বিজ্ঞানকে মানুষের চেতনার অংশ হতে হবে

প্রকাশিত: ৫:২৫ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৮, ২০২০

Manual6 Ad Code

ড. সুশান্ত দাস, ২৮ এপ্রিল ২০২০ : (১) আজ অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মনে বলতে হচ্ছে, দেশের অন্যতম একজন শ্রেষ্ট সন্তান, বড় অসময়ে আমাদের ছেড়ে গেলেন। তিনি জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী।

ড. সুশান্ত দাস

Manual8 Ad Code

তার সংগে আমার দেখা হয়েছে অনেকবার, কিন্তু কথা হয়েছে দু’একবার। গণিত অলিম্পিয়াডের সুবাদে। আমি নিজেও একসময় প্রয়াত প্রফেসর ড. গৌরাঙ্গ দেবরায়, প্রফেসর ড. জাফর ইকবাল, প্রফেসর ড. ইয়াসমিন হক সহ গণিত অলিম্পিয়াডের শুরুর দিকে ঘনিষ্টভাবে জড়িত থাকায় স্যারের সঙ্গে আলাপচারিতার সুযোগ হয়েছে। তাঁর মৃদু অথচ দৃঢ়ভাবে কথা বলা, অসম্ভব শালিনতায় বিরুদ্ধ বক্তব্য উপস্থাপন করার অভ্যাস আমাকে বিস্মিত করতো। কোন ধরণের ভান বা নিজেকে অযথা প্রকাশ করার ইচ্ছে তাঁর কখনই ছিল না। আমাদের অত্যন্ত স্নেহাস্পদ মুনীর হাসান, যে স্যারের ছাত্র (সরাসরি কি না, আমার সঠিক জানা নেই) অসম্ভব যোগ্যতায় স্যারকে গণিত অলিম্পিয়াডের সংগে যুক্ত রেখেছিলেন। আজকে যে সে আর সবারই মত অসম্ভব আঘাত পাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সব শেষে বলতে হয়, বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে পদ্মাসেতু যদি মাইলফলক হয়, তাহলে জামিলুর রেজা স্যার তার অন্যতম রূপকার। প্রকৌশল বিদ্যায় তার অনেক অবদান আছে, তা স্বত্বেও পদ্মাসেতু তাঁর প্রকৌশল জ্ঞানের জীবন্ত প্রতীক। সবশেষে, যা বলবো তা হলো, তিনি ছিলেন অত্যন্ত শালীন একজন পরিপূর্ণ বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। আজ তাই যে বিষয়টি লিখতে চাই, তা শুরু করার আগে তাঁর প্রতি আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করছি।

