এলিট বাঙালির বুর্জোয়া জ্ঞান নয়, বাংলাদেশে স্বাধীনতা এনেছে কৃষকের নিম্নবর্গীয় জ্ঞান

প্রকাশিত: ৭:৪৮ অপরাহ্ণ, মে ৩, ২০২০

Manual7 Ad Code

মইজ আবদুল মাজিদ, ০৪ মে ২০২০ : এলিট বাঙালির বুর্জোয়া জ্ঞান নয়, বাংলাদেশে স্বাধীনতা এনেছে কৃষকের নিম্নবর্গীয় জ্ঞান। সালমান রুশদির মিডনাইটস চিলড্রেন উপন্যাসের কেন্দ্রীয়

গেরিলা যোদ্ধা

চরিত্র সালিম সিনাইকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। তাদের দায়িত্ব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করা। কিন্তু বাংলাদেশে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিজেরই হারিয়ে যাওয়ার দশা হয়। বর্ষায় প্রতিকূল হয়ে ওঠা অসংখ্য নদীনালা, খাল-বিলের মধ্যে পথ করে চলতে গিয়ে তাদের মনে হয় যেন স্বয়ং প্রকৃতিই তাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে, রীতিমতো পাগল হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের অভিজ্ঞতার যে বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন রুশদি, তাতে উঠে এসেছে- গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াইয়ের পাশাপাশি তাদের এখানকার পরিবেশ বা বাস্তুসংস্থানের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

মুক্তিবাহিনী নামে পরিচিত এই যোদ্ধারা শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। আর এই মুক্তিবাহিনীতে দুটি ভিন্ন শ্রেণির জনগোষ্ঠী ছিল। একটা হলো শহরের এলিট সম্প্রদায়, যারা মূলত আওয়ামী লীগের সদস্য, মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব স্থানীয় ও বড় বড় পদে তারাই ছিলেন।

আরেকটি হলো, গ্রামের সাধারণ কৃষক শ্রেণি। তাদের অনেককেই মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তুলতে ওই এলিট শ্রেণিটি প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সারা জীবন ধরে বাংলাদেশের খাল-বিল, নদী-নালায় ভরা অঞ্চলগুলোতে বসবাস করার কারণে, এই কৃষকদের এগুলো খুব ভালো করেই চেনা। কতটা গভীর জঙ্গল আর জলাভূমি দিয়ে ঘেরা এসব নদী নালা, কেমন জটিল তার গোলকধাঁধা তাও তারা ভালোই জানে। বাস্তুসংস্থানগত এই গভীর জ্ঞানকেই কৃষক-চাষাদের নিয়ে গড়া গেরিলা যোদ্ধারা কাজে লাগিয়েছিল।

Manual7 Ad Code

পাকিস্তানি সেনাদের আ্যমবুশ করতে কৌশলগত অঞ্চল খুঁজে বের করেছিল তারা, আর এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ সফল হয়েছিল। অর্থাৎ, স্বাধীনতার সংগ্রামে মুক্তিবাহিনী বাস্তুসংস্থানকেই মুক্তির পথে রূপান্তরিত করেছিল, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য যা পরিণত হয় হতবুদ্ধি করা এক গোলকধাঁধায়।

বাংলাদেশের জলপথ

বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত, বিশ্বের মধ্যে যা সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ। আর এর মধ্যে রয়েছে অসংখ্য জলাভূমি, জঙ্গল আর জালের মতো ছড়িয়ে থাকা হাজারো নদ-নদী, খাল-বিল আর ঝরনা। এমনকি বাংলাদেশে স্থলপথের চেয়েও জলপথ বেশি, তার মানে হলো মানুষ তাদের প্রাত্যহিক জীবনে এই জলপথের ওপরেই বেশি নির্ভরশীল। স্কুলে যাওয়া, কাজে যাওয়া কিংবা ঘরে ফিরতে তারা এই জলপথগুলো ব্যবহার করে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বানানো বহু চলচ্চিত্রেও দেখা যায়, এখানকার মানুষের চলাচল এই সব জলপথের ওপর কতখানি নির্ভরশীল। যেমন এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ (১৯৫৯) সিনেমায় দেখা যায়, বাজারে যাওয়ার একমাত্র পথ এই জলপথ। অনেক সময় কোনো একটি গ্রামের সঙ্গে শহরের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যমও জলপথ। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং জীবিকা উপার্জনের জন্য নৌকার মালিকানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা এই সিনেমার গল্পের অন্যতম উপজীব্য।

