সিলেট ৫ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:২৮ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ৫, ২০২৫
বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের এক সময়ের বলিষ্ঠ সংগঠক, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের যশোর জেলা সভাপতি কমরেড ইউনুস তালুকদার আজ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। দীর্ঘদিনের রক্তরোগ, একাধিক শারীরিক জটিলতা এবং আর্থিক অনটনের কারণে তিনি এখন প্রায় নিঃস্ব ও অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। যে মানুষটি একসময় শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য মাঠে-ময়দানে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, আজ তিনি নিজেই চিকিৎসা আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ে একা।
দীর্ঘদিনের অসুস্থতা ও চিকিৎসার সংগ্রাম
বিগত কয়েক বছর ধরে কমরেড ইউনুস রক্তরোগে ভুগছেন। নিয়মিতভাবে রক্ত দিতে হয়, যা তার জন্য এখন এক দুঃসহ ব্যয়ভার। এর আগেও তিনি কলকাতা ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন, কিন্তু অর্থাভাবে নিয়মিত ফলোআপ বা উন্নত চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেননি। কিছুদিন আগে তিনি যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সম্প্রতি যশোর আদ্বদিন সখিনা হাসপাতালে রক্ত নেওয়ার পর তার শরীরে ভয়াবহ এলার্জি দেখা দিয়েছে—সারা শরীর ফুলে গেছে, চামড়া উঠে যাচ্ছে। অবস্থার অবনতি হলেও পর্যাপ্ত চিকিৎসা নিতে পারছেন না অর্থের অভাবে।
দুর্ঘটনা ও জীবনের আরেক দুঃসহ অধ্যায়
রক্তরোগের মধ্যেই এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ইউনুস তালুকদারকে আরও দুর্বল করে দেয়। দুর্ঘটনায় তার এক পায়ের হাঁটুর মালা ভেঙে যায়। যশোরে চিকিৎসা করালেও পা আর পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। আজও তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। শারীরিক এই দুর্বলতা তাকে শুধু পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দেয়নি, বরং কর্মক্ষমতা হারিয়ে তাকে একেবারে নিঃস্ব করে ফেলেছে।
আর্থিক অনটন ও পারিবারিক অসহায়ত্ব
এক সময়ের শ্রমিক নেতা আজ নিজের ঘরও হারানোর মুখে। প্রায় ১০–১২ বছর আগে চিকিৎসার খরচ জোগাতে তিনি নিজের বাড়ি ২ লাখ টাকায় বন্ধক রাখতে বাধ্য হন। আজও সেই টাকা পরিশোধ করে বাড়ি ছাড়াতে পারেননি। এখন তার সবচেয়ে বড় ভয়—তিনি মারা গেলে তার স্ত্রী ও ছেলে কোথায় যাবে? মেয়ে-ছেলেকে কষ্ট করে মানুষ করেছেন; মেয়ে বিয়ে হয়েছে, আর একমাত্র ছেলে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। সংসারের ভার, চিকিৎসার খরচ—সবকিছুই এখন এক অকল্পনীয় বোঝা তার ওপর।
দল ও সহযোদ্ধাদের পাশে পাওয়া ও হারানো
যশোর জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সাবেক সম্পাদক ও দৈনিক দেশ হিতৈষী পত্রিকার সম্পাদক নুরুল আলম তার পাশে ছিলেন অনেকদিন। সেই সময় ইউনুস আলম ভাইয়ের প্রেসে কাজ করতেন এবং ফেডারেশনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। পরে পার্টির যশোর জেলা সভাপতি কাবুল ভাইও সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু কাবুল ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে ইউনুস ক্রমশ একা হয়ে পড়েন। একসময় পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ইকবাল কবির জাহিদও খোঁজখবর নিতেন, কিন্তু সংগঠনের ঐক্য ভেঙে যাওয়ার পর সেই সহমর্মিতার শৃঙ্খলও যেন ছিন্ন হয়ে যায়।
এক সংগ্রামী জীবনের অবসান নয়, নতুন প্রত্যাশা
কমরেড ইউনুস তালুকদারের জীবন কেবল একজন ব্যক্তির অসুস্থতার গল্প নয়; এটি এক সংগ্রামী শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসের অংশ। যিনি জীবনের সোনালি সময় ব্যয় করেছেন শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য, আজ তার চিকিৎসার জন্য হাত বাড়াতে হচ্ছে মানুষের কাছে। প্রশ্ন জাগে—এমন মানুষদের পাশে দাঁড়াবে কে?
আজ প্রয়োজন মানবিক সহযোগিতা—ব্যক্তিগত, সংগঠনগত ও সরকারি উদ্যোগে ইউনুস তালুকদারের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। একই সঙ্গে তার পরিবারকে পুনর্বাসনের দিকেও মনোযোগ দেওয়া জরুরি। কারণ, ইউনুস কেবল একজন ব্যক্তি নন; তিনি বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের এক জীবন্ত ইতিহাস, এক ত্যাগী মানুষের প্রতীক।
শেষ কথা
১৯৮৬ সালে যশোরে আলম ভাইয়ের অফিসে লেখকের সঙ্গে ইউনুসের প্রথম পরিচয়। তখন দুজনই তরুণ—লেখক গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়নে, আর ইউনুস জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনে কর্মরত। আজ সময় অনেক দূর এগিয়েছে, কিন্তু সেই সময়ের শ্রমিক নেতারা একে একে হারিয়ে যাচ্ছেন নীরবে।
কমরেড ইউনুসের সুস্থতা কামনা করছি। আশা করি, রাষ্ট্র, সমাজ ও সহযোদ্ধারা তার পাশে দাঁড়াবেন। হয়তো তার চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে, তিনি আবারও আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন—শ্রমিকদের প্রিয় কমরেড হয়ে।
#
লেখক:
রেজাউল ইসলাম
সাংবাদিক ও রাজনীতিক
কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
মোবাইল: ০১৭২৭-৪২৬০২৬

সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি