরণ। সে বিষয়টিও বিশেষভাবে অনুধাবন করার মতো। ‘বঙ্গাল’ শব্দটি রাজেন্দ্র চোলের একাদশ শতকের শিলালিপিতে ব্যবহৃত হয়েছে। এই বঙ্গাল দেশের রাজার নাম ছিল ‘গোবিন্দ চন্দ্র’। তিনি চন্দ্র বংশীয় রাজা ছিলেন। অতএব ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, প্রাচীন বাংলা ভাষার উদ্ভব বর্তমান বাংলাদেশ বা তৎকালীন প্রাচীন বঙ্গের বরিশাল, ফরিদপুর বা তৎসংলগ্ন অঞ্চলে। নাথ যোগীদের সাহিত্য এ অঞ্চলে সূচনা হয় বলে মনে করা যেতে পারে। দুই বাংলা একাডেমী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সম্পাদনায় এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে যে হাত দিয়েছিল, তার মূল লক্ষ্য ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলা ভাষার আদর্শ অভিধান রচনার সূত্রপাত করা। আগে যেসব বাংলা অভিধান রচিত হয়েছিল, তাতে এভাবে মূল থেকে বাংলা ভাষার অভিধান রচনার কাজ করা হয়নি। অতএব বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে এই কাজের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল অসাধারণ। কাজটি শেষ করে বাংলা একাডেমী একটি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান প্রণয়নের কাজেও হাত দেয়। আগে আঞ্চলিক ভাষার অভিধান-এর কাজটি করে নেওয়ার ফলে ব্যবহারিক অভিধান একটি মৌলিক ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে—এটাই ছিল সেকালে পূর্ব বাংলার পণ্ডিতদের পরিপক্ব বোধ। কিন্তু এই কাজ তো সহজ ছিল না। পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের উপভাষার মধ্যে পার্থক্য অনেক। বলা চলে, পশ্চিম বাংলায় একটি বিরাট অঞ্চলে প্রায় একই রকম কথ্যভাষা তখন গড়ে উঠেছে। প্রধানত নদীয়ার ভদ্রলোকের ভাষাকে অবলম্বন করে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, হুগলি, বর্ধমান—এইসব শহর অঞ্চলের শিক্ষিতজনের মধ্যে কথ্য বুলিতে খুব ফারাক ছিল না। বোধগম্যতার ক্ষেত্রেও তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু পূর্ব বাংলা এদিক থেকে একেবারেই আলাদা। পূর্ব বাংলায় বিশেষ কোনো অঞ্চলের ভাষাই সাধারণ ভাষার রূপ পরিগ্রহ করেনি। তা ছাড়া সিলেট, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী এমনকি বরিশাল অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গেও যে বিশাল পার্থক্য, তাতে এখানে একটি সমধর্মী বা ইউনিফর্ম ভাষা শিক্ষিত লোকেদের মধ্যেও প্রচলিত নাই। সহসা এমনটি হবে, এ রকম সম্ভাবনাও নাই। সে কারণেই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত আপাত বিভিন্ন ভাষারূপের প্রকৃতি নিরূপণ ও প্রবহমানতা বিশ্লেষণ করার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, এটি অনুপুঙ্খভাবে করা গেলে বাংলাদেশের ভাষার মূল প্রবণতাগুলো বোঝা সম্ভব হবে এবং তারই ভিত্তিতে একটি আঞ্চলিক ভাষার অভিধান করা যথাযথ। এই আঞ্চলিক ভাষার অভিধানের ওপর ভিত্তি করেই একটি ব্যবহারিক অভিধান রচনা করা সমীচীন হবে। কারণ নতুন ব্যবহারিক অভিধানে আঞ্চলিক ভাষার অন্তর্ভুক্তিতে অভিধান সমৃদ্ধ হয় এবং এক অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা অনেক অঞ্চলের কাছে গৃহীত হয়ে থাকে। শহীদুল্লাহর এই প্রয়াসটি ইতিহাসবোধসম্পন্ন এবং ভাষা বিকাশের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও প্রবহমানতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। সেই বিবেচনায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আঞ্চলিক ভাষার অভিধান শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বঙ্গদেশের জন্যই এক মূল্যবান কীর্তি। এসব দিক বিবেচনা করেই বাংলা ভাষার অসামান্য পণ্ডিত ও ঐতিহাসিক ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আঞ্চলিক ভাষার অভিধানকে তাঁর ‘ম্যাগনাম ওপাস’ বা ‘মহাগ্রন্থ’ বলে আখ্যাত করেছিলেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এই আঞ্চলিক ভাষার অভিধান গত শতাধিক বছরের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সম্পদই শুধু নয়, দিকনির্দেশক মহাগ্রন্থও বটে।

