সাংস্কৃতিক নয়, কাঠামোগত দুর্বলতাই আসল সংকট: ‘ফ্যাসিবাদ’ বলাটা অপ্রাসঙ্গিক

প্রকাশিত: ১:৪৫ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৫

সাংস্কৃতিক নয়, কাঠামোগত দুর্বলতাই আসল সংকট: ‘ফ্যাসিবাদ’ বলাটা অপ্রাসঙ্গিক

Manual5 Ad Code

লুবনা ফেরদৌসী |

একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক যখন মাইক্রোফোন হাতে নেন, তখন শ্রোতারা স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেন, এখানে ফেসবুক স্ট্যাটাস শোনা যাবে না, শোনা যাবে ইতিহাস, তত্ত্ব আর প্রমাণে ভর করা বিশ্লেষণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ড. দিলারা চৌধুরীর বক্তব্য শুনে যে অনুভূতিটা হয়, তা অনেকটা এই রকম, ক্লাসে ঢুকে দেখি, সিলেবাসে Morgenthau, Waltz, Anderson লেখা আছে, কিন্তু লেকচার চলছে ইউটিউবের “গোপন সত্য ফাঁস” সিরিজের ভাষায়। সমস্যা এখানেই।

প্রথমেই “ভারত কখনোই বাংলাদেশের বন্ধু ছিল না”, এই বক্তব্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৌলিক ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বে (Hans Morgenthau, Politics Among Nations; Kenneth Waltz, Theory of International Politics) রাষ্ট্র কখনো আবেগের জায়গা থেকে ‘বন্ধু’ বা ‘শত্রু’ হয় না। রাষ্ট্র হয় নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক মুহূর্তে স্বার্থভিত্তিক অংশীদার।

১৯৭১ সালে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল একটা classic strategic alignment, সামরিক ইতিহাসের প্রামাণ্য সত্য। ভারতীয় সেনাবাহিনীর Eastern Command এর সরাসরি অংশগ্রহণ, মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিক সহায়তা, প্রায় এক কোটি শরণার্থীর আশ্রয়, এবং Indira Gandhi সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, এসব নথিভুক্ত আছে ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সামরিক ইতিহাসে (Sisson & Rose, War and Secession; Raghavan, 1971: A Global History of the Creation of Bangladesh)।

এরপর আসে আরও নাটকীয় অভিযোগ, “ভারতীয় আগ্রাসনের কারণে আমরা ৭১ এর ফসল তুলতে পারিনি।” এই বক্তব্য শুনে Charles Tilly হয়তো কবরের ভেতরেই দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। কারণ রাষ্ট্র গঠনের তত্ত্ব আমাদের বলে, যুদ্ধের পর রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে দায় খুঁজতে হয় ভেতরে, প্রাতিষ্ঠানিক ভাঙন, অর্থনৈতিক ধ্বংস, প্রশাসনিক অক্ষমতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা (Charles Tilly, Coercion, Capital and European States)।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ, ধারাবাহিক সামরিক অভ্যুত্থান, ১৯৭৫ এর জাতির পিতা হত্যাকাণ্ড, এবং দীর্ঘ সামরিক শাসন রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিকাশকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কিন্তু এগুলো বিশ্লেষণ করতে গেলে আয়না দেখতে হয়। তার চেয়ে সহজ হলো, সব দোষ “বাইরের শক্তি”-র ঘাড়ে চাপানো। ছোটবেলা থেকে শুনতাম সব ‘র’ এর দোষ। একে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বলা হয় scapegoating, আর রাজনৈতিক বাস্তবতায় বলা হয় দায়িত্ব এড়ানোর সবচেয়ে আরামদায়ক কৌশল, যা সাধারণত দুর্বল রাষ্ট্রচিন্তায় দেখা যায়।

