সিলেটের শতবর্ষের সাংবাদিকতার ইতিহাসে অবশ্য উচ্চার্য নাম বিপুল রঞ্জন চৌধুরী

প্রকাশিত: ১:০০ অপরাহ্ণ, মে ৩০, ২০২১

সিলেটের শতবর্ষের সাংবাদিকতার ইতিহাসে অবশ্য উচ্চার্য নাম বিপুল রঞ্জন চৌধুরী

Manual8 Ad Code

।।|| দেবাশীষ চৌধুরী রাজা ||।।

শ্রীমঙ্গল, ৩০ মে ২০২১ : সিলেটের শতবর্ষের সাংবাদিকতার ইতিহাসে অবশ্য উচ্চার্য নাম বিপুল রঞ্জন চৌধুরী।
জন্মেছিলেন ১৯২৪ সালের ৩১জানুয়ারি।জমিদারপুত্র ছিলেন । ১৯৫৪ সালে মাত্র ৬৫ বছর বয়সে দাদুর মৃত্যু হলে জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসাবে ২৯ বছর বয়সে বাবাকে জমিদারির দায়িত্ব নিতে হয়।
বাবারা ছিলেন চার ভাই ও তিন বোন। বর্তমানে কলকাতায় বসবাসরত এক ভাই এবং এক বোন ছাড়া বাকি সবাই পরলোকগত।
ব্যক্তিগত জীবনে আভিজাত্য, নীতিনিষ্ঠা, আদর্শবাদিতা, স্পষ্টভাষণ ছিলো তাঁর চারিত্র‍্যভূষণ।
সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ছিলেন অনুসন্ধানী, সত্যসন্ধানী ও কল্যাণব্রতী। কথা বলতেন মৃদুকণ্ঠে কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাসে। তোষামোদের ভাষা জানতেন না। ছিলেন দৃঢ়চেতা, অনেকটা অচটুল, আভাময় ও উপালি।
চল্লিশের দশকে আগরতলার ‘সংবাদ’ কলকাতার ’স্ট্যাটসম্যান’ ও ’আনন্দবাজার’ পত্রিকার যে কয়টি কপি শ্রীমঙ্গলে আসতো তার নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন তিনি।
১৯৬২ সালে প্রথম সাংবাদিকতা শুরু করেন সিলেটের সাপ্তাহিক যুগভেরী পত্রিকার মাধ্যমে। দেশের প্রাচীনতম (প্রথম প্রকাশ ১৯৩০) সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে যুগভেরীর নাম (বর্তমানে দৈনিক) ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
৪০-৫০ এর দশকে শিলচরের ‘সুরমা’, করিমগঞ্জের ‘যুগশক্তি’, কলকাতার ‘আনন্দবাজার’ ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ ও ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় দীর্ঘদিন লিখেছেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে একনাগাড়ে প্রায় বিশ বছর (১৯৭৬ – ১৯৯৫) শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন। কখনো হলুদ সাংবাদিকতা করেননি। মাথা নত করার মতো কোনো সংবাদ প্রকাশ করেননি। আপোষকামী ছিলেন না কখনো।
তাঁর সততা, সৃজনশীলতা ও কর্মদক্ষতার জন্য ১৯৬০ সালে শ্রীমঙ্গল পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাল্যবন্ধু শ্রী প্রদ্যুম্ন কুমার দেব চৌধুরীর সাথে শ্রীমঙ্গল রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের যুগ্ম-আহবায়ক ছিলেন। শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের গভর্নিং বডি(১৯৮০), ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, শ্রীমঙ্গল (১৯৮১), সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, শ্রীমঙ্গল (১৯৭৪) ও চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শ্রীমঙ্গলের (১৯৭৭) কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন।
আমাদের দাদু প্রতিষ্ঠিত ভুনবীর দশরথ উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ভুনবীর দশরথ উচ্চ বিদ্যালয়ের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে শহরের বাসা ও গ্রামের বাড়ির সর্বস্ব লুট হয়। গ্রামের বাড়ি ভীমসীতে কর্মচারী – গৃহকর্মীদের তাড়িয়ে দিয়ে ৭০০ মন আলু, ২০০ মন ধান, গরু-বাছুর, মহিষ, প্রচুর হাঁস-কবুতর, পাওয়ার টিলার, পাওয়ার পাম্প, দুইটি পুকুরভরা মাছ, আসবাবপত্রসহ সাতখানা টিনের ঘর ও দুটি দালানগৃহের দরজা-জানালা, টিন পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায়। সেই লুটেরাদের বিচারের আশায় ০৬/০৫/১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু বরাবর আবেদন করেন। যার অনুলিপি তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব আব্দুল মালেক উকিল, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী-কে প্রদান করেন। ০৮/০৬/১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে জেলা প্রশাসক সিলেট-কে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়। পট পরিবর্তনের কারণে তা আর এগোয়নি। বাবা থেমে থাকেন নি। ৩১/০৬/১৯৯৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর বিচার চেয়ে আবেদন করেন কিন্ত কিছু হয়নি। পরবর্তীতে ২২/০৯/২০১১ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর পুনরায় আবেদন করেন। এর প্রেক্ষিতে ৩০/০৯/২০১৪ তারিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের পরিচালক কর্তৃক তদন্তের জন্য বাবাকে মৌলভীবাজার সার্কিট হাউসে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু অসুস্থতার জন্য উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়নি।

