ওরসের শেষ দিনে হজরত শাহপরান (রহ.) মাজারে হামলা ও লুটপাট

প্রকাশিত: ৭:৩৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৪

ওরসের শেষ দিনে হজরত শাহপরান (রহ.) মাজারে হামলা ও লুটপাট

নিজস্ব প্রতিবেদক | সিলেট, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ : সিলেটের হজরত শাহপরান (রহ.)-এর মাজারে তিনদিনব্যাপী ওরসের শেষ দিনে হামলা ও দানবাক্স লুটপাট, আশেক-ফকির তরীকতপন্থীদের সঙ্গে উগ্রবাদীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন।

গতকাল সোমবার দিবাগত রাত তিনটা থেকে ফজরের সময় পর্যন্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত শনিবার শাহপরান (রহ.)-এর মাজারে তিন দিনব্যাপী ওরস শুরু হয়। ওরস শুরুর আগের দিন শুক্রবার জুমার নামাজের পর তরীকতপন্থীদের ছামা-কাউয়ালী, গানবাজনা, মাদক সেবনসহ নানা কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তুলে এসব বন্ধের দাবিতে মাজারগেটের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে উগ্রবাদীরা। বিকেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় হজরত শাহপরান মাজারের খাদেম সৈয়দ কাবুল আহমদ মাজারে গানবাজনা বন্ধের ঘোষণা দেন। এ অবস্থায় ওরস চলাকালে কেউ যেন মাজারে গানবাজনা চালাতে না পারেন, সে জন্য শুরু থেকেই মাজার কর্তৃপক্ষ, মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয় আলেম-ওলামা কড়া নজর রাখেন।

হজরত শাহপরান (রহ.)-এর মাজারে হামলাকারীরা ভাঙচুর করে নিয়ে যায় সিসিটিভি ক্যামেরা।

গতকাল দিবাগত রাত তিনটা থেকে আখেরি মোনাজাত শেষে শিরনি বিতরণের মধ্য দিয়ে ওরস শেষ হওয়ার কথা ছিল। দিবাগত রাত তিনটার দিকে হাজার হাজার তরীকতপন্থী ব্যক্তি মাজারে এসে কেন গানবাজনা নিষিদ্ধ হলো, এ নিয়ে ক্ষোভ জানান। বিক্ষোভকারী কিছু ব্যক্তির হাতে লাঠিসোঁটা ছিল। এ সময় উগ্রবাদীদের সঙ্গে তরীকতপন্থী ব্যক্তিদের তর্কাতর্কি হয়। ওই ব্যক্তিরা কিছু শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে মারধর করেন এবং ফকির-পাগল ও তাঁদের হয়ে একটি পক্ষ মাজারের ভেতরে মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আটকে রেখেছেন, এমন একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে। এ উত্তেজনার সূত্র ধরেই পরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শী, মাজার কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পার্শ্ববর্তী জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর এলাকাসহ সিলেট সদর উপজেলার বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, আলেম-ওলামা ও স্থানীয় লোকজন মাজারে আসেন। এ সময় অনেকের হাতে লাঠিসোঁটা ছিল। পরে মাজারপন্থীদের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হন। সংঘর্ষের সময় ইটপাটকেলের আঘাতে মাজারের খাদেমের কক্ষের কাচ ভেঙে যায় এবং দানবাক্স লুটপাট হয়।

হজরত শাহপরান (রহ.)-এর মাজারে হামলাকারীরা জানালার কাচ ভাঙচুর করে।

সংঘর্ষ চলাকালে ওরস উপলক্ষে তৈরি করা পাগল-ফকিরদের তাঁবু-আস্তানা ভেঙে ফেলা হয়। তাড়িয়ে দেওয়া হয় মাজারে থাকা পাগল-ফকিরদের। অনেক পাগল-ফকির দৌড়ে পালিয়ে গেলেও বেশ কিছু পাগল-ফকির বেধড়ক পিটুনির শিকার হন। একপর্যায়ে পাগল-ফকিরদের পক্ষ নেওয়া মানুষও পিছু হটে। পরে ভোররাত সাড়ে চারটার দিকে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

সংঘর্ষের ঘটনায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, ওরসে আসা মাদকসেবী ব্যক্তিরাই পরিস্থিতি অশান্ত করতে উচ্ছৃঙ্খলতা করেছে। পরে ওই মহল অতর্কিতভাবে মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়ে আটকে রাখে। অন্যদিকে পাগল-ফকিরদের অভিযোগ, গানবাজনা বন্ধের নামে ওরস উপলক্ষে মাজারে আসা ফকির-পাগলদের কোনো কারণ ছাড়াই কিছু ব্যক্তি শুরু থেকেই নানাভাবে হেনস্তা ও অপমান করছিলেন। ওরসের শেষ দিন সংঘর্ষ হলে তাঁদের মারধরও করা হয়।

সংঘর্ষ চলাকালে ওরস উপলক্ষে তৈরি করা পাগল-ফকিরদের তাঁবু-আস্তানা ভেঙে ফেলা হয়। ভাঙা হয় চেয়ার।

সিলেট মহানগরের শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে কল রিসিভ করেন উপপরিদর্শক (এসআই) অনুপ কুমার চৌধুরী। তিনি বলেন, বর্তমানে শাহপরান মাজার এলাকার পরিস্থিতি শান্ত আছে। আজ মঙ্গলবার বেলা তিনটা পর্যন্ত এ ঘটনায় থানায় কেউ অভিযোগ করেননি।

মাজারের খাদেম সৈয়দ কাবুল আহমদ জানান, প্রায় ৭০০ বছর ধরে শাহপরান মাজারে ওরস পালিত হচ্ছে। একইভাবে প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকেও মাজারে গানবাজনা হতো। তবে অতীতে ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে গানবাজনা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এর সুস্থ পরিবেশ বিনষ্ট হয়ে গেছে। এখন গানবাজনার আড়ালে মাদক ব্যবসা, নাচ ইত্যাদি ঢুকে পড়ায় মাজারে গানবাজনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়।

আগের রাতে হামলার পর থমথমে সিলেটের হজরত শাহপরান (রহ.)-এর মাজার প্রাঙ্গন।

খাদেম আরও বলেন, গতকাল ওরসের শেষ সময়ে এসে তৃতীয় পক্ষ মাজারের মাইক কেড়ে নিয়ে ‘গানবাজনা হবেই, কেউ আটকাতে পারবে না, ঠেকাতে পারবে না’ বলে ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণা দিয়ে ওই মহল ফকির-পাগলদের উসকিয়ে দেয়। ওই পক্ষ মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মারধরও করে। তবে মাজারের খাদেমেরা তাঁদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে আসেন। এ খবর পেয়ে আশপাশের মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও জনতা ছুটে আসেন। এরপরই সংঘর্ষ হয়।

এদিকে শাহপরান মাজারে পাহারায় থাকা মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, আলেম-ওলামা ও জনতার ওপর অতর্কিত হামলার অভিযোগ এনে মাজারগেটে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। ‘অসামাজিক ও অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটির’ ব্যানারে আজ বেলা তিনটায় এ কর্মসূচিতে বিক্ষুব্ধ জনতা, আলেম-ওলামা ও মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। এ সময় ‘ভণ্ডদের আস্তানা, জ্বালিয়ে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’, ‘হইহই রইরই, ভণ্ডরা গেল কই’–সহ নানা স্লোগান দেওয়া হয়।

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