এরপর আসে conspiracy buffet, “ক্যান্টনমেন্টে RAW এর অফিস ছিল”, “সব জায়গায় RAW এর থাবা”, “সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ”। সমস্যা হলো, এগুলো শোনাতে রোমাঞ্চকর হলেও একাডেমিকভাবে শূন্য। গোয়েন্দা সংস্থার প্রভাব নিয়ে কথা বলতে হলে লাগে declassified document, parliamentary inquiry, credible research। Christopher Andrew গোয়েন্দা ইতিহাস লিখেছেন হাজার পৃষ্ঠা প্রমাণ নিয়ে।

আর “সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ” এই শব্দবন্ধটা শুনলে মনে হয় খুব ভয়ংকর কিছু বলা হলো। কিন্তু তত্ত্বের আলো জ্বালালেই দেখা যায়, এটা আসলে একটা empty slogan।
কারণ ফ্যাসিবাদ কোনো সাংস্কৃতিক প্রবাহ নয়, এটি একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয়-রাজনৈতিক ব্যবস্থা। Roger Griffin স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন, ফ্যাসিবাদ মূলত palingenetic ultranationalism, অর্থাৎ একটা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকেন্দ্রিক মতাদর্শ, যেখানে সহিংসতা, একনায়কত্ব, রাষ্ট্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, বিরোধী কণ্ঠ দমন এবং জনগণের ওপর coercive authority প্রয়োগই মুখ্য বৈশিষ্ট্য। ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রের যন্ত্রণা, সেনাবাহিনী, পুলিশ, আইন ও প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে কাজ করে; গান, কবিতা, ভাষা বা সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে নয়।

বাংলা ভাষা, রবীন্দ্র-নজরুল, কলকাতা-ঢাকার সাংস্কৃতিক সংলাপ,

সংস্কৃতি কখনোই একমুখী ক্ষমতা প্রয়োগের হাতিয়ার হতে পারে না, যদি না সেটাকে রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগ দিয়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়। বাংলা ভাষা, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, কিংবা কলকাতা-ঢাকার শতবর্ষের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংলাপ, যৌথ চলচ্চিত্র ও সাহিত্য, এসব যদি ‘ফ্যাসিবাদ’ হয়, তাহলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বড় অংশকেই অস্বীকার করতে হয়। এসব সংস্কৃতি কোনো রাষ্ট্রীয় coercion এর ফল না, এগুলো ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, ভাষাগত উত্তরাধিকার এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে।

যদি সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানকেই ‘ফ্যাসিবাদ’ বলা হয়, তাহলে রবীন্দ্রনাথ কি রাষ্ট্রীয় ট্যাংক নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছিলেন? নজরুল কি কোনো সেনা আইনের মাধ্যমে পাঠ্যক্রমে ঢুকেছিলেন? সংস্কৃতি dominance না, shared inheritance।

এই যুক্তি আরও ভেঙে পড়ে যখন আমরা দেখি, বাংলাদেশের জাতিসত্তা গঠনের ইতিহাস। বাংলাদেশি পরিচয় ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে তৈরি হয়নি, তৈরি হয়েছে ১৯৪৭ এর ধর্মভিত্তিক বিভাজনের বিরুদ্ধে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল, ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অধিকারের মতো বাস্তব সামাজিক ভিত্তিকে অস্বীকার করে কেবল ধর্মকে রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের একমাত্র মানদণ্ড বানানো। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, এই পুরো রাজনৈতিক ইতিহাস আসলে ধর্মীয় রাষ্ট্রচিন্তার বিরুদ্ধে একটি ধারাবাহিক প্রতিরোধ।

এখানেই Benedict Anderson এর Imagined Communities তত্ত্ব প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। Anderson দেখিয়েছেন, জাতি কোনো প্রাকৃতিক বা ধর্মীয় বাস্তবতা না ; জাতি একটি রাজনৈতিক কল্পনা, যেটা গড়ে ওঠে যৌথ ভাষা, সাংস্কৃতিক স্মৃতি, ইতিহাস এবং অভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ ঠিক এই পথেই জাতি হয়েছে, বাংলা ভাষা, সাহিত্য, গান, রাজনৈতিক বঞ্চনার অভিজ্ঞতা এবং গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে। এই জাতিসত্তা ধর্মীয় একরেখায় তৈরি হয়নি বলেই পাকিস্তান কাঠামোর ভেতরে তা টেকেনি।

