এক শিশুর আর্তনাদ আর এক আলোকচিত্রীর আত্মঘাতী যন্ত্রণা

প্রকাশিত: ৬:৩০ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৫

এক শিশুর আর্তনাদ আর এক আলোকচিত্রীর আত্মঘাতী যন্ত্রণা

Manual5 Ad Code

সৈয়দা হাজেরা সুলতানা |

বিশ্ব ইতিহাসে এমন কিছু আলোকচিত্র রয়েছে যেগুলো কেবল এক মুহূর্তের দৃশ্য নয়, বরং মানবসভ্যতার বিবেককে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার আলোকচিত্রী কেভিন কার্টারের তোলা ১৯৯৩ সালের একটি আলোকচিত্র তার মধ্যে অন্যতম। ছবিটি তুলার পর কেবল বিশ্ববাসীই নয়, বরং নিজেও শোকাহত ও অপরাধবোধে ভুগতে ভুগতে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নেন মাত্র ৩৩ বছর বয়সী এই প্রতিভাবান ফটোগ্রাফার।

সুদানের দুর্ভিক্ষ : মৃত্যুর মিছিলের মাঝে এক শিশু

১৯৯৩ সালের মার্চ মাসে সুদান ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে নিপতিত। চারদিকে হাহাকার—শস্যহীন মাঠ, অনাহারে কাতর মানুষ, আর মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা অসংখ্য শিশু। জাতিসংঘের খাদ্য গুদামের আশায় ক্ষুধার্ত মানুষজন মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতো। সেই সময় কেভিন কার্টার সেখানে দায়িত্ব পালন করছিলেন সংবাদচিত্রগ্রাহক হিসেবে।

Manual1 Ad Code

তার চোখে ধরা পড়ে হৃদয়বিদারক এক দৃশ্য—এক কঙ্কালসার শিশু মাটিতে নিথর হয়ে পড়েছে, মাথা নামানো, শক্তি নেই উঠে দাঁড়াবারও। ঠিক পাশেই এক শকুন বসে আছে, যেন শিশুটির শেষ নিঃশ্বাস ফেলার অপেক্ষায়। শকুনের সেই শীতল দৃষ্টি যেন গোটা মানবজাতির উদাসীনতাকে নগ্ন করে দেয়।

নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশ ও বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া

কেভিন কার্টারের তোলা ছবিটি ১৯৯৩ সালে The New York Times-এ প্রকাশিত হতেই পৃথিবী কেঁপে ওঠে। মানবিক বিবেককে নাড়া দেওয়া সেই ছবিটি বিশ্বমঞ্চে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কোটি কোটি মানুষ প্রথমবার উপলব্ধি করে, দুর্ভিক্ষ শুধু পরিসংখ্যান নয়, তা একেকটি জীবন্ত মৃত্যুযন্ত্রণা।

১৯৯৪ সালে এই ছবির জন্য কার্টার পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করেন—সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ স্বীকৃতিগুলোর একটি। কিন্তু এই স্বীকৃতি তার ভেতরের ক্ষত সারাতে পারেনি। বরং বিতর্ক ও আত্মপীড়ন তাকে দিন দিন গ্রাস করতে থাকে।

মানসিক যন্ত্রণা ও আত্মহত্যা

ছবিটি প্রকাশের পর থেকে কার্টার কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হন—

তিনি কি শিশুটিকে সাহায্য করেছিলেন?

কেন ক্যামেরা নামিয়ে শিশুটিকে খাদ্য গুদামে পৌঁছে দেননি?

এই প্রশ্নগুলো, সঙ্গে পেশাগত চাপ, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ও ব্যক্তিগত জীবনের অস্থিরতা তাকে ভেতর থেকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে পুরস্কার জেতার মাত্র চার মাস পর, তিনি নিজ গাড়ির ভেতরে আত্মহত্যা করেন।

তার ডায়রিতে মৃত্যুর আগে লেখা কয়েকটি লাইন মানবিকতার অমোঘ দলিল হয়ে রইল:

> “হে পরম করুণাময়, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি খাবার কখনো নষ্ট করব না। প্রার্থনা করি আমরা যেন আরও সংবেদনশীল হই। প্রার্থনা করি, সেই ছোট্ট ছেলেটি মুক্তি পাক কষ্ট থেকে। এই ছবিটি যেন মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, আমরা কতটা সৌভাগ্যবান।”

Manual3 Ad Code

ছবিটির উত্তরাধিকার

Manual3 Ad Code

কেভিন কার্টারের ছবিটি কেবল সুদানের দুর্ভিক্ষ নয়, বরং বিশ্ব মানবতার অবহেলা ও নিষ্ঠুরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন জেগেছে—একজন সাংবাদিক বা আলোকচিত্রী কি কেবল নথিবদ্ধ করবেন, নাকি সক্রিয়ভাবে মানবিক সাহায্যের হাত বাড়াবেন? বিতর্কের উর্ধ্বে গিয়েও এটি সত্য, যে ছবিটি লক্ষ লক্ষ মানুষকে সচেতন করেছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর বৈষম্যের করুণ বাস্তবতা সম্পর্কে।

উপসংহার

আজও কেভিন কার্টারের ছবিটি মনে করিয়ে দেয়, পৃথিবীর কোথাও কেউ ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে, মৃত্যুর প্রহর গুনছে। আর আমরা যারা তুলনামূলক নিরাপদ ও সচ্ছল জীবনে আছি, আমাদের প্রতিটি আহার, প্রতিটি সম্পদ কতটা দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করা উচিত।

একটি আলোকচিত্র যেমন বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিতে পারে, তেমনি একজন শিল্পীর ভেতরে সেই ছবি অমোঘ যন্ত্রণা হয়ে বেঁচে থাকতে পারে। কেভিন কার্টারের জীবন ও মৃত্যু আমাদের শেখায়—মানবিক দায়বদ্ধতা শুধু দেখার জন্য নয়, তা কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করার নামই প্রকৃত মানবতা।
#
সৈয়দা হাজেরা সুলতানা
শিক্ষার্থী
পদার্থবিজ্ঞান (সম্মান) ১ম বর্ষ
মুরারিচাঁদ কলেজ
সিলেট।

Manual1 Ad Code

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code