কেউ কি আজ তোমার কথা ভেবেছে? — মনের অনুপম বিস্ময় ও স্মৃতির বিজ্ঞানে এক ঝলক

প্রকাশিত: ১২:১৩ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৩, ২০২৫

কেউ কি আজ তোমার কথা ভেবেছে? — মনের অনুপম বিস্ময় ও স্মৃতির বিজ্ঞানে এক ঝলক

Manual5 Ad Code

সৈয়দা হাজেরা সুলতানা |

প্রতিদিন আমাদের মস্তিষ্কে ঝড় ওঠে প্রায় ছয় হাজারেরও বেশি চিন্তা। সেই চিন্তাগুলোর মধ্যে কতগুলো যে নিজেদের অজান্তেই অন্য কারও মুখ, কণ্ঠ, গন্ধ বা নামকে স্পর্শ করে যায়—তার হিসেব রাখে না কেউ।
কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, এমনটা কেবল কল্পনা নয়, এটি সম্পূর্ণ সম্ভব এক বাস্তব মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
????
চিন্তার জটিল মহাবিশ্ব

মানব মস্তিষ্ক এক আশ্চর্য কারখানা। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের গবেষণা অনুযায়ী, গড়ে একজন মানুষ দিনে প্রায় ৬,০০০ থেকে ৬,৫০০টি আলাদা চিন্তা করে। এসব চিন্তার অনেকই ক্ষণস্থায়ী—একটি মুহূর্তের জন্য আসে, তারপর হারিয়ে যায়। কিন্তু কিছু চিন্তা থাকে অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে, স্মৃতির ভাঁজে স্থায়ী হয়ে যায়।
মনোবিজ্ঞানে একে বলা হয় emotional tagging—যে মুহূর্তে কোনো স্মৃতি আমাদের আবেগের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন সেটি মস্তিষ্কে বিশেষভাবে ‘চিহ্নিত’ হয়ে থাকে। তাই কোনো সুর, গন্ধ বা দৃশ্য হঠাৎ করেই পুরনো কারও স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে পারে।
????
“স্পন্টেনিয়াস মেমোরি রিট্রিভাল” — হঠাৎ ফিরে আসা এক মুখ

ধরা যাক, কোনো কফি শপে বসে আছো, আর হঠাৎ ভেসে এল পরিচিত এক গানের সুর। মুহূর্তেই মনে পড়ল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে কেউ একদিন গুনগুন করেছিল সেই গানটা।
এই প্রক্রিয়াটিই বিজ্ঞানের ভাষায় spontaneous memory retrieval বা cue-triggered recall—অর্থাৎ, বাইরের কোনো উদ্দীপনা (যেমন শব্দ, গন্ধ, স্থান বা দৃশ্য) আমাদের মস্তিষ্কে সংরক্ষিত কোনো স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে।
নিউরোসায়েন্টিস্ট ড্যানিয়েল শ্যাক্টার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস অঞ্চল মূলত এই “স্মৃতি আহ্বান” প্রক্রিয়ায় কাজ করে—যেখানে প্রতিটি স্মৃতি তার পরিবেশ ও আবেগীয় প্রেক্ষাপটসহ সংরক্ষিত থাকে।
????
অন্যের চিন্তায় আমাদের উপস্থিতি

Manual3 Ad Code

তাহলে কি সম্ভব—কেউ এখন দূরে কোথাও বসে তোমার কথা ভাবছে?
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, হ্যাঁ, সম্ভব। কারণ “স্মৃতি” কেবল তথ্য নয়; এটি এক আবেগীয় ছাপ। কোনো মানুষ আমাদের জীবনে যে আবেগের রঙ ছড়িয়ে যায়—তা আমাদের নিউরোনে ক্ষুদ্র এক নকশা এঁকে দেয়। তাই যখনই সেই আবেগ-সদৃশ কোনো উদ্দীপনা আসে, সেই মুখটি মস্তিষ্কে ফিরে আসে।
অর্থাৎ, হয়তো কোনো জায়গায় কেউ হঠাৎ তোমার প্রিয় পারফিউমের গন্ধ পেল, কিংবা দেখল সেই রঙের শার্ট, যা তোমার সঙ্গে দেখা করার দিনে পরা ছিল—আর মুহূর্তেই তোমার নামের ঝলকটি তার চিন্তায় জ্বলে উঠল।
????
স্মৃতি, সম্পর্ক ও নীরব যোগাযোগ

মানবসম্পর্কের এই স্মৃতি-নির্ভর উপস্থিতি আমাদের আবেগীয় অস্তিত্বের সূক্ষ্ম প্রমাণ। অনেক সময় আমরা যাঁদের আর জীবনে পাই না, তাঁরাও রয়ে যান চিন্তার ছায়ায়। কারণ মস্তিষ্কের সংযোগব্যবস্থায় (synaptic network) একবার তৈরি হওয়া সংযোগ সহজে মুছে যায় না।
অতএব, “ভুলে গেছি” বললেও, প্রকৃতপক্ষে আমাদের মস্তিষ্ক সেই মানুষটিকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারে না। শুধু নিস্তব্ধ করে রাখে। আর কোনো এক গন্ধ, কোনো সুর বা দৃশ্য আবার সেই নিস্তব্ধ স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে।
????
মনস্তত্ত্বের কাব্যিক দিক

Manual7 Ad Code

এই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক গভীর মানবিক সুর। আমাদের মনে হঠাৎ কেউ ফিরে আসে—এর মানে আমরা একে অপরের জীবনে এক ধরনের নীরব উপস্থিতি রাখি। হয়তো চোখের দেখা নেই, কথাও নেই, তবুও চিন্তার কোনো স্রোতপথে আমরা পরস্পরের মস্তিষ্কে ঘুরে বেড়াই।
এ কারণেই কবিরা বলেন, “মন ছুঁয়ে যায় মন”—এটি কেবল কাব্যিক আবেগ নয়, বরং মানবমস্তিষ্কের বৈজ্ঞানিক সত্যও বটে।
????
শেষকথা

Manual3 Ad Code

তাহলে আজ, যখন তুমি হঠাৎ কোনো গন্ধে, গানে বা স্মৃতিতে কারও মুখ মনে আনলে, একটু ভেবে দেখো—হয়তো সেও আজ কোথাও তোমার কথা ভেবেছে।
মানুষের চিন্তার এই পরস্পর-ছোঁয়া মুহূর্তগুলোই তো প্রমাণ করে, আমরা কেবল দেহ দিয়ে নয়, স্মৃতি ও অনুভূতির সুতায়ও গভীরভাবে যুক্ত।

#

লেখক:
সৈয়দা হাজেরা সুলতানা (শানজিদা)
শিক্ষার্থী
পদার্থবিজ্ঞান সম্মান (১ম বর্ষ)
মুরারিচাঁদ কলেজ
সিলেট।
বিষয়: মনোবিজ্ঞান ও মানবসম্পর্ক

Manual2 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code