Manual2 Ad Code

নদীপথে চলাচলের জটিলতাগুলোও বিভিন্ন চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে। তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘মাটির ময়না’ (২০০২) সিনেমায় আমরা দেখি, কীভাবে একটার পর একটা নৌকা বদলে, মূল পথ থেকে বিকল্প পথে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়।

Manual5 Ad Code

গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা

১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো আর বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা শুরু হলো, তখন তাদের হামলা থেকে বাঁচতে পালিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য একটি বড় স্বস্তির জায়গা, নিরাপদ উপায় ছিল এই সব জলপথ, আর তা ঘিরে থাকা জঙ্গলগুলো। একই সঙ্গে, পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে পাল্টা লড়াই চালাতেও কৃষকরা এই স্থানগুলোকেই বেছে নেয়।

জটিল গতিপথের কারণে এসব জলপথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় সহায়ক হয়ে ওঠে। আর এই নদীপথ সম্পর্কে নিজেদের জ্ঞানকে তারা ব্যবহার করে, পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে কৌশলগত সুবিধা হিসেবে। এই বিশেষ জ্ঞান, মুক্তিযুদ্ধে সফল হতে তাদের বড় ধরনের সাহায্য করেছিল।

দেশের ভূ-প্রকৃতি থেকে যতখানি সুবিধা বের করে নেয়া যায়, গেরিলারা তার সবই করেছিল। জলপথ ও জঙ্গলগুলোকে তারা একই সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলা থেকে পালাতে এবং সময় সুযোগ বুঝে অতর্কিতে পাল্টা হামলা চালাতে কাজে লাগিয়েছে।

Manual3 Ad Code

২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রে আমরা খুব পরিষ্কারভাবেই এ বিষয়টি দেখতে পাই। সিনেমাটির বিভিন্ন দৃশ্যে দেখানো হয়েছে কীভাবে জঙ্গলকে ক্যামোফ্লেজ হিসেবে ব্যবহার করেছে মুক্তিবাহিনী, দক্ষতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পোস্টে হামলা চালিয়েছে, তাদের অস্ত্র-গোলাবারুদ কেড়ে নিয়েছে। শুধু তাই না, এই সব জলপথেই নিজেদের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে এসেছে মুক্তিবাহিনী, পাক বাহিনীর অগ্রযাত্রা ঠেকাতে সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। এমনকী, অস্ত্রবাহী সাঁতারু আর ফ্রগম্যানদের নিয়ে গড়া আলাদা একটি বিভাগই ছিল মুক্তিবাহিনীতে, যারা জলপথে পাকিস্তানিদের ওপর আ্যমবুশ চালাতো।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রচলিত বর্ণনায় অবশ্য বাস্তুসংস্থান এবং এ বিষয়ে কৃষকদের গভীর জ্ঞান বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তা খুব একটা উঠে আসেনি। দেশের জল-মাটি-কাদার প্রতি নিজেদের ভালোবাসা এবং জ্ঞানকে, মুক্তির প্রধান হাতিয়ার করে তুলেছিল কৃষকরা। এলিট বাঙালি আর তাদের বুর্জোয়া জ্ঞান নয়, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে সাধারণ কৃষক আর তাদের এই নিম্নবর্গীয় জ্ঞান।

লেখক: মইজ আবদুল মাজিদ, পাকিস্তানি গবেষক। অনুবাদ: মোহাম্মাদ সাঈদ জুবেরী চিশতী।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code