নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকের ভূমিকা

প্রকাশিত: ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৫

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকের ভূমিকা

Manual3 Ad Code

মুহাম্মদ আবদুল্লা হিল হাকিম |

ভূমিকা

খাদ্য মানুষের জীবনের অন্যতম মৌলিক উপাদান। শরীর ও মনের সুস্থ বিকাশের জন্য যেমন সুষম আহার অপরিহার্য, তেমনি সেই খাদ্যের নিরাপত্তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকের পৃথিবীতে খাদ্য শুধু টিকে থাকার উপাদান নয়; এটি জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, খাদ্যে ভেজাল, নকল, অস্বাস্থ্যকর সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এর ফলে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য যেমন বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, তেমনি রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ এখন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে এ দায়িত্ব পালন করছেন নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকরা। তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভোক্তার অধিকার রক্ষা, খাদ্যের গুণগত মান বজায় রাখা এবং জনসচেতনতা তৈরির জন্য মাঠপর্যায়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

Manual4 Ad Code

নিরাপদ খাদ্য কেন জরুরি

বাংলাদেশে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মানুষ নানান খাদ্যজনিত অসুখে আক্রান্ত হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্যমতে, অনিরাপদ খাদ্যের কারণে শুধু শিশুদের মধ্যেই অপুষ্টি ও ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। একদিকে এর ফলে পরিবারকে চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে হচ্ছে, অন্যদিকে কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় সামগ্রিক অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিরাপদ খাদ্য কেবল স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয় নয়, বরং জাতির অগ্রযাত্রা ও টেকসই উন্নয়নের অন্যতম শর্ত।

নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকের দায়িত্ব ও ভূমিকা

১. খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন পর্যবেক্ষণ

খাদ্য পরিদর্শকদের প্রধান দায়িত্ব হলো বাজার, হোটেল-রেস্তোরাঁ, খাবার দোকান, প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ও গুদাম নিয়মিত পরিদর্শন করা। তারা খেয়াল রাখেন—

খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও পরিবহনের সময় স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কিনা।

কাঁচামাল ও রান্না করা খাবার আলাদা করে রাখা হচ্ছে কিনা।

হোটেল-রেস্তোরাঁয় রান্নাঘর ও কর্মচারীদের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা হচ্ছে কিনা।

২. খাদ্য মান নিয়ন্ত্রণ

নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকরা নিয়মিত খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠান। পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়—

খাদ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক, রঙ বা ভেজাল উপাদান মেশানো হয়েছে কিনা।

আইন ও বিধিমালায় নির্ধারিত মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়েছে কিনা।
এই কার্যক্রমের মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর আগেই অনিরাপদ খাদ্য শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়।

৩. আইন প্রয়োগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অধীনে পরিদর্শকরা আইন প্রয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। যদি কোনো ব্যবসায়ী ভেজাল বা অনিয়মে জড়িত প্রমাণিত হন, তবে জরিমানা, মামলা কিংবা প্রয়োজনীয় শাস্তি প্রদান করা হয়। এতে অসাধু ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং ভোক্তারা কিছুটা হলেও সুরক্ষা পান।

৪. সচেতনতা সৃষ্টি

শুধু আইন প্রয়োগই যথেষ্ট নয়; খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভোক্তা ও ব্যবসায়ী—উভয়পক্ষকেই সচেতন হতে হবে। তাই নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকরা নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করেন।

সাধারণ মানুষকে ভেজাল খাদ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানান।

দোকানদার, রেস্তোরাঁ মালিক ও ব্যবসায়ীদের আইন মেনে ব্যবসা করতে উৎসাহিত করেন।

স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে প্রচার চালান।

Manual5 Ad Code

৫. প্রতিবেদন ও ডাটাবেজ প্রস্তুতকরণ

পরিদর্শকরা প্রতিদিনের কার্যক্রমের প্রতিবেদন তৈরি করেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানান। এসব তথ্য ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারণে সহায়ক হয়। তাছাড়া একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ গড়ে ওঠে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়নে সহায়তা করে।

চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে পরিদর্শকদের নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়—

জনবল সংকট: বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় মাঠপর্যায়ে পরিদর্শকের সংখ্যা অত্যন্ত কম।

প্রযুক্তির অভাব: অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিক পরীক্ষাগার ও সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে।

অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রভাব: কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক চাপের কারণে আইন প্রয়োগ জটিল হয়ে পড়ে।

সচেতনতার অভাব: ভোক্তাদের একটি অংশ অনিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে উদাসীন থাকায় সমস্যা জটিল হয়ে ওঠে।

করণীয় ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে পরিদর্শকদের কাজকে আরও কার্যকর করতে হবে। এজন্য—

১. জনবল বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ: পর্যাপ্ত সংখ্যক পরিদর্শক নিয়োগ দিয়ে তাদের আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

২. প্রযুক্তি ব্যবহার: মোবাইল অ্যাপ, ডাটাবেজ ও আধুনিক পরীক্ষাগার ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত ও স্বচ্ছ কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরি।

Manual2 Ad Code

৩. আইন প্রয়োগ কঠোর করা: অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে উদাহরণযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

৪. ভোক্তা সচেতনতা: মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।

৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশেও খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে হবে।

উপসংহার

একজন নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক কেবল রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নন; তিনি সমাজে ভোক্তার আস্থার প্রতীক। তার কার্যকর ভূমিকার মাধ্যমেই সুস্থ প্রজন্ম ও টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি গড়ে উঠবে।

Manual3 Ad Code

বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করা। সেই অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সরকার, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকরা সেই সমন্বিত প্রচেষ্টার অগ্রভাগে থেকে নিরলসভাবে কাজ করছেন। তাই আইন প্রয়োগের পাশাপাশি প্রযুক্তি ব্যবহার ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি নিরাপদ খাদ্য পরিবেশ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
#


মুহাম্মদ আবদুল্লা হিল হাকিম
স্যানিটারি ইন্সপেক্টর,
লক্ষ্মীপুর পৌরসভা

নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক,
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code