একারণে ‘সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ’ বলাটা রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক। কারণ এই ভাষা ব্যবহার করে আসলে সংস্কৃতিকে শত্রু বানানো হয়, আর শত্রু বানানো হয় সেই সাংস্কৃতিক ভিত্তিকেই, যার ওপর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পরিচয় দাঁড়িয়ে আছে। ইতিহাসে আমরা দেখেছি, ঠিক এই কৌশলটাই ব্যবহার করেছে ফ্যাসিবাদী ও কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলো, প্রথমে বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে ‘বিদেশি প্রভাব’ বলে চিহ্নিত করা, তারপর সেই সংস্কৃতিকে দমন করে একমাত্রিক পরিচয় চাপিয়ে দেওয়া।

সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো এই বক্তব্যগুলোর রাজনৈতিক পরিণতি। এই বয়ান হুবহু মিলে যায় পাকিস্তানের পোস্ট ১৯৭১ রাষ্ট্রীয় narrative এর সঙ্গে, যেখানে পাকিস্তানি গণহত্যা আড়াল করা (Hamoodur Rahman Commission), ভারতের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করা, এবং বাংলাদেশকে চিরস্থায়ী ‘বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত মুসলিম রাষ্ট্র’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এটা deliberate narrative shift, যার লক্ষ্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিকে দুর্বল করা এবং Two-Nation Theory কে পরোক্ষভাবে পুনর্বাসন করা, যে তত্ত্বকে বাংলাদেশ নিজ অস্তিত্ব দিয়েই বাতিল করেছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে এই ধরনের বক্তব্য দেওয়া তাত্ত্বিক দুর্বলতা তো আছেই সেইসাথে আছে বুদ্ধিবৃত্তিক দায়িত্বহীনতা। কারণ একাডেমিক কর্তৃত্ব ব্যবহার করে ইতিহাস বিকৃতি সবচেয়ে বিপজ্জনক, এতে বিভ্রান্তি ছড়ায় প্রজন্মের পর প্রজন্মে।

বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হলে আবেগ বাদ দিয়ে প্রয়োজন যুক্তির, প্রয়োজন ইতিহাসকে তার পূর্ণ প্রেক্ষাপটে বোঝা। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জটিল, অসম এবং বহু ক্ষেত্রে ন্যায্য সমালোচনার যোগ্য। এটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানও স্বীকার করে। কিন্তু সেই সমালোচনা আর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলা এক জিনিস না।

Manual7 Ad Code

একই সঙ্গে এটাও বলা জরুরি, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তব, কাঠামোগত সমস্যাগুলো অস্বীকার করাই বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা। সমালোচনা দরকার, কিন্তু সেই সমালোচনা হতে হবে প্রমাণভিত্তিক, তাত্ত্বিকভাবে সঠিক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, স্লোগানের ভাষায় নয়।

প্রথমত, সীমান্ত প্রশ্ন। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ড একটা বাস্তব ও গুরুতর মানবাধিকার সমস্যা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা Human Rights Watch এবং Amnesty International বহুবার সীমান্তে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের সমালোচনা করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটাকে “RAW এর থাবা” বলে ব্যাখ্যা করা একটা border management and security governance failure।

সীমান্তে কীভাবে lethal force ব্যবহার হবে, সেটি RAW নির্ধারণ করে না, এটা নির্ধারণ করে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী, রাজনৈতিক নির্দেশনা এবং নিরাপত্তা নীতির কাঠামো। এখানে সমস্যার উৎস হলো asymmetrical power relation ও দুর্বল bilateral accountability mechanisms, কোনো সর্বব্যাপী গোপন গোয়েন্দা দখল না।

