চলনবিল ট্র্যাজেডিঃ কিছু স্মৃতি, কিছু কথা ও অামার দায়

প্রকাশিত: ১:৩৪ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৩০, ২০২১

চলনবিল ট্র্যাজেডিঃ কিছু স্মৃতি, কিছু কথা ও অামার দায়

| মোশাররফ হোসেন মুসা |

মনীষীরা বহু অাগে বলে গেছেন- পৃথিবী হলো দুঃখময়; কিন্তু রাজনীতিবিদরা এটা মানতে নারাজ। তাদের বক্তব্য- পৃথিবীকে সুখময় ও শান্তিময় করার করার সামর্থ্য মানুষের রয়েছে। প্রতিবছর রোগ-শোক, দুর্ঘটনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে। কোরোনা ভাইরাসে অাক্রান্ত হয়ে একই পরিবারে তিন-চার জনের মৃত্যুর ঘটনা এ দেশেই রয়েছে। মানুষের এই সকল মৃত্যুর ভীড়ে অামাদেরও একটি দুঃখজনক ঘটনা রয়েছে। গত ২০১৮ সালের ৩১ অাগস্ট চলনবিলে বেড়াতে গিয়ে এক নৌদুর্ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনায় অামরা ৫ জন প্রিয় মানুষকে হারাই। ঘটনাটি শুনে সেদিন ঈশ্বরদীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পরিচিত ও অপরিচিত বহু মানুষ ব্যথাতুর হয়ে পড়েছিলেন। ঈশ্বরদীবাসী ঘটনাটিকে নাম দিয়েছে ‘ চলনবিল ট্র্যাজেডি’। বিশেষ করে ‘সাপ্তাহিক ঈশ্বরদী’র সম্পাদক ও দৈনিক সমকালের স্টাফ রিপোর্টার সেলিম সরদার প্রতিবছর এই দিনে ‘ চলন বিল ট্র্যাজেডি’ নামে একাধিক পত্রিকায় খবর ছেপে অাসছেন। এবার তাদের স্মরণে ৩য় মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হতে যাচ্ছে। সেদিন নৌকাযাত্রী হিসেবে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে কেউ কলাম লেখক, কেউ গবেষক, কেউ পত্রিকা সম্পাদক, কেউ গায়ক, কেউ প্রবাসী; তথা প্রায় সকলেই সমাজের সচেতন অংশের মানুষ। এ দিবসটির অাগমন ঘটলেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও সকলকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচার করতে বসে যাই। মনে মনে ভাবি- ওই ঘটনায় অামাদের সাহস, সততা, ব্যক্তিত্ব তথা চরিত্রের সকল কিছুই ফুটে ওঠেছে। যদি এমন হতো অামি স্বপন বিশ্বাসকে নৌভ্রমণে নিমন্ত্রণ করি নাই ; কিংবা তার সঙ্গে অামার কোনো পরিচয় ঘটেনি, তাহলে কি তিনি তার প্রিয় কন্যাসহ প্রাণ হারাতেন? যদি এমন হতো ডাল গবেষণা কেন্দ্রের বিল্লাল গনি প্রাতঃভ্রমনে অামার সঙ্গী হতেন না; কিংবা অামার সঙ্গে তার কোনো অালাপচারিতা হতো না, তাহলে কি তিনি তার স্ত্রীসহ মারা যেতেন?