আঞ্চলিক ভাষার অভিধান বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপভাষার একটি সংকলন গ্রন্থ। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সম্পাদনায় ১৯৬৫ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষাসমূহের সংকলন-জাতীয় গ্রন্থ এটিই প্রথম। বাংলা ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ নিয়ে প্রথম গবেষণার পরিচয় পাওয়া যায় গ্রিয়ারসনের The Linguistic Survey of India (১৯০৩-১৯২৮) নামক গ্রন্থে। এর প্রথম খন্ডে বাংলাদেশের উপভাষা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের আঞ্চলিক অভিধান রচনার প্রথম প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন এফ.ই পার্জিটার তাঁর Vocabulary of Peculiar Vernacular Bengali Words (১৯২৩) নামক গ্রন্থের মাধ্যমে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষাসমূহের একটি সংকলন প্রকাশ করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয় এবং এ উদ্দেশ্যে বাংলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে তিন খন্ডে সমাপ্য একটি অভিধান প্রণয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ১৯৫৮ সালের প্রথম দিকে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয়, সাময়িক পত্রিকা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের নিকট আবেদনপত্র প্রেরণের মাধ্যমে শব্দ সংগ্রহ করা হয়। ঢাকা, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, খুলনা, পাবনা, সিলেট, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, রংপুর, যশোর, বাখেরগঞ্জ, বগুড়া, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, নোয়াখালী, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও করাচি অঞ্চল থেকে ৪৫৩ জন সংগ্রাহকের মাধ্যমে মোট ১,৬৬,২৪৬টি আঞ্চলিক শব্দ সংগৃহীত হয়। সংশোধন ও বিচার-বিবেচনার পর এ থেকে প্রায় পঁচাত্তর হাজারের মতো শব্দ সংকলনের জন্য গৃহীত হয়। ১৯৬০ সালের ডিসেম্বর থেকে সংকলনের কাজ শুরু হয়। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী এবং ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদকে নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান। অভিধানটির তিন খন্ডের বিষয় পরিকল্পনা ছিল, প্রথম খন্ড: আঞ্চলিক ভাষার অভিধান। এর বিষয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবহৃত শব্দাবলির সংগ্রহ।

দ্বিতীয় খন্ড: ব্যবহারিক বাংলা অভিধান। এর বিষয় বাংলা সাহিত্যে বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানি সাহিত্যে ব্যবহৃত শব্দাবলির সংকলন।
তৃতীয় খন্ড: বাংলা সাহিত্যকোষ। এর বিষয় বাংলা সাহিত্যে ব্যবহৃত বিশেষার্থক শব্দ, প্রবাদ-প্রবচন, উপমা, রূপক, উল্লেখ ও উদ্ধৃতি এবং মুসলমান সাহিত্য-সাধকদের সংক্ষিপ্ত জীবনী। সাত বছরের প্রচেষ্টায় (১৯৫৮-১৯৬৪) সহস্রাধিক পৃষ্ঠার এ মহাগ্রন্থের প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। ১৯৭৩ সালে এর দ্বিতীয় মুদ্রণ এবং ১৯৯৩ সালে ১,০৫৮ পৃষ্ঠায় এর প্রথম পুনর্মুদ্রণ প্রকাশিত হয়।
সর্বাধিক আঞ্চলিক শব্দের সংগ্রহ এ অভিধান পরবর্তীকালের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে।

প্রাতঃস্মরণীয় বহুমাত্রিক পন্ডিত, বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষা আন্দোলনেরও প্রথম দার্শনিক। ১৯২১ সাল থেকেই তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। বৃটিশ বিরোধী ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সংগ্রামে ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের আগেই তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাংলার দাবি তুলে ধরতে থাকেন।

