বৈরুত বিস্ফোরণ: সবশেষ যা জানা যাচ্ছে

প্রকাশিত: ৫:২২ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৭, ২০২০

বৈরুত বিস্ফোরণ: সবশেষ যা জানা যাচ্ছে

Manual5 Ad Code

বৈরুত (লেবানন), ০৭ আগস্ট ২০২০ : লেবাননে উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তুপের নিচে জীবিত কেউ আছে কিনা তার সন্ধানে এখনও কাজ করছে। মঙ্গলবার চৌঠা অগাস্ট বিধ্বংসী বিস্ফোরণে অন্তত ১৩৭ জন মারা গেছে এবং আহত হয়েছে আরও প্রায় ৫০০০ মানুষ।

এখনও পর্যন্ত যা জানা যাচ্ছে।

কী ঘটেছিল?

বিধ্বংসী বিস্ফোরণের ঠিক আগে শহরে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে বৈরুত বন্দরে একটা বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যায় বন্দরে যে বিশাল শস্যের গুদাম আছে তার পাশে ১২ নম্বর গুদামঘর থেকে সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলি উঠছে।

স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ছয়টার (গ্রেনিচ মান সময় বিকাল তিনটা) অল্প পরেই গুদামঘরের ছাদে আগুন ধরে যায় এবং প্রথমদিকে একটা বড় বিস্ফোরণ ঘটে। এর পরপরই ছোট ছোট কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটে। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন শুনে মনে হচ্ছিল আতসবাজি ফুটছে।

প্রায় ৩০ সেকেন্ড পরেই, একটা বিশাল ও ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে এবং আকাশে বিশাল একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলি উঠতে দেখা যায়। সেইসঙ্গে শহরের সর্বত্র বিস্ফোরণের ভয়ানক কান ফাটানো তীব্র শব্দ শোনা যায়।

ওই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে বন্দরের কাছের বাড়িগুলো মাটিতে মিশে যায় এবং রাজধানীর বাদবাকি অংশের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। রাজধানীতে বাস করেন বিশ লাখ মানুষ। হাসপাতালগুলো আহতদের ভিড়ে উপচে পড়তে শুরু করে। আহতদের শুশ্রূষা দিতে তাদের হিমশিম খেতে হয়।

“আমরা চোখের সামনে একটা মহা বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করছি,” বলেন লেবানীজ রেড ক্রসের প্রধান জর্জ কেত্তানি। “সর্বত্র শুধু নিহত এবং আহত মানুষ।”

বৈরুতের গর্ভনর মারওয়ান আবুদ বলেন ৩ লাখের মত সাময়িকভাবে গৃহহীন হয়েছেন এবং ক্ষয়ক্ষতির সার্বিক পরিমাণ এক হাজার থেকে দেড় হাজার কোটি ডলার হতে পারে।

Manual6 Ad Code

বিস্ফোরণ কত বড় ছিল?

বিশেষজ্ঞরা এখনও এই বিস্ফোরণের আকার বা মাত্রা নির্ণয় করেননি, তবে এই বিস্ফোরণের ধাক্কায় বৈরুত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের যাত্রী টার্মিনাল ভবনের জানলার কাঁচ ভেঙে গেছে। ঐ টার্মিনাল ভবন বন্দর থেকে প্রায় ৯ কিমি (৫ মাইল) দূরে।

বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে ২০০ কিমি (১২৫ মাইল) দূরে ভূমধ্যসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্র সাইপ্রাস থেকে।

আমেরিকার ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের ভূকম্পন বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই বিস্ফোরণ রিক্টার স্কেলে ৩.৩ মাত্রার ভূমিকম্পের মত জোরালো ছিল।

কারণ কী ছিল

Manual1 Ad Code

লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন, এই বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করেছেন ২৭৫০টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটকে, যা বন্দরের একটি গুদামঘরে অনিরাপদভাবে মজুত করে রাখা হয়েছিল বলে তিনি বলেছেন।