দ্বিতীয়ত, পানি ও নদী চুক্তি। তিস্তা চুক্তির অচলাবস্থা, গঙ্গা ব্যারাজ, upstream diversion, এসব নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য কাঠামোগত ক্ষতি। কিন্তু এগুলোও ক্লাসিক hydropolitics এর উদাহরণ, যেটা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বে ভালোভাবে documented।

Turkey-Syria-Iraq (Euphrates-Tigris), Egypt-Ethiopia (Nile), কিংবা China-South East Asia (Mekong), সব ক্ষেত্রেই upstream power downstream state এর ওপর leverage তৈরি করে। এটাকে “RAW এর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন” বলা তাত্ত্বিকভাবে অর্থহীন। এখানে প্রশ্ন ক্ষমতার অসমতা, ফেডারেল ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি (যেমন পশ্চিমবঙ্গের veto power), এবং দুর্বল regional water governance, not cultural fascism.

তৃতীয়ত, বাণিজ্য অসমতা ও বাজার প্রবেশ। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা আছে, এটি সত্য। ভারতীয় non-tariff barriers, port inefficiency, standards regime, এসব কারণে বাংলাদেশি পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু WTO literature এ এগুলোকে বলা হয় structural trade asymmetry, যা বড় অর্থনীতির সঙ্গে ছোট অর্থনীতির সম্পর্কেই দেখা যায়। NAFTA তে মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কেও একই pattern দেখা গেছে। এটাকে RAW এর সর্বগ্রাসী ষড়যন্ত্র হিসেবে ব্যাখ্যা করা হলে মূল সমস্যার সমাধানই ঝাপসা হয়ে যায়।

একদিকে বলা হচ্ছে ভারত আমাদের সংস্কৃতি গ্রাস করছে, অন্যদিকে বাস্তবতা হলো, আমরা এখনো নিজেদের সবচেয়ে মৌলিক শিল্পগত চাহিদা, এমনকি কাপড় তৈরির কাঁচামালও স্বাধীনভাবে উৎপাদন করতে পারছি না। যেই কাপড় পরে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী স্লোগান দিচ্ছেন আপনি, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সেই কাপড়ের কাঁচামাল I mean সুতা পর্যন্ত ভারত থেকে আসে।

আজকের খবরে বিটিএমএর সভাপতির বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার, বাংলাদেশের স্পিনিং মিলগুলো আজ সংকটে শুধু ভারতের “সাংস্কৃতিক প্রভাবের” কারণে না, বরং কাঠামোগত অর্থনৈতিক নির্ভরতার কারণে। আজকের খবর, ভারত থেকে ১৩৭ শতাংশ হারে সুতা আমদানি বেড়েছে, প্রতি কেজিতে ৩০ সেন্ট কম দামে ডাম্পিং হচ্ছে, ফলে প্রায় ৫০টি স্পিনিং মিল বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে সমস্যাটা সাংস্কৃতিক না, সমস্যাটা রাজনৈতিক অর্থনীতির, dumping, asymmetric market power, এবং দুর্বল domestic industrial policy।

যদি ভারত সত্যিই কেবল “সাংস্কৃতিক ফ্যাসিস্ট” হয়, তাহলে প্রশ্ন আসে, এই নির্ভরতা তৈরি হলো কীভাবে? কোনো সংস্কৃতি তো বন্দুক ঠেকিয়ে সুতা বিক্রি করে না। এখানে দায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় শিল্পনীতি, ব্যাংকিং কাঠামো, জ্বালানি মূল্য, সুদের হার, এবং দীর্ঘদিনের de-industrialisation প্রবণতার। ভারত সুযোগ নিয়েছে, এটা বড় শক্তির স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু সুযোগ নেওয়ার জায়গা তৈরি করেছে আমরা নিজেরাই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একে বলা হয় structural dependency, cultural fascism নয়।

আরও বড় irony হলো, যে ভারতকে “সাংস্কৃতিক আগ্রাসক” বলা হচ্ছে, সেই ভারতের সুতা ছাড়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প এই মুহূর্তে বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। বিটিএমএ নিজেই বলছে, ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধ হোক, সেটি তারা চায় না। তারা চায় নির্ভরশীলতা কমুক, ভারসাম্য আসুক। অর্থাৎ বাস্তব ব্যবসায়ী শ্রেণি জানে, এটা আবেগের যুদ্ধ না, এটা supply chain politics। কিন্তু রাজনৈতিক বক্তৃতায় সেই বাস্তবতাকে গালিগালাজে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে।

এখানেই “সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ” তত্ত্বের ভণ্ডামিটা ধরা পড়ে। আপনি যদি সত্যিই সাংস্কৃতিকভাবে আক্রান্ত হন, তাহলে প্রথম কাজ হতো নিজের উৎপাদন সক্ষমতা গড়ে তোলা, cotton policy, spinning subsidy, technology upgrade, EDF সংস্কার, সুদের হার কমানো। কিন্তু সেটা না করে যদি আপনি ভারতের ওপর নির্ভরতা বাড়ান, আর একই সঙ্গে ভারতকে সাংস্কৃতিক দানব বানান, তাহলে সেটা বিশ্লেষণ না, এটা রাজনৈতিক সুবিধাবাদ।

এটা আরও বিপজ্জনক কারণ এই ধরনের বক্তব্য জনগণকে ভুল জায়গায় ক্ষুব্ধ করে। মানুষ ভাবতে শেখে, সমস্যার মূল ভারতীয় সংস্কৃতি, ভারতীয় গান, ভারতীয় বই, কিন্তু আসল সমস্যাগুলো থাকে অচিহ্নিত: কেন ১০ হাজার কোটি টাকার সুতা অবিক্রীত পড়ে আছে, কেন ৫০টির বেশি বস্ত্রকল বন্ধ, কেন ২৫০টির বেশি গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ, কেন রাষ্ট্র শিল্প বাঁচাতে পারছে না। এই প্রশ্নগুলো চাপা পড়ে যায় “RAW”, “সাংস্কৃতিক ফ্যাসিস্ট”, “আগ্রাসন”, এই শব্দের আওয়াজে।

এই misdirection of political anger, জনগণের ক্ষোভ বাস্তব কাঠামোগত সমস্যার দিকে না গিয়ে সাংস্কৃতিক শত্রু নির্মাণে ব্যয় হয়। ফলাফল? সমস্যার সমাধান হয় না, কিন্তু বিভাজন বাড়ে।

সবচেয়ে বড় কথা, সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ যদি সত্যিই কাজ করত, তাহলে সেটার সবচেয়ে বড় শিকার হতো আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উল্টো, বাংলাদেশি সংস্কৃতি নিজস্ব শক্তিতেই টিকে আছে, বিকশিত হচ্ছে। সংকটে পড়েছে শিল্প, শ্রম, উৎপাদন। সুতরাং সমস্যার নাম ভুল দিলে চিকিৎসাও ভুল হবে।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমস্যাগুলো বাস্তব, সীমান্ত, পানি, বাণিজ্য, ডাম্পিং, কিন্তু এগুলো political economy এবং power asymmetry দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হয়, “সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ” দিয়ে না। কারণ আপনি যখন নিজের কাপড় বানাতেও অন্যের ওপর নির্ভরশীল, তখন সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের গল্প শোনালে সেটা বিশ্লেষণ না, সেটা আত্মপ্রবঞ্চনা।

ক্ষমতার প্রশ্ন মোকাবিলা করা সত্যিই কঠিন। কর্পোরেট বাণিজ্য চুক্তি পুনর্নির্ধারণ করা কঠিন, ডাম্পিংয়ের বিরুদ্ধে WTO ভিত্তিক আইনি লড়াই করা কঠিন, সীমান্ত ও ট্রানজিট ইস্যুতে সমন্বিত কূটনীতি গড়া কঠিন। এগুলোর জন্য রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা, টেকনিক্যাল জ্ঞান, আমলাতান্ত্রিক দক্ষতা আর রাজনৈতিক সাহস লাগে। কিন্তু সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে “র এর এজেন্ট” বলা খুব সহজ। এতে কোনো নীতি বদলাতে হয় না, কোনো শক্তির সঙ্গে দরকষাকষি করতে হয় না, শুধু ভাষা বদলালেই হয়। এই কারণেই সংস্কৃতি আক্রমণের সবচেয়ে সহজ টার্গেট।