Manual7 Ad Code

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রায় ৩০টি ভাষা জানতেন। ১৮টি ভাষায় ছিলেন সুপণ্ডিত। কিন্তু তার অন্তরের ভাষা ছিল বাংলা। মাতৃভাষার প্রতি তার ভালোবাসা ছিল প্রবাদ প্রতীম। তিনি বাংলা একাডেমিরও স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি বলেছিলেন, মা, মাতৃভাষা, মাতৃভূমি প্রত্যেক মানুষের পরম শ্রদ্ধার বস্তু।

Manual8 Ad Code

চর্যাপদ বিষয়ক গবেষণা, বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে তার মতবাদ, বাংলাভাষার জন্মসাল বিষয়ে তার বক্তব্য, বাংলা বর্ষপঞ্জির সংস্কার, বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস লেখা, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রণয়ন সবই তার উল্লেখযোগ্য কীর্তি।
নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নাম এবং নাম জানলেও জানে না কী তার অবদান।

বাংলাভাষার গবেষক হিসেবে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রধান অবদান হলো, চর্যাপদের বিষয়বস্তু এবং তার কবিদের পরিচয় তুলে ধরা, বাংলাভাষার উৎপত্তিকাল নির্ধারণ করা (ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে এটি ৬০০ থেকে ৭০০ অব্দের মধ্যে), বাংলাভাষার উৎপত্তি যে গৌড়ীয় প্রাকৃত থেকে সেটি বলা, আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রণয়ন করা এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রণয়ন।

“আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙ্গালী। প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারা ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ এঁকে দিয়েছেন, যে মালা তিলক টিকিতে বা টুপি লুঙ্গি দাঁড়িতে তা ঢাকবার জো নেই।

হিন্দু-মুসলমান মিলিত বাঙালি জাতি গড়িয়া তুলিতে বহু অন্তরায় আছে, কিন্তু তাহা যে করিতেই হইবে।”
-ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

তিনি ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, গবেষক, অাইনজীবী, কবি, সাহিত্যিক, লোকবিজ্ঞানী, জ্ঞানতাপস ও ভাষাসৈনিক। এছাড়াও ভাষাতত্ত্ব চর্চার ইতিহাসেও তিনি প্রাতঃস্মরণীয়। উনিশ শতকের বাংলা নিয়ে যেসব চর্চা হয়েছে তার বেশিরভাগই আধুনিক শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজের পশ্চাৎপদতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয়েছে। এই প্রবণতার সঙ্গে প্রকৃত বাস্তবের কতখানি সম্পর্ক আছে তা নিয়ে আজকের গবেষকরা রীতিমতো সন্দিহান।

উনিশ শতক সংক্রান্ত এপার বাংলার বেশিরভাগ গবেষণাতেই শহরাঞ্চলের মুসলমানদের অবদান যেমন অনুল্লিখিত, তেমনই আপামর গ্রাম বাংলায় ভারতবর্ষের অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে ধারা বিদ্যমান ছিল এবং সেই চেতনার দ্বারা গ্রামীণ মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন, তার উল্লেখ প্রায় থাকেই না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শৈশবের জীবন যদি আমরা আলোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারা উনিশ শতকের শেষভাগে কলকাতা শহর থেকে সামান্য কিছু দূরে বসিরহাট মহকুমাতে কি ভীষণ রকমভাবে তখনও বর্তমান ছিল।
শহীদুল্লাহর জন্ম ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই, শুক্রবার- অবিভক্ত বাংলার অবিভক্ত ২৪ পরগনা বসিরহাট মহকুমার অন্তর্গত পেয়ারা গ্রামে। এই বসিরহাটেই জন্মেছিলেন সাংবাদিকতার অন্যতম আদিগুরু মুজিবর রহমান। তার সম্পাদিত ‘দ্য মুসলমান ‘পত্রিকা বিশ শতকের সূচনাপর্বে গ্রামীণ সাংবাদিকতার বৃত্ত অতিক্রম করে শহর কলকাতাতে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। গ্রামবার্তা প্রবেশিকা’ এবং তার কিংবদন্তী সম্পাদক কুমারখালির কাঙাল হরিনাথ-কে ঘিরে সারস্বত সমাজে যথেষ্ট আলোড়ন থাকলেও মুজিবর রহমান সম্পর্কে এপার বাংলার শহুরে বুদ্ধিজীবী মহল পালন করে যান আশ্চর্যজনক নীরবতা। বেগম রোকেয়ার জীবদ্দশায় তার সংস্কারমূলক কাজকে সমর্থন ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই ‘ দ্য মুসলমান’ পত্রিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল।

Manual4 Ad Code

শহীদুল্লাহর ষষ্ঠ ঊর্ধ্বতন পুরুষ- শেখ দারা মালিকি থেকে তার পিতা মফিজউদ্দিন আহমেদ পর্যন্ত সকলে ছিলেন বসিরহাটের কাছাকাছি হাড়োয়া গ্রামের সমাধিস্ত মধ্যযুগের অসাম্প্রদায়িক চেতনার অন্যতম অগ্রদূত সৈয়দ আব্বাস আলী মক্কী ওরফে পীর গোরাচাঁদের দরগার খাদেম। সেই সামাজিক-পারিবারিক পরিবেশের ভিতরে শহীদুল্লাহ এর প্রথম নাম হয়েছিল মোহাম্মদ ইবরাহিম।

তার মা হরুন্নেশা কিন্তু পুত্রের সে নাম বদলে রাখেন শহীদুল্লাহ। এই পোশাকী নামটি সেই সময়ের নিরিখে কিছুটা অভিনবই ছিল। হরুন্নেশা ছেলের ডাক নাম রেখেছিলেন সদানন্দ। সেই ডাক নামেই কিন্তু শহীদুল্লাহ তার পারিবারিক পরিমণ্ডলে পরিচিত ছিলেন। এই অসাম্প্রদায়িক চেতনায়ই ছিল উনিশ শতকের গ্রাম বাংলার মর্ম চিত্র। তাই বাড়ির পরিবেশে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি মামার বাড়ি দেগঙ্গা এলাকার ভাসলিয়া গ্রামের সাওতালিয়া মক্তবে যখন শহীদুল্লাহ ভর্তি হলেন, তখন বিদ্যাসাগর প্রণীত বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ, কথামালা, বোধোদয় – এগুলিও তার পাঠ্য হলো। বিদ্যাসাগরের শিশু পাঠের পাশাপাশি সেই মক্তবেই তিনি পড়লেন মীর মশাররফ হোসেনের লেখা শিশুপাঠ্য বইগুলি ।

মক্তবের পরিমণ্ডলের বাইরে প্রথাগত শিক্ষা শহীদুল্লাহ শুরু করেছিলেন একটু বেশি বয়সেই। প্রথমে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন হাওড়া জুনিয়র হাই স্কুলে। সেখান থেকে ১৪ বছর বয়সে মাইনর পাশ করে ভর্তি হলেন হাওড়া জেলা স্কুলে। ছেলেবেলা থেকেই ভাষা শিক্ষার প্রতি তার ছিল প্রবল আকর্ষণ। তবে তিনি নিজেই লিখে গেছেন, স্কুলে মৌলভী সাহেবের কাছে মার খাওয়ার ভয়ে আরবি, ফারসির বদলে সংস্কৃত ভাষা নিয়ে ছিলেন।

স্কুল জীবনে তিনি ওড়িয়া, হিন্দি তামিল এমনকি গ্রিক ভাষা সম্পর্কে শিখতে শুরু করেন। স্কুলছাত্র শহীদুল্লাহ বাংলা বর্ণমালায় আরবির অন্তর সম্পর্কে চর্চা করতে শুরু করেছিলেন। সেই সময়ই ফারসি এবং সংস্কৃততে কবিতা লেখাতেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। হাওড়া জেলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় শহীদুল্লা উত্তীর্ণ হন ১৯০৪ সালে। ১৯০৬ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ পাশ করেন। হুগলি মহসিন কলেজ এর পর ভর্তি হন। বিএ পড়ার এই সময়ে তার শরীর অত্যন্ত ভেঙে পড়েছিল সেই কারণে তার পড়াশুনায় সামরিক ছেদ পড়ে।

পারিবারিক কারণে তাকে তখন যশোর জেলা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিতে হয়েছিল। তারপর আবার শিক্ষকতা ছেড়ে সিটি কলেজে ভর্তি হন ১৯১০ সালে। সেখান থেকে সংস্কৃতে দ্বিতীয় শ্রেণির অনার্স নিয়ে বিএ পাস করেন। সে বছরই তার বিয়ে হয়। শহীদুল্লাহ একই সঙ্গে সংস্কৃতে এমএ এবং আইনে গ্রাজুয়েশনের জন্য পড়তে আরম্ভ করেন। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের তৎকালীন বেদ বিষয়ক অধ্যাপক পণ্ডিত সত্যব্রত সামধ্যায়ী একজন মুসলমান ছাত্রকে বেদ পড়াতে অস্বীকার করেন।

শহীদুল্লাহ তার স্মৃতিচারণে পরবর্তীকালে বলেছিলেন- পণ্ডিত সত্যব্রতের সামনে আমি এই তর্ক তুলেছিলাম যে, শাস্ত্রে শুদ্র এবং নারীকে বেদ পড়ানো নিষিদ্ধ বলা আছে। তাই কোন যুক্তিতে আমাকে বেদ পড়ানো হবে না! আমি তো নারীও নই শূদ্রও নই, তাহলে আমাকে বেদ পড়াতে আপনার আপত্তি কোথায়?

শহীদুল্লাহ’র এই যুক্তির প্রতি কোনো রকম কর্ণপাত করেননি সেই প্রতিক্রিয়াশীল ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। শহীদুল্লাহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হন। স্যার আশুতোষ সত্যব্রতকে অনুরোধ করলেও তিনি উপাচার্যের অনুরোধ রক্ষা করতে অস্বীকার করেন। উল্টো উপাচার্যকে হুমকি দেন, যদি মুসলমান ছাত্রকে বেদ পড়ানো হয়, তাহলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করবেন।

শহীদুল্লাহ সেই সময়ে সারস্বত সমাজের বেশ কিছু মানুষদের কাছে নিজের আর্জি নিয়ে যান। প্রেসিডেন্সি কলেজে শহীদুল্লাহ প্রাক্তন শিক্ষক সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ শহীদুল্লাহকে অনুরোধ করেন, প্রাইভেটে পরীক্ষা দিতে। তিনি আশ্বাস দেন পরীক্ষার বিষয়ে সব রকম সাহায্য তিনি শহীদুল্লাহকে করবেন ।
শহীদুল্লাহর আর এক শিক্ষক, বহুভাষাবিদ হরিনাথ দে তাঁকে বলেন; পণ্ডিতেরা প্রতিহিংসাপরায়ন হতে পারেন। সুতরাং সে বিষয়ে সাবধানী হয়ে শহীদুল্লাহের বেদ বা না পাড়াই ভালো, সংস্কৃত না পড়াই ভালো।

তৎকালীন পত্রপত্রিকা গুলিতেও শহীদুল্লাহকে সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপকের বেদ না পড়ানোর বিষয়টি নিয়ে কঠোর সমালোচনা হয়। ’দি বেঙ্গলি’ পত্রিকার সম্পাদক রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় অধ্যাপক সত্যব্রতের সমালোচনা করেন। মাওলানা মোহাম্মদ আলী সম্পাদিত ‘ দি কমরেড’ পত্রিকাতেও শহীদুল্লাহের পক্ষ অবলম্বন করে জোরদার শাওয়াল চালানো হয়। কিন্তু কোন অবস্থাতেই সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক তাঁর সেই প্রতিক্রিয়াশীল সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসলো না ।ফলে উপাচার্য স্যার আশুতোষের পরামর্শে সদ্য প্রতিষ্ঠিত নতুন বিভাগ ‘তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব ‘নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন শহীদুল্লাহ ১৯১০ সালে।

সদ্য প্রতিষ্ঠিত ওই বিভাগটিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদুল্লাহই ছিলেন সেই সময়ের একমাত্র শিক্ষার্থী। ১৯১২ সালে তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয় এমএ পাস করেন। স্যার আশুতোষ জার্মানিতে সংস্কৃত পড়তে ভারত সরকারের একটি বৃত্তির জন্য শহীদুল্লাহ এর পক্ষে সরকার বাহাদুরের কাছে সুপারিশ করেন। দুর্ভাগ্যের কথা, সংশ্লিষ্ট বৃত্তিটি পাওয়ার জন্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যে পরীক্ষা দিতে হয়, ক্ষীণ স্বাস্থ্যের কারণে শহীদুল্লাহ সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন না। তার বিদেশযাত্রা সেই পর্যায়ে সম্ভব হয় না।

