সিলেট ১৪ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১১:০৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৫
বিশেষ প্রতিনিধি | শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার), ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ : শ্রীমঙ্গলে চলছে বালু লুটের মহোৎসব। এ উৎসব সমগ্র মৌলভীবাজার জেলাতেও দুর্দান্ত প্রতাবেই অব্যাহত আছে।
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল, রাজনগর, কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার অসংখ্য নদী ও ছড়া থেকে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে পাচার করছে। আর এই বালু ব্যবসায় জড়িতরা ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাঝে মধ্যে প্রশাসনের অভিযানে ড্রাইভার-হেলপার আটক, ট্রাক জব্দ ও জরিমানা করা হলেও মূল গডফাদাররা অদৃশ্যই থাকেন। গত ১৬ আগস্ট ২০২৫ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি নিউজ বাংলা ‘মৌলভীবাজারের সিলিকা বালু লুট হচ্ছে নির্বিচারে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
শ্রীমঙ্গলের এলজিডির পিচ রাস্তা মারাত্মক ঝুঁকিতে-
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের উত্তর ভাড়াউড়া গ্রামের একমাত্র যাতায়াতের এলজিডির পিচ রাস্তা বর্তমানে মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। স্থানীয়রা জানায়, মৌলভীবাজার রোডের ৫নং হাইওয়ে ব্রিজ সংলগ্ন রাস্তার সাইট গাইড ওয়াল কয়েক দফা বন্যার পানিতে ভেঙ্গে পড়ে। এর ফলে সড়কটিও ভেঙ্গে গিয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
এলাকাবাসীর দুর্ভোগ
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, অর্ধ কিলোমিটারেরও বেশি অংশে রাস্তাটি ভাঙনের কবলে পড়েছে। গ্রামীণ জনসাধারণ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, এমনকি রোগী বহনকারী যানবাহন চলাচলেও চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। অনেককে বিকল্প দীর্ঘপথ ঘুরে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা জসিম মিয়া বলেন, “রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় আমরা মারাত্মক সমস্যায় পড়েছি। চিকিৎসার জন্য কাউকে হাসপাতালে নিতে হলে বিপাকে পড়তে হয়। স্কুলগামী ছেলেমেয়েরাও ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে।”
বালু উত্তোলনে সড়ক হুমকির মুখে
এলাকাবাসীর অভিযোগ, বিগত সরকারের সময়ে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি জইনকা ছড়া থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে, যার কারণে গাইড ওয়াল ভেঙে পড়ে। বর্তমানে যুবরাজ মিয়া, চন্দন বৈদ্য ও আজিদ মিয়ার নাম উল্লেখ করে স্থানীয়রা বলেন, তারা নিয়মিতভাবে বড় ট্রাক দিয়ে বালু উত্তোলন করছে। এর ফলে রাস্তা ও পুল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
রাস্তার পাশে দাঁড়ানো আরেকজন প্রবীণ বাসিন্দা ও বিশিষ্ট মুরব্বি (সাবেক কমিশনার) হাজী সাঈদ মিয়া জানান, “আমরা অনেকবার বাধা দিয়েছি। কিন্তু তারা কোন বাধা মানে না। ট্রাক ঢুকিয়ে রাস্তা ভেঙে ফেলছে। সরকার দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আমরা পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব।”
স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামতের চেষ্টা
গত ২৩ অক্টোবর থেকে এলাকাবাসী নিজেদের অর্থ ও শ্রম দিয়ে আংশিকভাবে রাস্তা মেরামতের চেষ্টা চালিয়েছে। কয়েকজন বিত্তশালীর সহায়তায় কিছু কাজ করা হলেও বড় অংশ অসমাপ্ত রয়ে গেছে।
স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ
গত ২৮ অক্টোবর এলাকাবাসীর পক্ষে প্রবীণ বাসিন্দা ও বিশিষ্ট মুরব্বি (সাবেক কমিশনার) হাজী সাঈদ মিয়া, জসিম উদ্দিন, কামাল মিয়া ও শাহ জাবের উদ্দিন আহমেদ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট লিখিত অভিযোগ দিয়ে দ্রুত রাস্তার মেরামত ও অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু এখনও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ তাদের।