যদি এমন হতো অাপাদমস্তক সংসারী ও ঘরমুখী অামার সহধর্মিনী শাহানাজ পারভীন পারু তার স্বভাবসুলভ মানসিকতার কারণে নৌভ্রমণে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন, তাহলে তিনিও কি পানিতে ডুবে মারা যেতেন? অাবার ভাবি, কুষ্টিয়া শহরের লোকজনকে অামি কেন বেশি গুরুত্ব দিতে গেলাম! কুষ্টিয়াবাসী হলেই যে তিনি সংস্কৃতিবান কিংবা লালন অনুসারী হয়ে যাবেন, একথা অামি কোথায় পেলাম! তাহলে অারেকজনকে দোষ দেয়া কেন! পরক্ষণেই মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠে, পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তিতে হৃদয়ে মান-অভিমান ভর করে। অাষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল হলেও ভাদ্র মাসে বৃষ্টির রেশ থেকে যায়। সেবার বৃষ্টির পরিমান কম থাকায় চলনবিলের পানি দ্রুত কমে যাচ্ছিল। চলনবিলের বিপুল জলরাশি দেখা থেকে বঞ্চিত হতে পারি- এমন অাশঙ্কা থেকে ৩১ অাগস্ট’ ১৮, তথা ১৬ ভাদ্র নৌভ্রমণের সর্বশেষ তারিখ নির্ধারণ করা হয়। কথামতো ঈশ্বরদী ও কুষ্টিয়ার মোট ২২ জন টেবুনিয়া সিএনজি স্ট্যান্ডে জড়ো হই। স্বপন বিশ্বাসের মুখে শুনলাম, তার স্ত্রী না কি স্বপ্নে মেয়েকে নিয়ে অমঙ্গল কিছু দেখে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং মেয়েকে রেখে যেতে বলেন। কিন্তু স্বপনের ইচ্ছা মেয়েকে চলনবিল দেখানোর। ওদিকে মজিদের স্ত্রী জলি ভাবীও না কি স্বপ্নে মেয়েকে ডুবে যেতে দেখেছেন। জলি অার্থাটাইটিস(বাতজ্বরের) রোগী হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। সেজন্য চলনবিলে তার যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু প্রতিবেশি খসরু না কি চুপিসারে তাকে বলেছে- ‘অাপনার মেয়েতো সাঁতার জানে না, তাকে নৌভ্রমণে পাঠাচ্ছেন কেন?’ এতে তিনি অারও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং শারীরিক কষ্ট সহ্য করে অামাদের সফরসঙ্গী হন। অামার স্ত্রীও না কি স্বপ্নে রেলদুর্ঘটনায় অামার মেজো মেয়ের উপর অমঙ্গল জাতীয় কিছু দেখেছেন। এতো গেল স্বপ্নের কথা, বাস্তবেও সেদিন অামরা ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। ভাঙ্গুড়ায় পৌঁছে সবাই যখন ওয়াশরুমে গেছেন পরিচ্ছন্ন হতে, তখন অামার স্ত্রী ভয়ে ভয়ে বলেন, সিএনজিতে বসার সময় সে নাকি অসতর্কতার কারণে চশমার একটি ডাট ভেঙ্গে ফেলেছেন। চশমাবিহীন অবস্থায় তার চলনবিলের সৌন্দর্য উপভোগের বিঘ্ন ঘটতে পারে, অামার এমন দুশ্চিন্তা দেখে গনি ভাই এগিয়ে অাসেন। তিনি ভাঙ্গুড়া বাজারের এ মাথা থেকে শেষ মাথা পর্যন্ত চশমা মেকারের খোঁজ করতে থাকেন। শেষে চশমা মেকার না পেয়ে নিজেই একটি অাইকা অাঠা কিনে চশমার ডাটটি জোড়া লাগিয়ে দেন। ঘটনাটি ক্ষুদ্র, কিন্তু তার অান্তরিকতার স্মৃতিটির কথা মনে পড়লে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত না হয়ে পারি না। সফরসঙ্গী রফিকুল ভায়ের গ্রামের বাড়ি উল্লাপাড়া হওয়ায় তাকে বিল অঞ্চলের লোক হিসেবে জানি। তিনি ও কুষ্টিয়ার সাইদুর( তার পিতা একসময় ঈশ্বরদী রেলওয়ে থানার দারোগা ছিলেন) দায়িত্ব নেন নৌকা ভাড়া করার (২০১৭ সালে অারেকটি নৌভ্রমণের সময়েও তারা দুজন নৌকা ভাড়া করেছিলেন)। প্রথমে তারা একটি নতুন নৌকা ভাড়া করার জন্য দরদাম শুরু করেন। ঘাটের চায়ের দোকানদার লুৎফর এগিয়ে এসে বলেন- ‘এই নৌকার মাঝি পথঘাট ভাল করে চিনে না, বরং ওই নৌকাটি ভাড়া করেন।’ তারা লুৎফরের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে একটি পুরাতন নৌকা ভাড়া করেন( পরবর্তীতে নৌকাডুবির কথা শুনে লুৎফর ডুকরে কেঁদে ওঠেন এবং বার বার ভুল স্বীকার করেন। কিন্তু অামাদের মধ্যে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি অাজও ভুল স্বীকার করেন নি)। কথা ছিল চলনবিল অতিক্রম করে অামরা তাড়াশ পৌছাবো এবং সড়কপথে ঈশ্বরদী ফিরে অাসবো। অামরা অানন্দ সহকারে বিল অতিক্রম করে ঠিকঠাক মতো তাড়াশ পৌছাই। সেখানে খালের ধারে সকলে নৌকাটি ছেড়ে দেয়ার পক্ষে মত দেন। কিন্তু মজিদ ও তার স্ত্রী নৌকায় বসে থাকেন। তারা বলেন- ‘অাপনারা খাওয়া-দাওয়া সেরে অাসেন, অামরা ততক্ষণ নৌকায় বসে থাকি।’ অামরা খাবার খেয়ে অাবারও নৌকায় উঠি ও জলি ভাবীকে নামানোর জন্য সমান্তরাল জায়গা খুজতে থাকি। কেউ কেউ মত দেন- যেখান থেকে উঠেছি, সেখানেই ফিরে যাই। কেউ মত দেন ধরাধরি করে তাকে নামানোর। কিন্তু স্যালো ইঞ্জিনের বিকট শব্দে কারোর কথা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল না। অামার পরিস্কার মনে অাছে, গনি ভাই অভিমত দেন- ‘অামাদের তো বিল দেখা হয়ে গেছে, অাবার ফিরে যাবো কেন?’ মাঝি বললো- ভাঙ্গুরা ফিরতে রাত হয়ে যাবে।’ অামি বললাম- ‘রাস্তায় তো বিপদ হতে পারে। তখন সাইদুর বলেন- ‘তাতে কি! অামরা সকলে মোবাইলের টর্চ জ্বালাবো, জোসনার মতো অালো হয়ে যাবে।’ তার কথায় সকলে হেসে উঠেন। মত পাল্টিয়ে সকলে অাবার ভাঙ্গুড়ার দিকে যাত্রা শুরু করি। হান্ডিয়াল বুড়া পীরের মাজার বরাবর কাটানদীতে ঘটনাটি ঘটে। শোনা যায়, বহু পুর্বে মাজার তৈরির সময় সেখান থেকে প্রচুর মাটি তোলা হয়, তাছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীটি সংস্কার করায় সেখানকার গভীরতা অন্যান্য স্থানের তুলনায় বেশি। ফলে বিলের পানি সরার সময় সেখানে পানি ঘুরপাক খায়।