এই symbolic substitution যখন বাস্তব ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক গোষ্ঠী প্রতীকী শত্রু তৈরি করে, যাতে জনগণের ক্ষোভ বাস্তব কাঠামোর দিকে না গিয়ে সাংস্কৃতিক প্রতীকের দিকে যায়। কর্পোরেট বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করা যাবে না, কিন্তু নাট্যদল, সাহিত্য উৎসব বা সাংস্কৃতিক সংগঠনকে “বিদেশি এজেন্ট” বলা যাবে। এতে আবেগ তৈরি হয়, কিন্তু ক্ষমতার কাঠামো অক্ষত থাকে।

Manual7 Ad Code

পেঁয়াজের উদাহরণটা তো প্রায় রাজনৈতিক কমেডি। ৯০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ ঢুকতেই বাজারে দাম কমে গেল। মানে আমরা গান দিয়ে না , ট্রাক দিয়ে বাঁচছি।

Manual2 Ad Code

বলতেছিলাম বেনাপোল দিয়ে মাত্র ১০ দিন আগে, ২০ ডিসেম্বর ভারত থেকে ৯০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানির ঘটনাটা এই ভণ্ডামির সবচেয়ে পরিষ্কার উদাহরণ। প্রতি কেজি ৪২- ৪৩ টাকায় আমদানি শুরু হতেই বাজারে পেঁয়াজের দাম ১০-১৫ টাকা কমে গেল। এর মানে খুব সোজা, বাংলাদেশ আজও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম পর্যন্ত স্বাধীনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যদি না ভারতীয় বাজার খোলা থাকে। এখানে কোনো গান, কোনো সিনেমা, কোনো কবিতা কাজ করেনি, কাজ করেছে cross-border supply chain।

যে রাষ্ট্র পেঁয়াজ ছাড়া দাম সামলাতে পারে না, সে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রু কি কবিতা? যে রাষ্ট্র পেঁয়াজের দাম স্থিতিশীল রাখতে প্রতিবেশীর ওপর নির্ভরশীল, সে রাষ্ট্রের সমস্যাটা কি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন? নাকি সমস্যা কৃষি উৎপাদন পরিকল্পনা, সংরক্ষণ ব্যবস্থা, বাজার নিয়ন্ত্রণ আর আঞ্চলিক বাণিজ্য কাঠামোতে? কিন্তু এই প্রশ্নগুলো তুললে ক্ষমতার মুখোমুখি হতে হয়। তাই সহজ রাস্তা হলো, সংস্কৃতিকে দোষী করা।

এই জায়গাটাতেই “RAW সর্বত্র” জাতীয় বক্তব্যের রাজনৈতিক ব্যবহার বোঝা যায়। আপনি যদি স্বীকার করেন যে পেঁয়াজ, সুতা, বিদ্যুৎ, ট্রানজিট, সবখানেই কাঠামোগত নির্ভরতা আছে, তাহলে আপনাকে রাষ্ট্রের সক্ষমতা নিয়ে কথা বলতে হবে। কিন্তু যদি বলেন “সব সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ”, তাহলে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা আড়াল করা যায়, আর জনগণকে আবেগী শত্রু দেখানো যায়।