Manual1 Ad Code

মলডোভিয়ার পতাকাবাহী মালবাহী জাহাজ এমভি রোসাস এই একই পরিমাণ রাসায়নিক- অর্থাৎ ২৭৫০টন রাসায়নিক নিয়ে ২০১৩ সালে বৈরুত বন্দরে নোঙর করে। জর্জিয়া থেকে জাহাজটি যাচ্ছিল মোজাম্বিকে এবং কারিগরি ত্রুটি দেখা দেয়ার কারণে সেটি বৈরুতে নোঙর করে।

রোসাস জাহাজটি পরিদর্শনের পর সেটিকে ওই বন্দর থেকে যাবার অনুমতি দেয়া হয়নি। এর কিছুদিন পরে জাহাজের মালিক জাহাজটি সেখানে পরিত্যাগ করে চলে যায় বলে জানাচ্ছে শিপঅ্যারেস্টেডডটকম। আদালতের নির্দেশে ওই জাহাজের মালামাল ১২ নম্বর গুদামঘরে চালান করা হয়। ওই গুদামে মজুত রাসায়নিক নষ্ট করে ফেলার বা বিক্রি করে দেবার কথা ছিল।

অ্যামেনিয়াম নাইট্রেট স্ফটিকের মত সাদা কঠিন পদার্থ যা কৃষিকাজে নাইট্রোজেনের উৎস হিসাবে সারে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। তবে এই রাসায়নিক জ্বালানি তেলের সাথে মিশিয়ে বিস্ফোরক তৈরি করা হয়, যা ব্যবহার করা হয় খনির কাজে এবং নির্মাণ শিল্পে। জঙ্গীদের অতীতে এই রাসায়নিক ব্যবহার করে বোমা বানানোর নজিরও আছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট তুলনামূলকভাবে নিরাপদ একটা রাসায়নিক যদি তা সঠিকভাবে নিরাপদে গুদামজাত করা হয়। অবশ্য প্রচুর পরিমাণে এই রাসায়নিক দীর্ঘদিন মজুত রাখলে তা নষ্ট হতে শুরু করে।”মূল সমস্যা হচ্ছে দীর্ঘ দিন পড়ে থাকলে এই রাসায়নিক বায়ুমন্ডলের বাষ্প শোষণ করে এবং এটা ক্রমশ পাথরে পরিণত হয়,” বলছেন লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের রসায়নের অধ্যাপক অ্যানড্রিয়া সেলা। সেটা এই রাসায়নিককে আরও বিপদজনক করে তোলে কারণ ওই অবস্থায় তাতে যদি কোন ভাবে আগুন ধরে যায় তা খুবই তীব্র ও ভয়াবহ রূপ নেয়।

অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে বড় বড় মারাত্মক শিল্প দুর্ঘটনা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ২০০০টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বহনকারী একটি জাহাজ টেক্সাসে বিস্ফোরিত হয় এবং ঐ ঘটনায় ৫৮১জনের মৃত্যু হয়। বৈরুত বন্দরের আগুন থেকে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটে বিস্ফোরণ হয়েছে।

Manual5 Ad Code

লেবাননের সংবাদমাধ্যম এলবিসিআই এবং রয়টার্স বার্তা সংস্থা বিভিন্ন সূত্রকে উদ্ধৃত করে খবর দিচ্ছে যে ১২ নম্বর গুদামঘরের ভেতর একটি গর্ত মেরামতের জন্য ঝালাইয়ের কাজ করার সময় সেখানে আগুন লাগে।

বন্দরের জেনারেল ম্যানেজার, হাসান কোরেয়তেম নিশ্চিত করেছেন যে বিস্ফোরণের আগে গুদামঘরের দরোজায় কিছু মেরামতের কাজ চলছিল।

রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিভাগ থেকে আমাদের গুদামের একটা দরোজা ঠিক করতে বলা হয়েছিল এবং সেদিন দুপুরে সেই কাজ আমরা করেছিলাম। এরপর বিকেলের দিকে সেখানে কী হয়েছিল আমি বলতে পারব না, ওটিভি নামে একটি টিভি চ্যানলকে তিনি একথা বলেন বলে খবর দেয় সিএনএন।