Manual4 Ad Code

ছিলেন অত্যন্ত গুছানো, পরিপাটি এবং পোশাক সচেতন। সাদা রঙের পোশাক পরতে ভালোবাসতেন। বাংলা, ইংরেজি বানান এবং বাক্যগঠনে অশুদ্ধতা ছিল অমার্জনীয় অপরাধের মতো। গ্রামের লোকজন বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বাসায় আসলে সমাধানের পথ বাতলে দিতেন।
ভ্রমণ, ছবিতোলা, গাছ লাগানো ছিল শখ।
কোথাও গেলে পছন্দের গাছ নিয়ে আসতেন।
পছন্দের মানুষ আর নাতি-নাতনিদের কাছে রাশভারি ভাবটা খুঁজে পাওয়া যেতো না।
যেকোনো কাজ নিখুঁত হওয়া চাই।
যেকোনো তথ্যের একেবারে বিন্দুবিসর্গ খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করতেন।
নিজে বাজার করতেন।
কাপড়চোপড়, ঔষধ, মুদিপণ্য, জুতার নির্দিষ্ট দোকান থেকে ক্রয়কৃত পণ্যের মূল্য পরিশোধ করা হয় বাৎসরিক।
চৈত্র মাসের শুরুতেই বাকির হিসাব পাঠানোর জন্য বাবা দোকান মালিকগণকে তাগিদ দিতেন যাতে পয়লা বৈশাখের আগেই বকেয়া পরিশোধ করতে পারেন। যেনো পাওনাদারের থেকে দেনাদারের চিন্তা বেশি।

ছিলেন নজরুল সঙ্গীত, শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তনের ভক্ত। বাসায় বা কোনো অনুষ্ঠানে গানের চেয়ে যন্ত্রের শব্দ বেশি হলে বলে দিতেন। ছিলেন বোদ্ধা শ্রোতা। একবার আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে এসে রাত খাওয়ার টেবিলে বলেছিলেন ’স্ক্রিপ্ট পড়ার পর প্রায় প্রতিটি গান শুরুতে বেশি সময় নিয়েছো তোমরা!’
বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলাগুলো আমাদের সাথে, এবং পরবর্তীতে নাতিদের সাথে রাত জেগে উৎসবের আমেজে দেখতেন। ছিলেন ম্যারাডোনা আর আর্জেন্টিনার ঘোর সমর্থক। আমাদের শিক্ষার্থী জীবনে বিকালে কোনো অবস্থাতেই পড়া বা গানবাজনার শিক্ষক আসা বাবা মেনে নিতেন না, কারণ ঐ সময় আমাদেরকে মাঠে থাকতে উৎসাহ দিতেন। কোনো পুরানো তথ্যের প্রয়োজনে পরিচিত অপিরিচিত নির্বিশেষে মানুষ বাবার শরণাপন্ন হতেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও জাতিভেদ প্রথার ঊর্ধ্বে তিনি সবসময় মানুষকে প্রাধান্য দিয়েছেন। যখন যাকে যা বলার তা আড়ালে না বলে সামনাসামনি বলতেন। ছোটবেলায় আমাদেরকে, পরবর্তীতে নাতি-নাতনিদের নিয়ে রথ ও আমাদের গ্রামের চড়কপূজায় যাওয়া ছিল প্রতিবছরের কাজ।
আইনশৃঙ্খলা, নিয়মনীতি উপেক্ষিত হয় এমন কিছু তিনি কখনো করতেন না। সরকারের খাজনা, পৌরট্যাক্সসহ সকল ধরনের বিল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করা ছিল রুটিন কাজ।
স্বাস্থ্য-সচেতনতার কারণে বাবার মাথাব্যথা, দাঁতেব্যথা, পেটেব্যাথা, ডায়বেটিস, উচ্চরক্তচাপ এগুলোর কিছুই ছিল না। অনেক সময় নিয়ে হাত ধুতেন (এই করোনাকালের মতো), স্নান করতেন পুকুরে সময় নিয়ে।
২০১৫ সালের ৩০ মে বিকাল ৪:২০মি.-এ ৯২ বছর বয়সে শ্রীমঙ্গল শহরস্থ বাসায় বার্ধ্যক্যজনিত কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

Manual3 Ad Code

স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্পদহীন, গৃহহীন হলেও বাবা পুরানো তথ্যবহুল কাগজপত্র এবং ছবিসমূহ সাথে নিয়েছিলেন, যার কয়েকটি সংযুক্ত করলাম।

Manual2 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code