রাষ্ট্রনায়কের বৈজ্ঞানিক দায়

প্রকাশিত: ৮:২৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৬, ২০২০

Manual5 Ad Code

ড. সুশান্ত দাস, ২৭ এপ্রিল ২০২০ : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ( WHO) যখন কোন তথ্য সরবরাহ করে, তখন সব সময় একটি ‘disclaimer’ বা ‘দায়বদ্ধতা অস্বীকার’ নামা প্রকাশ করে কারণ, তারা মানুষের জীবন রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছে।

Manual8 Ad Code

ড. সুশান্ত দাস

Manual5 Ad Code

তাদের কোন তথ্যকে যদি কেউ বিকৃত করে বা তার সংগে কোন তথ্য জুড়ে দিয়ে যদি কেউ তা প্রচার করে এবং তার ফলে মানুষের স্বাস্থ্যহানি বা জীবনহানি হয়, তার দায় এই সংস্থা বহণ করতে পারে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যবিধির ভিত্তিই তাই। সকল বৈজ্ঞানিক তথ্যের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। সেজন্যই কোন বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে তার সূত্র বা উৎস উল্লেখ না করে কোন তথ্য দেওয়া মারাত্মক ‘intellectual’ বা বুদ্ধিবৃত্তিক অপরাধ বলে গণ্য হয় তাকে বলা হয় ‘plagiarism’ বা রচনাচুরি। তার শাস্তি চাকরিচ্যুতি থেকে শুরু করে কালোতালিকাভূক্তি হতে পারে। বিজ্ঞানীমহলে এই শব্দটা অতি পরিচিত। অবশ্য সাংবাদিকতা বা অন্য লেখায় এ ধরণের ‘বুদ্ধিবৃত্তিক’ দায়বদ্ধতা আছে কিনা আমার জানা নেই ( থাকা উচিত), তবে নৈতিক দায়বদ্ধতা যে আছে তা সবাই জানেন। আর সেজন্যেই সাংবাদিকতায় ‘হলুদ সাংদাদিকতা’ শব্দটি অত্যন্ত পরিচিত।

