ঐতিহাসিক “মুল্লুক চলো” আন্দোলনের শততম বর্ষ পালিত

প্রকাশিত: ১২:৫১ অপরাহ্ণ, মে ২০, ২০২১

ঐতিহাসিক “মুল্লুক চলো” আন্দোলনের শততম বর্ষ পালিত

Manual2 Ad Code

সৈয়দ আরমান জামী, বিশেষ প্রতিনিধি | মৌলভীবাজার, ২০ মে ২০২১ : চা শ্রমিক দিবস আজ। ১৯২১ সালের ২০ মে, চা শিল্প এবং চা শ্রমিকদের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। তৎকালীন কাছাড় ও সিলেট জেলার ত্রিশ হাজার চুক্তিভিত্তিক চা শ্রমিক ব্রিটিশ মালিকদের বিরুদ্ধে শ্রমিকনেতা গঙ্গাচরন দীক্ষিত, দেওশরন ত্রিপাঠির নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে “মুল্লুক চলো” আন্দোলনে অংশ নিয়ে করিমগঞ্জ রেলস্টেশনে সমবেত হয়ে চাঁদপুর জাহাজঘাটের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করেন। ২০ মে চাঁদপুর পৌঁছে জাহাজে ওঠার জন্য অপেক্ষমাণ শ্রমিকদের উপর ব্রিটিশ মালিকরা চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে আসাম রাইফেলস এর গোর্খা বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়। চা শ্রমিকদের ঔদ্ধত্য আর ভবিষ্যৎ বিদ্রোহের বীজ দমন করতে চালানো হয় সশস্ত্র হামলা। অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটে।

ঐতিহাসিক মুল্লুক চলো আন্দোলনের এবছর শততম বর্ষ। শতাব্দীর মাইলফলক ছোঁয়া এই আন্দোলন চা শ্রমিকদের জন্য এক অনন্য শিক্ষা হয়ে নতুন দিনের লড়াইয়ে শক্তি যোগাচ্ছে।

Manual1 Ad Code

বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা ২০ মে চা শ্রমিকদের রক্তে ভেজা এই দিনটিকে “চা শ্রমিক দিবস ” হিসেবে পালন করছেন দীর্ঘদিন যাবত। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং সবেতন ছুটির দাবিসহ চা শ্রমিকদের দৈনিক ন্যূনতম মজুরি ৫০০ টাকা নির্ধারণ, ভূমির অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান এবং মৌলিক নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে এবছর বিভিন্ন চা বাগানে শততম “চা শ্রমিক দিবস” পালন করা হয়। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ মৌলভী, করিমপুর, রাজনগর, মাথিউরা, মুমিনছড়া, রত্না, ধামাই, সোনা রুপা, কালিটি, লংলা, তারাপাশা, দলই, শমসেরনগর, আলীনগর, সুনছড়া, কুরমা, চাম্পারাই, ভাড়াউড়া, ভুরভুরিয়া, ফুলছড়া, লাখাই, কেজুরিছড়া, হরিনছড়া, রাজঘাট, সিন্দুরখান, আমরাইল, চান্দপুর, বেগমখান, রামগংগা, জোয়াল ভাঙা, আমু, লস্কর পুর, দেওন্দি, তেলিয়াপাড়া, বৈকুন্ঠপুর, নোয়াপাড়া, রেমা, রশিদপুর, মালনিছড়া, লাক্কাতুড়া, খাদিম, তারাপুর চা বাগানসমুহে অস্থায়ী শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধা নিবেদন, চা শ্রমিক সমাবেশ, মিছিল, আলোক প্রজ্জ্বলন ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করা হয়।

Manual4 Ad Code

সকাল ৮টায় মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মৌলভী চা বাগানে পঞ্চায়েত কমিটি ও চা শ্রমিক ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে চা শ্রমিক দিবস পালিত হয়। অস্থায়ী স্মৃতি স্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে শহীদের স্মরণে নিরবতা পালন এবং পঞ্চায়েত সভাপতি জ্ঞান উড়াংয়ের সভাপতিত্বে, কীরন বৈদ্যের সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন চা শ্রমিক ফেডারেশনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আবুল হাসান, বাসদ নেতা প্রীতম দাশ, শ্রমিক নেতা রতন গড়াইত, গোলাপ তেলী, দূর্জয় রিকমন, আপন কড়ি প্রমুখ। সমাবেশ শেষে মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
মুল্লুকে চলো আন্দোলন ও চা শ্রমিক গণহত্যার ১০০ বছর পূর্তিতে ও ঐতিহাসিক বীরত্বগাথা রক্তাক্ত সংগ্রামের এক মহাউপাখ্যান সৃষ্টিকারী চা শ্রমিকদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য, আরপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, “যে অধিকার রক্ষার জন্য চা শ্রমিকদের ঐতিহাসিক আত্মত্যাগের দুঃখগাথা রচিত হয়েছে তার বাস্তবায়ন এই ১০০ বছরেও হয়নি। বছরের পর বছর বাগানমালিক ও সরকারের শোষণ-নিপীড়নের স্বীকার হচ্ছে চা শ্রমিকরা। নামমাত্র মজুরির পাশাপাশি ন্যূনতম মৌলিক অধিকার বরাবরই অধরাই থেকেছে। চা শ্রমিকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়, এমন মজুরি চাই। মুনাফা ও সম্পদের ৯০% মালিকানা শ্রমিকদের হওয়া উচিত।
তাই বলা যায় চা শ্রমিকদের অধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভোগবাদী সমাজব্যবস্থার পুঁজিবাদী মনোভাব চা শ্রমিকদের জীবন চা গাছের ন্যায় বনসাই করে রেখেছে। চা শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রমে ক্রমান্বয়ে চা শিল্পের বিকাশ ঘটেছে যার দরুন চা উৎপাদনের নতুন রেকর্ড গড়ে জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদানের পাশাপাশি রফতানিমুখী শিল্প হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে কিন্তু দুষ্টচক্রে বাধা চা শ্রমিকদের জীবন মানের উন্নয়ন আর হয় না।
শ্রম আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে চা জনগোষ্ঠীকে বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ও শিক্ষার অধিকার থেকে দূরে রেখেই বাগান পরিচালনা করছে মালিক পক্ষ। সরকারের এ ব্যাপারে তো কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। এতেই বোঝা যায় মুনাফালোভী বাগানমালিক আর রাষ্ট্রব্যবস্থা একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। ১০০ বছর পরও চা শ্রমিকদের মুল্লুকে চলো আন্দোলনের আবেদন বারবার তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ফিরে ফিরে আসে। চুক্তির মাধ্যমে চা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরিব্যবস্থা চালু করা যায়নি। অদ্যাবধি আইনগতভাবে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড দ্বারা শ্রমমূল্যের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। ফলে চা শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা এই রাষ্ট্র নির্ধারণ করে দিতে পারেনি।
আর চা শ্রমিকদের ভূমির অধিকার না থাকায় বাগানমালিকরা একুশ শতকেও জমিদার হিসেবেই রয়ে গেছে। হাজার হাজার চা শ্রমিকের বলিদানের পর আজ তার শতবর্ষেও এই রাষ্ট্র তাদের জীবনের মর্যাদা দেয়নি। গণহত্যার এই দিনটিকে মহান চা শ্রমিক দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় মহান চা শ্রমিক দিবস চিরভাস্বর হয়ে থাকুক। চা শ্রমিক দিবসের সংগ্রামের চেতনায় বারবার অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে চা শ্রমিকরা পুনর্জীবিত আর উদ্দীপ্ত হোক এই প্রত্যাশা রাখি।”

Manual3 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code