Manual1 Ad Code

(২)
মানুষের মধ্যে যে কোন রোগ সম্পর্কে সাধারণ বৈজ্ঞানিক ধারণা রোগ বিস্তার প্রতিরোধের জন্য অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষই সব কিছুর নিয়ামক ও নির্ধারক হয়ে ওঠে। মানুষ বিভ্রান্ত থাকলে কোন কাজই সঠিকভাবে করে ওঠা যায় না। আমরা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে শুরু করতে পারি। বৈজ্ঞানিকভাবে জানা তথ্য অনুযায়ী করোনা প্রতিরোধের প্রধান অস্ত্র যা ছিল বা আছে তাহলো, যারা আক্রান্ত তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। একটি সহজ ও সাধারণ সত্য। কারণ আমাদের কাছে করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত বিজ্ঞানসম্মত যে তথ্য আছে, তার ভিত্তিতে এটা স্পষ্ট, এই ভাইরাস এতটাই সংক্রামক যে সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে আক্রান্ত হওয়া থেকে মুক্ত থাকা প্রায় অসম্ভব। এই সহজ বৈজ্ঞানিক সত্যটা সবার কাছে পরিষ্কার জানা থাকলে, সকল মানুষ নিজের ইচ্ছেয় তার কি করা উচিত, তা নির্দিষ্ট করে নিতে পারেন। কিন্তু আমরা দেখলাম, এই সহজ বৈজ্ঞানিক তথ্যটি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণা পরিষ্কার না থাকায়, ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা সর্বত্রই সাধারণ মানুষ এমন ব্যবহার করেছেন, যার ফলে সংক্রমন দ্রুত বেড়ে গেছে। ইউরোপ, আমেরিকার মানুষেরা এমন জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত যে, নিজের কর্মক্ষেত্র বাদেও তাঁরা পণ্য বিপণীকেন্দ্র, পাব, বার, ক্লাব, পার্ক, বীচ সর্বত্র যেতে অভ্যস্ত। এটা তাদের জীবনের অংশ। যখন করোনা ভাইরাস তাঁদের দৈনন্দিন অভ্যস্ত জীবনের বিরুদ্ধে হানা দিল, তাঁরা আজব ব্যবহার শুরু করলেন। অতি শিক্ষিত ব্যক্তিরাও অতি প্রচলিত এবং কথিত ‘সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং’ বা দূরে থাকার পদ্ধতিটাকে মেনে নিতে পারলেন না। বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী তিনি নিজেও এর অন্তর্নিহিত অর্থটাকে আমল না দিয়ে, করোনা আক্রান্ত রোগির সংগে হাত মেলালেন, এবং তা প্রকাশ্যে মিডিয়াতে বলে দিলেন। এই বোধের অভাবেই সাধারণ মানুষও সরকারের সিদ্ধান্তটাকে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত মনে করে কেউ মানলেন, কেউ গোপনে ভাঙলেন। গোটা ইউরোপ, আমেরিকা যেখানে শিক্ষার হার শতভাগ, সেখানেও মানুষ এই সহজ শিক্ষাটাকে আত্মস্থ করতে ব্যর্থ হলেন। পরিণতি ভয়াবহ হলো।
যদি এশিয়ার দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, এশিয়ার মানুষ ধর্মপ্রাণ, ধর্মভীরু, অনেকক্ষেত্রে ধর্মান্ধও আছেন। এখানে সকল ধর্মের কতকগুলো দৈনন্দিন আচার আচরণ আছে। সেগুলোকে তাঁরা মন থেকে গভীরভাবে জীবনের অংশ হিসেবে নেন। করোনা ভাইরাস সংক্রমন তাঁদের সেই আচার ব্যবহারে আঘাত করলো। তাঁরা বিচিত্র ব্যবহার শুরু করলেন। অনেকে আবার সুযোগ বুঝে তাকে উছকেও দিলেন। এটা আজ পৃথিবীর সকলেরই জানা যে, দক্ষিণ কোরিয়া করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে যে দেশগূলো সফল হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রথম সারির একটি দেশ। সেখানেও একজন মহিলা গির্জায় যাবার ফলে তিনি ‘super spreader’ বা ‘অতিসংক্রমনকারি’ তে রূপান্তরিত হয়েছেন। ফলে দক্ষিণ কোরিয়ায় দ্রুততার সংগে করোনা বিস্তার লাভ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে (বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ) সকল ধর্মের মানুষরাই তাঁদের ধর্মীয় স্থানে ভীড় করেছেন। এখানে সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে ধর্মীয় আচার পালনে তাঁরা শুধু অভ্যস্ত নন, করণীয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এটা তাঁরা তাঁদের জীবনাচরণের অংশ মনে করেন। সেখানে করোনার উপস্থিতি তাঁদের বিশ্বাসের উপর আঘাত দিয়েছে। কিন্তু করোনার বিরুদ্ধে লড়াইএ বিজ্ঞান যখন বলছে, এটা করা যাবে না, এটা বিজ্ঞানসম্মত না, তখন তাঁরা সরাসরি বিজ্ঞানকেই চ্যালেঞ্জ করেছেন। এমনকি ধর্মীয় গ্রন্থে এই ধরণের মহামারিতে যে কাজগুলো করতে বলা হয়েছে, করতে নিষেধ করা হয়েছে, সেগুলোও তাঁরা স্মরণে আনতে পারছেন না। আগেই বলেছি, অনেকে বিভিন্ন উছিলায় মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পেরেছে, বিজ্ঞানসম্মত কাজটা না করতে। তার ফলাফল কতটা তা বুঝতে সময় লেগেছে, কিন্তু ইতিমধ্যে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।
আবার দক্ষিণ এশিয়ায় দারিদ্র, ক্ষুধা একটি অন্তরায়। ক্ষিদে থাকলে কোনও জ্ঞানই কাজে দেয়না। আমার এক শ্রমিক বন্ধু বহুকাল আগে বলেছিলেন, ‘বোঝা মাথায় নিলে সমাজতন্ত্র পেটে চলে আসে মাথায় থাকে না’ ( একজন খেটে খাওয়া মানুষের অসাধারণ দার্শনিক উক্তি) ।(আমি দুঃখিত আমার সেই বন্ধুটির নাম আমি আগে বলিনি। পরে ভাবলাম, তার নামটা বলা উচিত। তাঁর নাম আয়ুব আলী। তিনি খুলনা দৌলতপুর জুটপ্রেস শ্রমিকদের নেতা ছিলেন। ৭০ এর দশকের মাঝামাঝিতে। আমি তখন ঐ এলাকায় শ্রমিকদের মধ্যে সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী ছিলাম। উনি জীবিত আছেন, কিন্তু অসুস্থ।) ফলে এ অঞ্চলের মানুষ ক্ষিদের জ্বালাতেও বৈজ্ঞানিক এই সত্যটাকে মেনে চলতে পারেননি। এই সত্যটাকে বিবেচনা না করে তো তার সামনে সত্যের সবক দিলে তার কাছে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আমাদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় আচরণে একটা বড় সমস্যা হলো আমরা জনগণের আস্থাটাকে গৌণ করে অনেক সময় উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখি। জোর করে চাপিয়ে দিয়ে কোন কাজ করাটাকেই আমাদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় আচরণে প্রধান দিক হয়ে ওঠে। এবারে একটি ব্যতিক্রমের কথা উল্লেখ করতে চাই। পুলিশ প্রশাসন মানেই মানুষের কাছে সাধারণ চিত্র হলো তাঁরা জোর করে কাউকে দিয়ে করাবেন, তা ন্যায্য হোক আর অন্যায্য হোক। এটা সাধারণ ধারণা ( পারসেপশন)। (এ ধারণা করাটা ঠিক না বেঠিক তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে এটা আছে)। এই করোনার দুর্যোগের সময় এর একটি ব্যতিক্রমও চোখে পড়েছে। আমাদের দেশের পুলিশ প্রশাসন সাধারণ মানুষের ভালবাসা বা আস্থা পেয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে তা ভালভাবে প্রচারিত হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের সদস্যরা প্রচলিত ব্যবহারের গন্ডির বাইরে এসে মানুষের সংগে মানবিক আচরণ করেছেন। (বাইরের দেশে বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া পুলিশ সেই আচরণ করে)। সেনা সদস্যরাও তাই করেছেন। পুলিশ বলতে মানুষের মনে যে বিপরীত চিন্তা কাজ করে তার অনেকটারই ব্যতিক্রম মানুষের চোখে পড়েছে। অনেক জায়গায় পুলিশ সদস্যরা গান করেছেন, বয়স্ক মানুষদের ত্রান নিজে হাতে এগিয়ে দিয়েছেন। রাস্তায় অভাবী মানুষকে নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়েছেন, নিজেদের উদ্যোগে ত্রান দিয়েছেন। এগুলো মানুষের মনে দাগ কেটেছে। প্রসঙ্গক্রমে আর একটি বিষয়ে বলা যায়। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি আমাদের সমাজে ইতিবাচক মনোভাব নেই। কেন নেই তার বিশ্লেষণ অন্যত্র হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এটাই সত্য। আগেই বলেছি একে বলে ‘ general perception’ বা সাধারণ ধারণা। এটা সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। কিন্তু, তার অর্থ কি এই যে, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মিদের ছাড়া দেশ চলছে বা চলবে? তাঁরা তো একটি সভ্য সমাজের অপরিহার্য্য ও অতি প্রয়োজনীয় অংশ। হাজার হাজার বছরের চেষ্টায় রোগ ব্যাধি, জরা থেকে বাঁচার জন্য মানুষের নিরলস চেষ্টায় গড়ে উঠেছে এই স্বাস্থ্যব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা যতটা পাকাপোক্ত এবং জনমানুষের কাছাকাছি থাকবে ততটাই জীবন সহজ ও সুস্থ হয়ে উঠবে। করোনা মহামারি এটাকে আরো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। ডাক্তার নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী তাঁরা পেশাদার ব্যবসায়ী নন। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ কিউবার ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীরা। এটা শুধু তাদের ব্যক্তি মানুষগুলোর বিরাটত্ব নয়। বরং যে নীতি বা পদ্ধতি তাদের গড়ে তুলেছে, এটা সেই সমাজব্যবস্থার দান। এটা এখন কিউবার মানুষের জীবনবোধের অংশ। তাই চেতনাকে তাঁরা অনুসরণ করেন, ধারণ করেন অবলীলায়। বোধহয় তাই তা করতেই হবে আগামী সভ্যতাকেও। নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাধারণ ধারণা যতটা সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিস্কারভাবে যাবে, বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে মানুষের বাস্তব প্রয়োজনটাও দৃশ্যমানভাবে মেটানো যাবে, বিজ্ঞানকে দূরের বস্তু নয়, জীবনাচরণের অংশ হিসেবে প্রস্তুত করা যাবে, মানুষ ততটাই বিজ্ঞানকে ধারণ করে যে কোন অশুভ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে নিজেকে দাঁড় করাতে পারবে শক্তভাবে।
মানুষ, মানুষ এবং মানুষই সভ্যতার শেষ কথা। মানুষ যতটা বিজ্ঞানমনস্ক হবে, ততটাই মানুষ তার জীবন, বিশ্বাস ও সামাজিক আচরণে যুক্তিসিদ্ধ হয়ে উঠবে। বিজ্ঞানমনস্কতাকেও ধৈর্যধরে মানুষের চিরাচরিত বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে। একটানে বিজ্ঞানকে তার বিপরীতে ও বিরুদ্ধে দাঁড় করালে বিজ্ঞানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মানুষও তাকে গ্রহণ করতে চাইবে না। এটা মনে রাখতে হবে, মানুষ যখন বিজ্ঞানকে নিজস্ব চেতনা দিয়ে গ্রহণ করে, তখন বিজ্ঞানও সমৃদ্ধ হয়, মানুষও সমৃদ্ধ হয়। তখন সভ্যতা এগিয়ে চলে। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।

Manual4 Ad Code

সুশান্ত দাস: অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), শা বি প্র বি

পলিটব্যুরো সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code