হতাহত

যে ১৩৭ জন মারা গেছেন তাদের বেশিরভাগই সাধারণ মানুষ। তবে এদের মধ্যে বৈরুত বংশোদ্ভুত ফরাসি স্থপতি জঁ মার্ক বনফিল্স রয়েছেন। শহরে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত ভবন পুনরুদ্ধারের কাজে মি. বনফিল্স সেখানে ছিলেন। প্রথম বিস্ফোরণের পর ঘটনার খবর তিনি ফেসবুকে লাইভে প্র্রচার করছিলেন। এরপর দ্বিতীয় বিস্ফোরণে তিনি আহত হন এবং পরে মারা যান।

বিস্ফোরণের পরপরই ঘটনাস্থলে প্রথম ছুটে গিয়েছিলেন দমকল কর্মী সাহার ফারেস। তার বাগদত্ত গিলবার্ট কারান ইনস্টাগ্রামে তার হবু স্ত্রীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে লিখেছেন তার মৃত্যুতে তার হৃৎপিণ্ড পুড়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাহার ও তার আরও সাতজন পুরুষ সহকর্মীর ছবি পোস্ট করা হয়েছে। তারা সকলেই এই ভয়াবহ বিস্ফোরণে মারা গেছেন বলে বলা হচ্ছে।
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস বলেছেন জার্মান দূতাবাসের একজন নারী কূটনীতিক তার ফ্ল্যাটে মারা গেছেন।

লেবানন ভিত্তিক প্রমোদতরী কোম্পানির আবু মেরহি বলেছেন বিস্ফোরণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ওরিয়েন্ট কুইন জাহাজে দুজন মারা গেছেন এবং সাতজন আহত হয়েছেন।

একজন আমেরিকান, একজন অস্ট্রেলিয়ান এবং দুজন মিশরীয় মারা গেছেন বলে জানা যাচ্ছে।

দোষী কে?

প্রেসিডেন্ট আউন বিস্ফোরণের ঘটনার স্বচ্ছ তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

“আমরা তদন্ত চালানোর ব্যাপারে বদ্ধপরিকর এবং যত দ্রুত সম্ভব কী কারণে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে তা উদঘাটন করব। যাদের গাফিলতিতে এ ঘটনা ঘটেছে এবং যারা দায়ী তাদের কঠোর শাস্তি দেয়া হবে,” বিধ্বস্ত বন্দর পরিদর্শনের পর বুধবার তিনি একথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব যে পরিস্থিতিতে এই বিস্ফোরণ হয়েছে তা “অগ্রহণযোগ্য” বলে বর্ণনা করেছেন। মি. কোরায়েতেম এবং লেবাননের শুল্ক বিভাগের মহাপরিচালক বদরি দাহের বলেছেন সেখানে গুদামে মজুত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে বিপদের ঝুঁকি সম্পর্কে তাদের সতর্কবার্তা এবং সেগুলো সরিয়ে নেবার জন্য তাদের নির্দেশ বারবার অগ্রাহ্য করা হয়েছে।

“আমরা এই রাসায়নিকগুলো আবার রপ্তানি করে দেবার অনুরোধ জানিয়েছিলাম, কিন্ত সেটা করা হয়নি। কেন সেটা করা হয়নি সেটা এখন বিশেষজ্ঞরা এবং সংশ্লিষ্টরাই নির্ধারণ করবেন,” এলবিসিআই চ্যানেলকে বলেন মি. দাহের।

যেসব নথিপত্র অনলাইনে তুলে দেয়া হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে শুল্ক কর্মকর্তারা ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭র মধ্যে অন্তত ছয়বার বিচার বিভাগের কাছে পরামর্শ ও নির্দেশ চেয়ে চিঠি লিখেছিলে।

অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট গুদামে মজুত রাখার ব্যাপারটির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন বন্দরের যেসব কর্মকর্তা, সরকার তাদের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত গৃহবন্দী করেছে।

লেবাননের বহু মানুষ সরকারের স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতার প্রতিশ্রুতি নিয়ে সন্দিহান। তারা মনে করছেন যে রাজনৈতিক উপরমহলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও গাফিলতি এবং অব্যবস্থার অভিযোগ রয়েছে এই তদন্তের মাধ্যমে তারা এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের প্রকৃত দায় এড়িয়ে যাবারই চেষ্টা করবেন।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code