সিলেট ২৯শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১০:২৫ পূর্বাহ্ণ, মে ২৬, ২০২৫
বিশেষ প্রতিবেদক | ঢাকা, ২৬ মে ২০২৫ : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক সংলাপ শুরু হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনিশ্চিত রয়ে গেছে। কারণ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনো আসন্ন সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করেনি। তবে সংলাপগুলোকে নিয়মিত এবং ‘ফলপ্রসূ’ হয়নি উল্লেখ করে অনেক রাজনৈতিক দল হতাশা প্রকাশ করেছে। সংলাপে নির্বাচন কিংবা সংস্কারের সময়সীমা নিয়ে সরকার কোনো দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সংশ্লিষ্টরা সতর্ক করেছেন যে অব্যাহত অস্পষ্টতা অস্থিতিশীলতাকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাদের মতে, স্বচ্ছতার অভাব বিদ্যমান উত্তেজনাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে।
রাজনৈতিক নেতারা জোর দিয়ে বলেছেন যে অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের অপসারণ এবং ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টিসহ (এনসিপি) সব পক্ষের সঙ্গে সমান আচরণের মাধ্যমে সরকারকে তার নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, বিশেষ করে, সরকার যদি বিএনপির আস্থা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।
একই সঙ্গে, প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচন এবং সংশ্লিষ্ট সংস্কারের জন্য একটি নির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত। রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণে সম্মত হলে, বর্তমান অচলাবস্থার সমাধান হতে পারে।
গত সপ্তাহজুড়ে বিভিন্ন ইস্যুতে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রস্তাবিত মানবিক করিডর, চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণের দাবিতে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের বিক্ষোভ এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সামনে এনসিপির বিক্ষোভ।
একই সঙ্গে, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঢাকা এবং অন্যান্য স্থানে বিভিন্ন ইস্যুতে ব্যাপক বিক্ষোভের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে, যার ফলে জনসাধারণের তীব্র অসুবিধা হচ্ছে।
এর প্রতিক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টা শনিবার ও রবিবার দুই দিন ধরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছেন।
শনিবার রাতের বৈঠকে, সিনিয়র নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানায়। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা থেকে তিনজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টার পদত্যাগের আহ্বান এবং নির্বাচন ও সংস্কারের জন্য একটি আনুষ্ঠানিক রোডম্যাপ প্রণয়নে জোর দেয়।
বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আমাদের দাবির বিষয়ে কোনো আশ্বাস দেননি। তারা (সরকার) কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেয়নি।
প্রেসসচিবের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি শোনার পর আমরা প্রতিক্রিয়া জানাব।’
জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেন, তার দলও নির্বাচন ও সংস্কারের জন্য একটি রোডম্যাপ দাবি করেছে, সংস্কারের গতির ওপর নির্ভর করে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি অথবা রমজানের পর এই দুটি সম্ভাব্য সময়সীমা প্রস্তাব করেছে।
তবে বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা সংলাপের ফলাফল নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, বৈঠকটি গুরুত্বপূর্ণ অনিশ্চয়তা দূর করতে ব্যর্থ হয়েছে। দলীয় সূত্র জানায় বিএনপি এক বা দুই দিনের মধ্যে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ ঘোষণা করবে।
তবে দলটির অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে না, তবে তাদের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। এ সময়ে একটি স্পষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা এবং ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবির পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য দলটি বিভিন্ন জনসাধারণের কর্মসূচি পালন করবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘জনগণ একটি নির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায়। প্রধান উপদেষ্টাকে অবশ্যই নাগরিকরা কখন তাদের ভোট দিতে পারবেন, তার সঠিক তারিখ এবং মাসটি জানাতে হবে। তিনি একটি দায়িত্বশীল পদে আছেন – নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে তাকে কী বাধা দিচ্ছে?’