এই ভূমিকাটুকু কেন দেওয়া হলো সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। দু’দিন আগে পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থ-প্রতিপত্তি, শক্তিমত্তায় সবচাইতে শ্রেষ্ট বলে দাবীদার দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি উক্তি প্রকাশ্যে করেছেন। তিনি বলেছেন, করোনা চিকিৎসার জন্য ‘disinfectant’ বা জীবানুনাশক মানুষের শরীরে ‘ইনজেক্ট’ করে করোনা নিরাময় করা যায়। তিনি তাঁর পাশে দাঁড়ানো বিশেষজ্ঞদের তাঁর কথায় সায় দেবার ইংগিত করলেন। তিনি অতিবেগুনি রশ্নি বা সূর্যালোক ব্যবহার করে করোনা প্রতিরোধের প্রসংগটিও এনেছেন। ভিডিওটি যারা দেখেছেন, তারা স্পষ্ট খেয়াল করেছেন, তাঁর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা অত্যন্ত বড় মাপের বিজ্ঞানী, তিনি অসহায় বোধ করছেন। এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীমহলে তোলপাড় তৈরি হয়। অতি বড় ট্রাম্প সমর্থক জ্ঞানী মানুষদের মাথা হেট হয়ে যায়। যাহোক, এত বড় লজ্জাকর আর অর্বাচীনতা ঢাকতে তার পরদিনই সাংবাদিক সম্মেলন করে ট্রাম্প সাহেবকে বলতে হয়, তিনি রসিকতা করে কথাটা বলেছিলেন। তার এই উক্তিও বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তিনি আদতেই রসিকতা করেছেন কি না, এটা কতটুকু সত্য। আর যদি তা করেও থাকেন, তার মত অবস্থানে থেকে তিনি তা নৈতিকভাবে করতে পারেন কিনা। তিনি তো আগে কোন ‘discalimer’ দেননি যে, এটা নিতান্তই রসিকতা, এটাকে যেন কেউ বাস্তবে প্রয়োগ না করেন। ইতিমধ্যেই যদি তাঁকে বিশ্বাস করেন, অন্ধভাবেই যদি করেন এমন কেউ জীবানুনাশক নিজের শরীরে ইনজেক্ট করেন, তার পরিণতি যে অবধারিত মৃত্যু, তার দায় কে নেবেন? গোটা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা রাত নেই, দিন নেই করোনার প্রতিষেধক বা প্রতিরোধক আবিষ্কারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তখন এই ধরণের তামাশা করা যায় কি না। একজন রাষ্ট্রনায়ক, যার সিদ্ধান্তের উপর বিশ্বের যে কোন প্রান্তে , যে কোন সময় উড়ে যেতে পারে প্রলয়াংকারি মৃত্যুদূত পারমানবিক মিসাইল, এক মুহূর্তে ধ্বংস করে দিতে পারে যে কোন জনপদ, তার এই ধরণের অবৈজ্ঞানিক রসিকতা করার নৈতিক বা ব্যবহারিক অধিকার আছে কি? মার্কিন জনগণ, মার্কিন বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়, তাদের শিক্ষক, বিজ্ঞানী, ছাত্র-ছাত্রী এটাকে কিভাবে নেবেন, এটা একটা বহুমূল্যবান প্রশ্ন। আমাদের দেশের একজন অতি বিতর্কিত রাজনীতিক, যার কথা মানুষ কানেই তোলে না, তার ফুসফুস কেটে বাইরে এনে সাবান পানিতে ধুয়ে করোনা সারানোর প্রেসকিপশান কি খুব খারাপ? এ কথা বলার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে ট্রল করা হয়েছে, মার্কিন দেশে তাদের প্রেসিডেন্ট কি সেটারই যোগ্য নন? সাংবাদিকরা অবশ্য ছাড়ছেন না। রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনীতিবিদদের বৈজ্ঞানিক হতে হবে, তা নয় কিন্তু, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অন্তর্নিহিত সারবত্তা তো বুঝতে হবে? আমার একটি বদ-অভ্যাস আছে, সময় পেলেই রাষ্ট্রনায়কদের শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখার। আমরা এশিয়ার মানুষ, আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াই করতে দেওয়া হয়নি বিদেশি শাসন আমলে, অনেককেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের ডিগ্রি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তবুও তারা জ্ঞানের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছেন। তাঁদের অনুগত হয়ে অমিত মেধাবী মানুষরাও তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞায় বিমুগ্ধ হয়েছেন। কিন্তু পশ্চিম, যারা শাসিত হয়নি, শাসন করেছেন, তাদের বেলায় কি? আমি দু’ একটি উদাহরণ দেই। বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি Classics, Ancient Literature and Classical Philosophy র স্নাতক। জার্মানীর চ্যান্সেলর একজন পদার্থবিজ্ঞানের স্নাতক ও কোয়ান্টাম রসায়নে পি এইচ ডি ডিগ্রিধারী। প্রসংগক্রমে বলি, তার স্বামী পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী। তিনি কোনদিন ফটোসেশনে আসেন না তার বৈজ্ঞানিক পরিধির বাইরে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন Leningrad State University থেকে আইনে স্নাতক, চীনের প্রেসিডেন্ট Chemical Engineering এ স্নাতক এবং যতদূর জানা যায়, তিনি মার্ক্সীয় দর্শনের উপর পি এইচ ডি করেছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অর্থনীতিতে ব্যাচেলার স্নাতক। তিনি ব্যবসা করেছেন, সামরিক বাহিনীতে গিয়েছিলেন, কিন্তু, স্বাস্থ্যগত কারণেই শুধুমাত্র আপদকালীন সময়ের জন্য সামরিক বাহিনীতে তাঁর ডাক পড়বে, নিয়মিতভাবে থাকার যোগ্য ছিলেন না। কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট Emmanuel Macron তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতাও অসাধারণ। তা হতেই পারে। রাষ্ট্রনায়ক হতে গেলে বড় ডিগ্রি থাকতে হবে, তা নাও হতে পারে, কিন্তু তাকে মেধাবী হতে হবে, বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে। করোনা অন্ততঃ এই শিক্ষাটা পৃথিবীর মানুষকে দিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর অনেক কিছুই পালটে যাবে এরপর, হয়ত এটাও মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে কাকে তাঁরা নেতা নির্বাচন করবে।

Manual4 Ad Code

ড. সুশান্ত দাস: অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), শা বি প্র বি

পলিটব্যুরো সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code