রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য ‘শাপে বর’ হয়েছে মহামারী করোনা

প্রকাশিত: ৩:২৩ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২৯, ২০২০

রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য ‘শাপে বর’ হয়েছে মহামারী করোনা

Manual4 Ad Code

ঢাকা, ২৯ জুলাই ২০২০: বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের উৎপাত পুরোপুরি বন্ধ না হলেও বন বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আর সরকারের নানা উদ্যোগে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মৃত্যুর ঘটনা কমে এসেছে। কমেছে লোকালয়ে মানুষের পিটুনিতে বাঘের মৃত্যুর ঘটনাও।

আর সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাস মহামারী বলতে গেলে ‘মন্দের ভালো’ হয়ে এসেছে সুন্দরবনের বাঘের জন্য। গত পাঁচ মাস ধরে মানুষের পা পড়ছে না সুন্দরবনে। তাতে বন্যপ্রাণীর প্রজননের অনুকূল পরিবেশ ফিরেছে।
ফলে অস্তিত্বের হুমকিতে থাকা বাংলাদেশের জাতীয় পশুটির বংশবৃদ্ধি নিয়ে আশায় বুক বাঁধছেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
বুধবার আন্তর্জাতিক বাঘ দিবসের প্রাক্কালে এই আশার কথা শোনালেন প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী।
তিনি বলেন, “মহামারীর কারণে গেল পাঁচ মাস ধরে চোরা শিকারিদের হাতে বাঘ মারা যাওয়ার তথ্য আসেনি। আন্তর্জাতিক রুট ও সীমান্ত বন্ধ থাকায় পাচারকারীদের তৎপরতাও কম।”

‘ফিরে আসা’ প্রকৃতিকে ধরে রাখার লক্ষ্য

Manual1 Ad Code

পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্বও অনেক কমেছে। ২০১৩ সালের পর শুধু ২০১৮ সালেই লোকালয়ে বাঘের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

“লোকালয়ে মানুষের পিটুনিতে বাঘের মৃত্যুর এমন ঘটনা আর ঘটেনি। এখানে একটা বড় সাকসেস আছে। সার্বিকভাবে এ পরিস্থিতি যদি বজায় থাকে, আমারা আশা করতে পারি- নেক্সট টাইগার জরিপে, ২১-২২ সালে, বাঘের সংখ্যা বাড়বে,” বলেন আমীর।

গেল বছর জরিপের পর সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়। ২০২১-২০২২ সালে আরেকটি জরিপ হবে।

সুন্দরবনে বাঘ বেড়ে এখন ১১৪টি: বন বিভাগ

বাঘের মৃত্যু: পূর্বে বেশি, পশ্চিমে কম

বন কর্মকর্তারা জানান, গত দুই দশকে সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের হাতে, লোকালয়ে মানুষের পিটুনিতে এবং অসুস্থতা ও বার্ধক্যজনিত কারণে ৩৮টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে ২২টি এবং পশ্চিমে হয়েছে ১৬টি।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, তার এলাকায় এই সময়ে ১০টি বাঘ চোরা শিকারিদের হাতে মারা পড়েছে। লোকালয়ে এসে জনতার পিটুনিতে ছয়টি, জলোচ্ছ্বাসে একটি এবং অসুস্থতা ও বার্ধক্যজনিত কারণে অন্য চারটি বাঘের মৃত্যু হয়েছে।

তবে পশ্চিম বিভাগে চোরা শিকাদের হাতে কোনো বাঘের মৃত্যুর তথ্য মেলেনি। সেখানে নয়টি বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়ে জনতার পিটুনিতে মারা যায়।

বেলায়েত হোসেন বলেন, “বাঘ যাতে অবাধে বনে বিচরণ করতে পারে, সেজন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।”

এ পর্যন্ত প্রায় ৭৫ হাজার জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালকে আর্থসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সুন্দবনের ওপর চাপ কমাতে আরও নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

Manual6 Ad Code

সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. বশিরুল আল মামুন বলেন, সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় তাদের পেট্রোল টিম নিয়মিত টহল দেয়। চোরা শিকারিদের ঠেকাতে বনবিভাগ থেকে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে।

‘প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ে বাঘ শিকারী ও পাচারকারীরা’

অবৈধভাবে হত্যা করা বাঘের ১১ ফুট লম্বা একটি চামড়া ২০০৪ সালের ২৫ অগাস্ট বরগুনা জেলার চারদুয়ানি কাঁঠালতলা গ্রামের বেলায়েত হোসেন তালুকদারের বাড়ি থেকে উদ্ধার করে বনবিভাগ।