জরুরি পদক্ষেপের দাবি
পরিদর্শনে দেখা গেছে, অতি দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সড়ক ও সেতুটি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়তে পারে, যার ফলে হাজারো মানুষ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এলাকাবাসীর একটাই দাবি—“অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করা হোক এবং সরকারি বরাদ্দ দিয়ে দ্রুত রাস্তার গাইড ওয়াল ও রাস্তা মেরামত করা হোক।”
শ্রীমঙ্গলের জাগছড়া: প্রকাশ্য বালু লুট-
শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৩ নং শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের ন্যাজারিন মিশনে যাবার পথে বিস্কুট ফ্যাক্টরির সামনের জাগছড়া থেকে দীর্ঘদিন ধরে বালু উত্তোলন চলছে। সঙ্ঘবদ্ধ প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মদদে হোমরাচোমরা শিপলু, মাসুম ও শাহেদের নেতৃত্বে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে ট্রাকে করে শিল্পপতি সিরাজুল ইসলাম হারুন মিয়া ও সাবেক চেয়ারম্যান রাসেন্দ্র দত্ত চৌধুরীর জমির উপর দিয়ে পাচার করা হয় বলে জানা গেছে।
ছড়ার পাশে বসবাসরত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ভয়ে এই গডফাদারদের নাম প্রকাশ্যে বলতে চান না। তবে এলাকাবাসীর অভিমত, বিষয়টি “ওপেন সিক্রেট”—সবাই জানে কিন্তু মুখ খোলার সাহস করে না। শিল্পপতি সিরাজুল ইসলাম হারুন যখন খবর পান নিজ জমির উপর দিয়ে বালুবাহী ট্রাক নিয়ে যাচ্ছে তখন চলাচল বন্ধ করে দেন। কিন্তু কিছুদিন পর পুনরায় পাচারকারী গোষ্ঠী গোপনে চালু করে পাচার করে।
ফুলছড়া থেকে গ্রামে বন্যা-
শ্রীমঙ্গলের দ্বারিকা পাল কলেজ সংলগ্ন দক্ষিণ উত্তরসুর তালতলা গ্রামের ফুলছড়া থেকেও চলছে একই চিত্র। অবৈধভাবে বালু তোলার ফলে বর্ষার সময় আশপাশের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়। এতে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন এবং অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধের দাবি জানান।
প্রশাসনের অভিযান ও ইউএনওর কঠোরতা-
গত ২৬ আগস্ট মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ ইসরাইল হোসেনের নির্দেশে শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ মহিবুল্লাহ আকনের নেতৃত্বে উপজেলার সিন্দুরখান ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। অভিযানে অর্পিত বালু মহালগুলোতে অভিযান চালিয়ে আনুমানিক ৫০০ ঘনফুট বালু জব্দ করা হয়। এ সময় সেনাবাহিনীর একটি টিমও সহযোগিতা করে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোঃ ইসলাম উদ্দিন বলেন, “অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে উপজেলা প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অব্যাহত থাকবে।”
তিনি আরও জানান, সম্প্রতি সম্ভাব্য বালু উত্তোলনস্থলে লাল পতাকা টাঙানো ও বাঁশের ব্যারিকেড বসিয়ে ট্রাক চলাচল বন্ধ করা হয়েছিল। নদী, পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা এবং কৃষিজমি সুরক্ষার স্বার্থে “বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০” মেনে চলার জন্য শ্রীমঙ্গলের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
গত ২৭ আগস্ট শ্রীমঙ্গল-এর সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর নেতৃত্বে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় আশিদ্রোন ইউনিয়নের গোপলাছড়া বালুমহালের তফসিলভুক্ত এলাকা পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনের সময় উপস্থিত ইজারাদারকে বালুমহালের তফসিল বহির্ভূত এলাকা এবং মতিগঞ্জ ব্রিজের আশপাশের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বালু উত্তোলন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকায় তা কঠোরভাবে মানার নির্দেশ দেওয়া হয়।