Manual7 Ad Code

এটা কেবল বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ভুল না, রাজনৈতিকভাবেও বিপজ্জনক। কারণ এতে মানুষ ভাবতে শেখে, সমস্যার সমাধান সংস্কৃতি দমন, বই নিষিদ্ধ, গান বন্ধ, উৎসব বন্ধ। অথচ বাস্তবতা হলো, পেঁয়াজের দাম কমেছে ভারতের ট্রাক ঢোকার কারণে, সুতার দাম কমছে ভারতের ডাম্পিংয়ের কারণে, বিদ্যুৎ আসছে ভারতীয় গ্রিড থেকে। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কোনো রাষ্ট্র সার্বভৌম হতে পারে না।

চতুর্থত, RAW ও কূটনৈতিক প্রভাবের প্রশ্ন। বাস্তবতা হলো, প্রতিটা আঞ্চলিক শক্তিরই গোয়েন্দা ও কূটনৈতিক নেটওয়ার্ক থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের CIA, চীনের MSS, রাশিয়ার SVR, সব রাষ্ট্রই এই কাজ করে। কিন্তু “বাংলাদেশে সবসময় RAW এর থাবা ছিল” বলার মানে কি দাঁড়ায়? মানে দাঁড়ায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে একটা agency-less puppet state হিসেবে উপস্থাপন করা। এটা postcolonial রাষ্ট্রচিন্তার সবচেয়ে বিপজ্জনক বিকৃতি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এটাকে বলা হয় denial of state agency, যেখানে নিজের রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট ও ক্ষমতাকাঠামোর দায় বাইরের কোনো সর্বশক্তিমান ছায়ার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।

যদি সত্যিই বাংলাদেশ সবসময় RAW দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো, তাহলে ১৯৭৫ এর পর ভারতবিরোধী সামরিক শাসন কীভাবে টিকে থাকল? কীভাবে BNP-জামায়াত জোট রাষ্ট্রক্ষমতায় এলো? কীভাবে চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় defence supplier হলো? কীভাবে ভারতবিরোধী রাজনীতি এত বছর জনসমর্থন পেল? এই বাস্তব ঘটনাগুলো বলে RAW সর্বশক্তিমান কোনো force না , দক্ষিণ এশিয়ার স্বাভাবিক power politics এর একটা উপাদান।

সবচেয়ে বড় কথা, ভারতের সঙ্গে কাঠামোগত সমস্যার সমালোচনা করা আর ইতিহাস বিকৃত করে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দাঁড় করানো এক জিনিস না। প্রথমটি রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করে, দ্বিতীয়টি রাষ্ট্রকে দুর্বল করে। কারণ ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বাস্তব সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানকে অসম্ভব করে তোলে এবং জনগণকে যুক্তির বদলে আবেগে পরিচালিত করে।

বাংলাদেশের প্রয়োজন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে neither romanticise করা, nor demonise করা। প্রয়োজন একটা cold , rational, interest-based diplomacy, যেখানে সীমান্ত হত্যা আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলা হবে, পানি নিয়ে multilateral pressure তৈরি হবে, বাণিজ্যে reciprocity দাবি করা হবে, কিন্তু একই সঙ্গে ইতিহাসকে বিকৃত করে রাষ্ট্রীয় আত্মসম্মানকে আত্মঘাতী পথে ঠেলে দেওয়া হবে না।

RAW কোনো সাংস্কৃতিক ফ্যাসিস্ট না, আর ভারত কোনো চিরস্থায়ী বন্ধু বা চিরস্থায়ী শত্রুও না। এগুলো আবেগের ভাষা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষা হলো, power, interest, structure, and agency। রাষ্ট্র শক্তিশালী হয় উৎপাদন সক্ষমতা, নীতি সংস্কার এবং বাস্তববাদী কূটনীতি দিয়ে।

অতএব “সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ” বলে চিৎকার করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কি বাজার, উৎপাদন আর বাণিজ্যের ক্ষমতার লড়াই করতে প্রস্তুত? নাকি শুধু সংস্কৃতিকে আক্রমণ করে নিজের নীতিগত অক্ষমতা ঢাকতে চাইছেন?

#

ড. লুবনা ফেরদৌসী
শিক্ষক ও গবেষক,
ইংল্যান্ড।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