নৌকাটি সেখানে এসে ‘খটাস্’ করে একটি শব্দ করে তলিয়ে যেতে থাকে। নৌকাটি স্টিলের বডি হওয়ায় মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে তলিয়ে যায়। কিছু বঝে ওঠার অাগেই দেখলাম অনিতদুরে অামার মেয়ে পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। একলাফে তার কাছে যেতেই সে গলা জড়িয়ে ধরে। তলিয়ে যেতে থাকি দুজন। ৩০/৩৫ সেকেন্ডের মধ্যেই তার হাত থেকে মুক্ত হয়ে ভেসে উঠি ও তাকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করি(অামি যদি কবি হতাম তাহলে তখনকার অনুভূতি নিয়ে একটি উপন্যাস লিখে ফেলতাম। যদিও পরে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ‘তারিণী মাঝি’ গল্প পড়ে বুঝেছি, মানুষ চুড়ান্ত মুহুর্তে নিজেকেই বেশি ভালবাসে কি না, তা কঠিন পরীক্ষায় পড়তে হয়)। অতি কষ্টে উদ্ধারকারী নৌকা ধরতে সক্ষম হই। পরে শুনেছি, সওদা মনিকে ডুবে যেতে দেখে স্বপন দ্রুত তার দিকে অাসতে থাকে। তার অাগে রফিকুল সওদামনির একটি হাত ধরে ফেলে এবং স্বপনকে দ্রুত অারেকটি হাত ধরার জন্য চীৎকার করে বলতে থাকে। কিন্তু স্বপন সওদা মনির কাছাকাছি এসে সে নিজে তলিয়ে যায়। রফিকুলও সওদা মনির হাতের টান সহ্য করতে না পেরে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কুষ্টিয়ার কেউ কেউ প্রথমেই উদ্ধারকারী নৌকায় উঠে পড়ে। তারিফ হাসানও নৌকায় উঠে পড়েন( উল্লেখ্য, তারিফ হাসান একজন ভাল সাতারু। তার পিঠে ব্যথা হওয়ায় তিনি ডাক্তারের পরামর্শে প্রতিদিন সাতার কাটেন)। তিনি স্বপনকে সাতরে অাসতে দেখে একটি ডিজেলের খালি ঢোপ ছুড়ে মারে। কিন্তু স্বপন সেটি ধরতে ব্যর্থ হয়। বিল্লাল গনি তার মেয়ে শর্মীকে উদ্ধারকারী নৌকায় তুলে দিতে সক্ষম হলেও নিজে ক্লান্ত হয়ে পানিতে তলিয়ে যান। অন্যদিকে ছৈয়ের নিচে অাটকে পড়ে অামার স্ত্রী পারু ও গনি ভাইয়ের স্ত্রী শিউলি বেগম মারা যান। সে রাতের কথা কোনোদিন ভুলার নয়। ঈশ্বরদী, টেবুনিয়া, পাবনা শহর থেকে দু-অাড়াইশ লোক হান্ডিয়াল পাইকপাড়া জড়ো হন। সেখানকার স্থানীয় শত শত খেটে খাওয়া মানুষ বিলের পাড়ে এসে সমবেদনা জানাতে থাকে। অনেকে পানিতে নেমে লাশ উদ্ধারের চেষ্টা করে। পরদিন তৎকালীন জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দীন ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেন এবং পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে একাধিক শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়, উদ্ধারকারীদেরও বিভিন্নভাবে পুরুস্কৃত করা হয়। ঈশ্বরদীতেও তাদের স্মরণে শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এবারও তাদের স্মরণে কয়েক জায়গায় শোক সভা ও মিলাদ মাহফিলের অায়োজন করা হয়েছে। এখন অামাদের উচিত শোককে শক্তিতে পরিণত করা। সেজন্য তাদের স্মরণে বিপুল পরিমান বৃক্ষ রোপনের অায়োজন করা হয়েছে। অামাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অাবেদন জানাই, তারা যেন নিহতদের স্মরণে বিভিন্ন সেবা মূলক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন এবং তাদের স্মরণে রাখার চেষ্টা করেন।

লেখকঃ কলাম লেখক ও দুর্ঘটনাকবলিত নৌকাযাত্রী