সাংবাদিকদের সোচ্চার ভূমিকা-
অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে সোচ্চার স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরাও। দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন জসিম তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, “মতিগঞ্জের বিলাস ছড়া থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।”
কমলগঞ্জ উপজেলায় দৈনিক ইত্তেফাক-এর কমলগঞ্জ সংবাদদাতা নুরুল মোহাইমিন মিল্টন তাঁর ফেসবুক একাউন্টে পোস্ট করে জানিয়েছেন যে কমলগঞ্জ উপজেলায় ধলাই নদীর ধর্মপুর এলাকায় অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের কারনে নদী গিলে খাচ্ছে বাড়িঘর। গৃহহীন হচ্ছে একাধিক পরিবার।
অন্যদিকে দৈনিক কালের কণ্ঠের মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি মোঃ সাইফুল ইসলাম প্রশাসনকে উদ্দেশ করে লিখেন, “বালু খেকোদের নিয়ে বালু ব্যবসা চালু করার জন্য তদবিরে প্রশাসনের দফতরে—কথিত সংবাদকর্মী।” যদিও তিনি সেই প্রভাবশালী সাংবাদিকের নাম প্রকাশ করেননি।
দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি-
শুধু পরিবেশ নয়, মানুষের জীবনও হুমকির মুখে পড়ছে। শ্রীমঙ্গলের ভূনবীর ইউনিয়নে অবৈধ বালুবাহী ট্রাকের ধাক্কায় তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনা এখনও এলাকাবাসীর মনে দগদগে ক্ষত হয়ে আছে।
অন্যান্য উপজেলায় একই চিত্র-
কমলগঞ্জের ধলাই ও লাঘাটা নদী থেকে বালু উত্তোলনের কারণে বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন পাহাড়ি ছড়া থেকেও অবৈধভাবে বাল উত্তোলন করার ফলে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় হচ্ছে। কুলাউড়ায়ও ইজারা সীমা অতিক্রম করে বালু উত্তোলনের দায়ে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারকে জরিমানা করা হয়েছে।
জুড়ী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ড্রেজার দিয়ে নির্বিচারে বালু উত্তোলনে নদীভাঙন ও জমি ধ্বংসের প্রতিবাদে এলাকাবাসী মানববন্ধন করেছে। কিন্তু এসব আন্দোলনের পরও বালু লুট বন্ধ হয়নি।
সরকারি ইজারা বনাম অবৈধ ব্যবসা-
সরকারি হিসাবে মৌলভীবাজারে ৫২টি সিলিকা বালুর কোয়ারি আছে, যার মধ্যে ৩৩টির ইজারা অনুমোদিত। কিন্তু বাস্তবে ইজারার মেয়াদ শেষ হলেও অনেক ছড়া থেকে অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে। আদালতের নির্দেশ অমান্য করে বালু উত্তোলন চলায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে।
পরিবেশবাদীদের সতর্কবার্তা-
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) জানিয়েছে, আদালতের রায় অমান্য করে বালু উত্তোলন প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রমাণ। অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আক্তার বলেন, “অবৈধ বালু উত্তোলন ঠেকানোর দায়িত্ব প্রশাসনের। যারা সুযোগ দিচ্ছেন, তারা আদালতের রায়কে অবমাননা করছেন।”
পরিবেশবাদীরা আরও সতর্ক করেছেন—এভাবে চলতে থাকলে ভোলাগঞ্জের মতো বালু-পাথর নিঃশেষ হবে, তখন কেবল আফসোস ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
উপসংহার-
মৌলভীবাজারের নদী ও ছড়াগুলো শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, এ অঞ্চলের জীবন-জীবিকারও অংশ। কিন্তু অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে পরিবেশ, কৃষিজমি, জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। প্রশাসনের অভিযান থাকলেও গডফাদারদের রেহাই—এটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে মৌলভীবাজারের নদী-ছড়া ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিলীন হবে বালু ব্যবসায়ীদের লোভে, আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি