গ্রন্থ পর্যালোচনা: যৌনতা ও লিঙ্গ-রাজনীতির গোড়ার কথা

প্রকাশিত: ১:১৩ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৫

গ্রন্থ পর্যালোচনা: যৌনতা ও লিঙ্গ-রাজনীতির গোড়ার কথা

Manual2 Ad Code

গ্রন্থ রিভিউ বিষয়ক প্রতিবেদক | ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ : প্রাচীন ভারতের সমাজব্যবস্থা, যৌনতা ও লিঙ্গরাজনীতির জটিল ইতিহাসকে নতুন দৃষ্টিতে অনুধাবনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস জয়িতা দাসের গবেষণামূলক গ্রন্থ “লিঙ্গসূত্র : প্রাচীন ভারতের যৌনতা ও লিঙ্গ-রাজনীতির গোড়ার কথা”।

Manual5 Ad Code

ইতিহাস, শাস্ত্র, পুরাণ ও সাহিত্যভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বইটি তুলে ধরেছে—লিঙ্গ কীভাবে একটি প্রাকৃতিক পরিচয়ের চেয়ে বেশি হয়ে উঠেছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক নির্মাণের ফল।

Manual4 Ad Code

গ্রন্থের নামেই স্পষ্ট, এখানে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে লিঙ্গ-রাজনীতি। লেখক দেখিয়েছেন, কীভাবে প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারী ও তথাকথিত ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’-এর অস্তিত্ব, চলন ও কামনা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে দ্বিতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবনজগৎ—তাঁদের নিজস্ব ভূগোল, সামাজিক অবস্থান, এবং তাঁদের যৌন আকাঙ্ক্ষার ওপর আরোপিত দমনমূলক বিধিনিষেধ।

বইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ। লেখক যুক্তিসংগতভাবে দেখিয়েছেন, উত্তরাধিকার নির্ধারণে পিতৃপরিচয় কেন এবং কীভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। এই পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো বজায় রাখার প্রয়োজনে দ্বিতীয় লিঙ্গের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে কীভাবে ক্রমশ খর্ব করা হলো এবং শাস্ত্র ও সাহিত্যকে সেই উদ্দেশ্যে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে—তার বিস্তৃত ব্যাখ্যা রয়েছে গ্রন্থে।

Manual6 Ad Code

লেখক আরও বিশ্লেষণ করেছেন, শাস্ত্রীয় বিধান ও সামাজিক আচার-অনুশাসনের মাধ্যমে কীভাবে নারীর শরীর ও মন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। এমনকি নারীর গর্ভও হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্র। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে পর্দাসংস্কৃতি, অবরোধ প্রথা ও নারীদেহের ওপর নজরদারির নানা রূপ—যার সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ বইটিতে সুস্পষ্টভাবে আলোচিত।

গ্রন্থটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো বৌদ্ধযুগের প্রেক্ষাপটে নারীর অবস্থান বিশ্লেষণ। পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম নারীবাদী বয়ান হিসেবে স্বীকৃত ‘থেরীগাথা’ এখানে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। থেরীদের কবিতায় উঠে আসা আত্মঅনুসন্ধান, বিদ্রোহ, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এবং কখনো কখনো সমঝোতার কাহিনি বইটিকে ঐতিহাসিক ও মানবিক দুই দিক থেকেই সমৃদ্ধ করেছে। পাশাপাশি বৌদ্ধযুগের নারীদের সংগ্রাম ও সামাজিক অবস্থান পরিবর্তনের ইতিহাসও আলোচিত হয়েছে গভীর মনোযোগের সঙ্গে।

গ্রন্থটির ভিত্তি প্রাচীন সংস্কৃত ও প্রাকৃত সূত্র, সাহিত্য, ধর্মীয় শাস্ত্র এবং পুরাণ-আখ্যান। ফলে এটি নিছক মতামতভিত্তিক রচনা নয়, বরং গবেষণালব্ধ তথ্য ও পাঠ বিশ্লেষণের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি প্রামাণ্য কাজ। ইতিহাসের পুরুষকেন্দ্রিক পাঠের বাইরে গিয়ে লেখক যেভাবে লিঙ্গ ও যৌনতার প্রশ্নগুলোকে নতুন আলোয় দেখার চেষ্টা করেছেন, তা সমকালীন লিঙ্গচিন্তা ও নারীবাদী গবেষণায় বইটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।

সব মিলিয়ে, “লিঙ্গসূত্র” কেবল একটি ইতিহাসভিত্তিক গবেষণাগ্রন্থ নয়; এটি সমাজে প্রচলিত লিঙ্গধারণা ও ক্ষমতার সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবার আহ্বান। লিঙ্গ রাজনীতি, নারী ইতিহাস, যৌনতা ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী পাঠকের জন্য বইটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

গ্রন্থের তথ্য
লিঙ্গসূত্র : প্রাচীন ভারতের যৌনতা ও লিঙ্গ-রাজনীতির গোড়ার কথা
লেখক : জয়িতা দাস
মূল্য : ১৫২০ টাকা

Manual7 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