২০০৬ সালের ২ নভেম্বর শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের মো. নুরুজ্জামান শেখের বাড়ি থেকে আরেকটি বাঘের চামড়া উদ্ধার হয়।

২০১১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি একই উপজেলার পশ্চিম খাদা গ্রামের পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে বনে হত্যা করা তিনটি বাঘের চামড়া, মাথার খুলি এবং ১৩৯ টুকরা হাড় পাওয়া যায়।

সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার নব্বইরশি বাসস্ট্যান্ডের মো. ইব্রাহিম শেখের মোটরসাইকেল গ্যারেজের পূর্ব পাশ থেকে একটি বাঘের চামড়া, ২৫টি হাড় ও ২৮টি দাঁত উদ্ধার করে বন বিভাগ।

এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাটি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন। আগের ঘটনাগুলোর মামলায় দায়ীদের সাজা ও অর্থদণ্ড হয়েছে।

২০১৬ সালে খুলনার কয়রায় বাঘের চামড়া বেচা-কেনার সময় দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ নেচার অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন সেন্টারের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ বনি বলেন, বাঘ আছে বলেই এখনও বন অনেকটা সুরক্ষিত।

“তবে চোরা শিকারিদের তৎপরতা কিন্তু থেমে থাকে না। তাদের দৌরাত্ম্য কমছে না। সুযোগ পেলেই সংঘবদ্ধ চক্র বাঘ হত্যা করে চড়ামূল্যে বিক্রি করে। সুন্দরবনের এই প্রাণীটিকে রক্ষা করতে বনের ওপর নির্ভরশীলদের অবাধ যাতায়াত বন্ধ করতে হবে।”

বনের উপর চাপ কমাতে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।

বন কর্মকর্তারা বলছেন, সুন্দরবনে নিয়মিত টহল হচ্ছে। সুন্দরবন থেকে যাতে বাঘ লোকালয়ে ঢুকতে না পারে এবং ঢুকলেও যাতে মানুষের হাতে প্রাণ না হারায়, সেজন্য বন সংলগ্ন উপজেলাগুলোতে স্থানীয় জনগণকে নিয়ে কমিটি গঠন করা আছে।

সুন্দরবনে নজরদারি করতে র‌্যাবের দুটি অস্থায়ী ক্যাম্প রয়েছে। তারাও সার্বক্ষণিক টহল দিয়ে থাকে।

Manual5 Ad Code

সুন্দরবনে সব ধরনের দস্যুতা প্রতিরোধে কাজ করা র‌্যাব-৮ এর কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে তারা প্রাণী হত্যায় জড়িত বেশ কয়েকটি চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছেন।

মহামারীর দিনে সুন্দরবন

প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, কোভিড-১৯ মহামারীর শুরুতে মার্চ থেকে সুন্দরবনে পর্যটক আসা-যাওয়া বন্ধ রয়েছে। জুলাই-অগাস্ট সময়ে মাছ ধরাও বন্ধ। লোকসমাগম কম হচ্ছে বলে বিচরণক্ষেত্র পাচ্ছে বাঘ।

“তাতে পাচার ও বিক্রির মত অপরাধগুলো কম হচ্ছে। গত চার মাসে এ ধরনের খবর আমাদের কাছে আসেনি। এদিক থেকে ভালো খবর। এ সময়ে চোরা শিকারির হাতে বাঘ মারা যাওয়ার কোনো ঘটনাও আমাদের চোখে পড়েনি।”

তিনি জানান সম্প্রতি আন্ধারমানিক ক্যাম্পে ১৪ বছর বয়স্ক একটি বাঘের মৃত্যু হয়, যেটি ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যু হিসেবেই তারা দেখছেন।

“পাচারকারীদের হাতে পড়লে বাঘই পাওয়া যেত না। ওটা বার্ধক্যজনিত রোগে মারা গেছে। ল্যাব টেস্টের প্রতিবেদন পেলেই বিস্তারিত জানা যাবে।”

Manual4 Ad Code

আমীর হোসাইন বলেন, বাঘ প্রকল্পের কারণে ইতোমধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ২০১৪ সালে যেখানে ১০৬টি বাঘ ছিল, সেখানে ২০১৯ সালে ১১৪টি হয়েছে।

“সরকারি-বেসরকারি-কমিউনিটিভিত্তিক সবার প্রচেষ্টায় পজিটিভ ফলাফল এসেছে। এ ধারা যদি বজায় থাকে আগামী দুই বছর জরিপে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, বাড়বে বাঘের সংখ্যা।”

কোভিড-১৯ সঙ্কটে এবার অনলাইনে বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে বাঘ দিবস পালিত হবে। ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সুন্দরবন এলাকার সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ত করে হবে বাঘ দিবসের অনুষ্ঠান।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code