সেই সময়ে (১৯১৪ সালে) শহিদুল্লাহ এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কিছুদিন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯১৫ সালে আবার ফিরে আসেন নিজের গ্রাম বসিরহাটে। সেখানে কিছুদিন তিনি ওকালতিও করেছিলেন। এই সময়ে স্যার আশুতোষ তাকে বলেন; “ওকালতি তোমার কাজ নয়, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসো।”

স্যার আশুতোষের ব্যবস্থাপনায় ১৯১৯ সালে শহীদুল্লাহ শরৎকুমারী লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগ দেন। এই কাজটি ছিল মূলত গবেষণাকর্মে আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনকে সহায়তা।

ছাত্রজীবন থেকেই গবেষণা এবং সাহিত্য চর্চার প্রতি ছিল শহীদুল্লাহর প্রবল উৎসাহ। ১৩১৬ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ সংখ্যা ‘ভারতী’ পত্রিকায় ‘মদন ভস্ম’ নামে তার একটি প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছিল। পত্রিকার সম্পাদিকা স্বর্ণকুমারী দেবী (রবীন্দ্রনাথের ভগিনী) সেই প্রবন্ধটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। পত্রিকার সংশ্লিষ্ট সংখ্যাটিতে স্বর্ণকুমারীর সেই প্রবন্ধটিও প্রকাশ হয়েছিল।

ছাত্রজীবনে শহিদুল্লাহ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পত্রিকা, শনিবারের চিঠি, প্রবাসী, আল এসলাম, কোহিনুর ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। সেই সময়ে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ছাত্র অধ্যক্ষও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯১৮ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ গঠন শহীদুল্লাহর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এই কাজে তার সব থেকে বড় সহযোগী ছিলেন মুজফফর আহমদ। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদকে সভাপতি করে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি গঠিত হয়েছিল। শহীদুল্লাহ ছিলেন এই সংগঠনের সম্পাদক এবং মুজফফর আহমদ ছিলেন সহকারী সম্পাদক। ১৩২৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখ থেকে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা এই সংগঠনের মুখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে। শহীদুল্লাহ এবং মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক যৌথভাবেই পত্রিকাটি সম্পাদনা করলেও পত্রিকা সম্পাদনার কাজে মুজফফর আহমদের বিশেষ ভূমিকা ছিল।
কাজী নজরুল করাচিতে সেনার চাকরির পদ থেকে কর্মচ্যুত হওয়ার পর কলকাতায় এসে এই বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে মুজফফর আহমদের পাশের ঘরে এসে উঠেছিলেন। নজরুলের বহু লেখা এই পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। ১৯২০ সালে একটি স্বল্প আয়ুর শিশুপাঠ্য মাসিক পত্রিকা ‘আঙ্গুর‘ সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছিলেন শহীদুল্লাহ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানকার সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তার আহ্বানে ওখানে শহীদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একমাত্র লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। ১৯২৬ সালে তিনি উচ্চতর গবেষণার জন্য প্যারিসে যান এবং কাহ্নপা ও সরহের মরমী গীত সম্পর্কে গবেষণা করে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধি এবং ধ্বনিতত্ত্বের ডিপ্লোমা লাভ করেন।

এই সময় শহীদুল্লাহ প্যারিসে বিশ্ব বিখ্যাত বেশ কিছু ভাষাতত্ত্ববিদের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সময় তিনি কিছুদিন পড়াশুনা করেছিলেন। শহীদুল্লাহ একাধারে সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা নিয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি তার বিদেশে অধ্যায়নকালে প্রাচীন ফারসি এবং তিব্বতি ভাষায় নিজেকে পারদর্শী করে তোলেন। তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে ও নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেন এবং ধ্বনিবিজ্ঞানের শিক্ষা গ্রহণ করেন।

১৯২৮ সালে বিদেশের পড়াশোনা শেষ করে আবার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। মনীষী কাজী আবদুল ওদুদের নেতৃত্বে আবুল হোসেন, আবুল ফজল প্রমুখেরা বিশ শতকের বিশের দশকে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে যে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ ‘ও তাদের মুখপাত্র ‘শিখা’, যে প্রক্রিয়াটিকে অন্নদাশঙ্কর রায় অভিহিত করেছিলেন ‘বাংলা দ্বিতীয় জাগরণ’ হিসেবে, তার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যান।

এই সময়কালেই মুসলিম সাহিত্য সমাজের কর্মপদ্ধতি এবং বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সপক্ষে শিখা গোষ্ঠিতে উদার, মানবিক ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা প্রকাশের জন্য ঢাকার প্রভাবশালী মহলের একটা বড় অংশ আবুল হোসেনের বিচারের আয়োজন করেছিলেন। এই গোটা প্রক্রিয়াটি একটি সম্মানজনক সমাধানের ক্ষেত্রে শহীদুল্লাহর বিশেষ অবদান ছিল। তিনি অত্যন্ত যুক্তি সহকারে সেই সময়ের ইসলামী মৌলবাদীদের এটা বোঝাতে সমর্থ হন যে, আবুল হোসেনের প্রকাশভঙ্গিতে কিছু অসংযম থাকলেও তিনি আদৌ ইসলামবিরোধী কোন কথাই বলেননি।

এরপর পূর্ব বঙ্গ সাহিত্য সমাজের সঙ্গে শহীদুল্লাহের একটি ঘনিষ্ঠ সংযোগ গড়ে উঠেছিল। চারের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে পাঁচের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পেশাগত কারণে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় শহিদুল্লাহকে থাকতে হয়েছিল। তবে পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরেই বাংলা ভাষা, হরফ এবং সংস্কৃতির উপরে পশ্চিম পাকিস্তানের যে আক্রমণ নেমে আসে, প্রথম থেকেই তার বিরুদ্ধে অত্যন্ত সোচ্চার ভূমিকা নিতে দেখা যায় শহীদুল্লাহকে।

দেশভাগের অব্যবহিত আগে ‘৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এই মতের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন শহীদুল্লাহ। দ্বিধাহীন ভাষায় তিনি সেদিন লেখেন-
দেশে একটি মাত্র রাষ্ট্রভাষা হলে সে সম্মান বাংলার। দুটি রাষ্ট্রভাষা হলে বাংলার সঙ্গে উর্দুর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
বাংলা ভাষার জন্য আরবি ও রোমান হরফের প্রবর্তনের যে প্রবণতা তখন দেখা দিয়েছিল, সদ্য গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে তাকে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় একটি পশ্চাদগামী পদক্ষেপ বলে অভিহিত করতে দ্বিধা করেননি শহীদুল্লাহ।

১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি হিসেবে স্পষ্ট ভাষায় শহীদুল্লাহ বলেন-
আমরা হিন্দু বা মুসলমান একথা যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য এই যে আমরা বাঙালি।
এ ধরনের স্পষ্ট উক্তির জন্য পাকিস্তানের মৌলবাদী সমাজ তার উপর ভয়ঙ্কর রকম খাপ্পা হয়ে যায়। তার সম্বন্ধে রটনা করা হয়, তিনি হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারপ্রান্তে দণ্ডায়মান ভারতীয় চর। কিন্তু কোন ধরনের অপবাদই নিজের সংকল্প থেকে শহীদুল্লাহকে এতোটুকু টলাতে পারেনি ।

১৯৬৩ সাল থেকেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ১৯৬৮ সালে পত্নীবিয়োগে তিনি গভীর আঘাতপ্রাপ্ত হন। ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ৮৪ বছর বয়সে বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক এবং জ্ঞানতাপস ও বহুমাত্রিক পন্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জীবনাবসান হয়। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন।

#
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ;
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি;
সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা;
‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।
সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন।
সাধারণ সম্পাদক, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি।
প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ আইন ছাত্র ফেডারেশন।
E-mail : syedzaman.62@gmail.com
WhatsApp : 01716599589
মুঠোফোন: ০১৭১৬৫৯৯৫৮৯
Bikash number : +8801716599589

(personal)

Manual1 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code