তিনি আরো বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত, কারণ রমজান, ঈদ এবং বর্ষার কারণে পরের সময়গুলো নির্বাচনের অনুপযুক্ত হবে।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আরো বলেন, ‘সরকার যখন নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করতে ব্যর্থ হয়, তখন মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে। এটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। এবং যখন জনগণকে অন্ধকারে রাখা হলে তার প্রতিক্রিয়া রয়েছে।’
রবিবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তিহীন যেকোনো সরকারি পরিকল্পনাই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে।
বিএনপির মিত্র এবং বামপন্থী দলগুলোসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল একটি বিস্তারিত নির্বাচনী রোডম্যাপ এবং জাতীয় নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বরের সময়সীমা নির্ধারণের আহ্বান জানিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী কমপক্ষে পাঁচটি রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেন, চলমান অচলাবস্থা সমাধানের জন্য নির্বাচনের সময়সূচি বা সুনির্দিষ্ট সংস্কারের মতো সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি না পাওয়ায় বৈঠকগুলো ‘ফলপ্রসূ’ হয়নি। তারা প্রশাসনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য বিতর্কিত ব্যক্তিদের সরিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনের জন্য সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন।
আবারও শাসনতান্ত্রিক সংকট সৃষ্টি নয়, দ্রুত নির্বাচনকেই বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের সুষ্ঠু পথ বলে মনে করছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। দলটি বলেছে, জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে একটি সুষ্ঠু ইনক্লুসিভ নির্বাচন ও রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আশা করছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা বুঝতে ব্যর্থ হলে ‘বাত রোগ ভালো করার বদলে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হবার’ আশঙ্কাই বাড়িয়ে তুলবে।
শনিবার ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন অন্তর্বর্তী সরকারের সৃষ্ট সংকটেরই বহিঃপ্রকাশ। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুততম সময়ে একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দেশে গণতান্ত্রিক ধারা পুনঃপ্রবর্তন করবে– এটাই ছিল জনপ্রত্যাশা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকার গত ৯ মাসে অন্য নানা উদ্যোগ নেওয়ায় নিজেদের জনবিচ্ছিন্ন করেছে।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, ঐকমত্য কমিশন ও সংস্কার কমিশনের বিষয়গুলোও সরকার জনগণের সামনে পরিষ্কার করতে পারেনি। অনির্দিষ্ট সংস্কারের নামে কেবল সময়ক্ষেপণ করে সরকারের গণতন্ত্রের পথযাত্রা থামিয়ে রাখাও জনগণ মেনে নিচ্ছে না।
বামপন্থী দলগুলোর জোট বাম গণতান্ত্রিক জোট (এলডিএ) দাবি করেছে যে সংকট সমাধানের জন্য ন্যূনতম সংস্কারের মাধ্যমে ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।
রবিবার এক বিবৃতিতে এলডিএ সংস্কার এবং গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া উভয়কেই বিলম্বিত করে এবং এখতিয়ারের বাইরে সিদ্ধান্ত নিয়ে বর্তমান সংকট তৈরির অভিযোগে সরকারকে অভিযুক্ত করে। বিবৃতিতে মিয়ানমারের সঙ্গে মানবিক করিডোর এবং চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন মুরিং টার্মিনাল একটি বিদেশি কোম্পানির কাছে লিজ দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।
ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘সরকারের উচিত ২০২৪ সালের গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া জনসাধারণের কাছে দৃশ্যমান করা। ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নের পর, ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করা এবং একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।’
জোট আরো অভিযোগ করে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সমর্থন করছে। এই পদক্ষেপ সংকটকে আরো তীব্র করেছে বলে তারা মনে করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, সরকার যদি একটি স্পষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা না করে, তাহলে দলগুলো তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনিশ্চিত থাকবে। তারা জোর দিয়ে বলেন, সাধারণ নির্বাচনের আগে সরকারকে ভোটার এবং রাজনৈতিক দল উভয়ের কাছেই তার নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে হবে, পক্ষপাতের ধারণা এড়িয়ে চলতে হবে। তা ছাড়া যদি বর্তমান অবিশ্বাসের পরিবেশ অব্যাহত থাকে, তাহলে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে সতর্ক করেন তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘সরকার বর্তমান সংকটের জন্য দায়ী, করিডর এবং বন্দর ব্যবস্থাপনার মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দল এবং অংশীদারদের সঙ্গে পরামর্শ করতে ব্যর্থ হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি ব্যর্থ হয়, তবে একটি সামরিক বা আধা-সামরিক শাসন ক্ষমতা দখল করতে পারে। এমন পরিস্থিতি হলে ভারত এবং আওয়ামী লীগের জন্য উপকারী হবে, তবে দেশের জন্য তা হবে বিপর্যয়কর।’
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D