সিলেট ১০ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:১১ পূর্বাহ্ণ, জুন ৩০, ২০২০
|| ফজলুল বারী || সিডনি (অস্ট্রেলিয়া), ৩০ জুন ২০২০ : রনো ভাইর খবর শুনে বিচলিত বোধ করছি। প্রিয় হায়দার আকবর খান রনো। বাংলাদেশের একজন স্বনামখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার পর তাঁকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে।
খবরটায় বিচলিত বোধ করার কারন তাঁর পুরনো শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। তিনি সব সময় গাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে চলতেন। আর করোনা ভাইরাসতো শ্বাসকষ্টেরই এক মরনঘাতী রোগ।
আমি তাকে অনেক ভালোবাসি শ্রদ্ধা করি। কারন আমার দেখা তিনি একজন সৎ মানুষ। পড়াশুনা করা রাজনীতিক। পড়াশুনা জানা পড়াশুনা করা সৎ রাজনীতিক এখন দেশে খুব বেশি নেই। তাঁর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি।
ঢাকায় সাংবাদিকতা শুরুর প্রথম দিকের অনেক স্মৃতি। ছোটন ভাই তাঁর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন। আমাদের সময়ের ঢাকার সাংবাদিকদের প্রিয় একজন মানুষ।
তখন সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ আমল। এরশাদের হুলিয়া মাথায় যারা আত্মগোপন করে ছিলেন এমন নেতাদের খুঁজে খুঁজে আমি তখন ইন্টারভ্যু করছিলাম। আর এ কাজে আমাকে সহায়তা করছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির তৎকালীন নেতা ছোটন ভাই।
ওই সময় আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা হাসানুল হক ইনুর পর আমি রনো ভাইর ইন্টারভ্যু করি তখন। সেই সম্পর্ক পরে মুগ্ধতার উচ্চতায় পৌঁছে। ধানমন্ডির বত্রিশ নাম্বারের বাড়ির কয়েক বাড়ি পরেই রনো ভাইদের বাড়ি।
তাঁর বাবা পাকিস্তান আমলের গুরুত্বপূর্ন প্রকৌশল দায়িত্বে ছিলেন। ছোটন ভাইর সঙ্গে সে বাড়িতে গেলেই খেয়ে দেয়েও আসতাম। ঢাকার প্রথম জীবনে যে কয়েকটা ডাইনিং টেবিল খাবার জন্যে বিখ্যাত ছিল রনো ভাইদের বাড়ি এর একটি।
তাঁর মুক্তিযোদ্ধা ভাই জুনো ভাই তখন ব্যবসা করতেন। আর রনো ভাই, তাঁর স্ত্রী হাজেরা সুলতানা করতেন রাজনীতি। তাদের একমাত্র মেয়ে রানা তখন অনেক পিচ্চি। জুনো ভাইর মেয়ে পুতুলও আমাদের বন্ধু।
রানা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। স্বামী-সন্তান সহ কানাডায় থাকে। আপাতত রনো ভাইর সঙ্গে আমার যোগসূত্র তৈরি করেছে রানা। কিন্তু এবার তাঁর অসুস্থতার খবর পাই পত্রিকায়। বুকটা কেঁপে আসে।
তখন আমি প্রায় দেখতাম রনো ভাই হাজেরা আপা তাদের মা-শাশুড়ির কাছ থেকে রিকশা ভাড়া নিয়ে সকালে বাসা থেকে বেরুতেন ওয়ার্কার্স পার্টির অফিসের উদ্দেশে। আমি তাদেরকে নিয়ে মজা করতাম।
তাদেরকে বলতাম মায়ের কাছ থেকে রিকশাভাড়া হাতখরচ নিয়ে কেউ প্রতিদিন বিপ্লব করতে বেরোয়, এমন আমি আগে দেখিনি। রনো ভাই তখন সরল হাসি হাসতেন। তোপখানা রোডের পাশাপাশি দুই গলিতে অনেকগুলো রাজনৈতিক দলের অফিস।
এরশাদের বিরুদ্ধের আন্দোলনের তিন জোটের লিঁয়াজো কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন রনো ভাই। সে জন্যে তাঁর সঙ্গে মাঝে মাঝে বসলে লেখার খোরাক পেয়ে যেতাম। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি দেয়া হয়।
এই কর্মসূচিকে ঘিরে ঢাকায় তখন বিশেষ উত্তেজনাকর অবস্থা। ঢাকার বাইরে থেকে যাতে তিন জোটের নেতাকর্মীরা আসতে না পারেন এরজন্যে বাস-ট্রেন-লঞ্চ সবকিছুর চলাচল বন্ধ করে দিয়ে নিজে নিজেই ঢাকাকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে স্বৈরাচার।
কিন্তু ১০ নভেম্বরের পরে কী? ১০ নভেম্বর কী কর্মসূচি ঘোষনা করা হবে তা বলছিলোনা রাজনৈতিক তিন জোট। তখন বিএনপির হয়ে লিয়াজো কমিটির বৈঠকে আসতেন মাগুরার মাজেদুল হক।
পাঁচদলের পক্ষে রনো ভাইও থাকতেন। আমি দেখা হলেই তাঁকে জিজ্ঞেস করি, বলেননা ভাই। ১০ নভেম্বরের পরে কী? রনো ভাই আমাকে বলেন, ‘ফজলুল বারী, আমরা পরীক্ষার আগের রাতে পড়াশুনা করে পাস করা ছাত্র।
তাই দেখবেন, আমাদের কর্মসূচিরও অভাব হবেনা’। সেই ১০ নভেম্বরেই শহীদ হন নূর হোসেন। রোদের অক্ষরে লেখা এক নাম। বুকে স্বৈরাচার নিপাত যাক, পিঠে গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে জীবন্ত পোষ্টার হয়ে মিছিলে এসে প্রান দেন নূর হোসেন।
সত্যি সত্যি এরপর কর্মসূচির অভাব হয়নি। নূর হোসেনকে হত্যার পর থেকে একদিনের জন্যেও শান্তিতে ছিলোনা এরশাদ। এখনও শান্তিতে নেই। এখনও এ দলটির না ঘরকা না ঘটকা অবস্থা! তার পালিত ছেলেও এখন রংপুরে গিয়ে আক্রান্ত হয়।
আর নূর হোসেনের কথা মনে হলেই আমার রনো ভাইর কথা মনে পড়ে। আমাকে বলা তাঁর সেই কথাও মনে পড়ে যায়, ‘ফজলুল বারী, আমরা পরীক্ষার আগের রাতে পড়াশুনা করে পাস করা ছাত্র।
তাই দেখবেন, আমাদের কর্মসূচিরও অভাব হবেনা’। আমার সেই রনো ভাই পরে ওয়ার্কার্স পার্টি ছেড়ে সিপিবিতে যোগ দিয়েছেন। তবে অনেকদিন রাজনীতির চেয়ে পড়াশুনা আর লেখালেখিতে ব্যস্ত ছিলেন।
প্রায় অসুস্থ থাকেন বলে অনেক দিন তাঁর সঙ্গে কথাও হয়না। তিনি যে গাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে চলেন এটি ছোটন ভাই বলেছিলেন বছর দুই-তিন আগে। এমন একজন বয়স্ক অসুস্থ ভালো মানুষ করোনায় আক্রান্ত হবার খবরে ভয় করেছে।
প্রিয় রনো ভাই, আপনার জন্যে আমরা প্রার্থনা করছি। ফিরে আসুন ভাই। আমাদের আরেকজন রনো ভাই নেই। প্লিজ।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D