কিন্তু সংসার চলছে না যে! তাই শুরু করলেন অভিনয়

প্রকাশিত: ৩:৩০ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৬, ২০২০

কিন্তু সংসার চলছে না যে! তাই শুরু করলেন অভিনয়

|| অনিমেষ দত্ত || হাওড়া (ভারত), ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ : ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ সাল, কারাগারে রাজনৈতিক বন্দি তৎকালীন ‘বিখ্যাত’ কমিউনিস্ট সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সংসার চলছে না যে! তার জন্যই সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় যোগ দিলেন গণনাট্য সংঘে। শুরু করলেন অভিনয়। অভিনেত্রী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁকে আমরা সর্বজয়া নামেই চিনি। জন্ম ১৯১৯ সালে। অধুনা বাংলাদেশের খুলনা জেলায় পৈতৃক বাড়ি থাকলেও করুণার জন্ম হয় সাঁওতাল পরগনার মহেশপুরে। করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি, ডায়েরি সংকলন এবং তাঁকে নিয়ে গ্রন্থ ‘সর্বজয়া, অ্যান অ্যাক্ট্রেস ইন হার টাইম’ পড়লে খুঁটিনাটি নানান তথ্য জানা যাবে। ভাত রাঁধতে জানার প্রমাণ দিতে গিয়ে বন্ধু পরিমলকে দেখিয়েছেন ভাত রাঁধার জন্য কী পরিমাণ নুন দিতে হয়, কখনও রোম্যান্টিক কবিতা লিখে পুঁতে দিয়েছেন প্রিয় গোলাপ গাছের নিচে, আবার ‘বে অফ বেঙ্গল’কে ভুল করে ‘প্যাসিফিক ওশান’ লিখে গাঁট্টা খেয়েছেন দাদাদের হাতে।

সম্পূর্ণ রূপ দিতে পেরেছিলেন। ‘পথের পাঁচালি’ এবং ‘অপরাজিত’ ছবিতে সর্বজয়া তিনিই। শহুরে উচ্চশিক্ষিত মহিলা হয়েও ধরতে পেরেছিলেন চরিত্রের কান্না। সেই আর্তনাদেই কেঁদে উঠেছিলেন একদল সিনেমাপাগল মানুষ। কাঁদেন তো এখনও। বলা ভালো সর্বজয়া ওরফে করুণা চরিত্রের কাছে নতজানু হয়ে জিতে গিয়েছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছিল এক গ্রাম্য মা-কে। যিনি অপু, দুর্গাকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেন আবার শাসনও করেন। দুর্গা মারা যাবার পর অপুর বড়ো হবার একমাত্র সঙ্গী তো তিনিই। সত্যজিতের উল্লিখিত ছবি দু’টি ছাড়াও অভিনয় করেছিলেন ‘দেবী’ এবং ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতেও। এছাড়াও কাজ করেছেন মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ ও ‘কলকাতা ৭১’-এ, শম্ভু মিত্র এবং অমিত মৈত্রের ‘শুভ বিবাহ’, অগ্রগামীর ‘হেডমাস্টার’, ঋত্বিক ঘটকের অসমাপ্ত ছবি ‘কত অজানারে’ এবং ঋতুপর্ণ ঘোষের অমুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘অন্ত্যেষ্টি’ ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন।

তাঁর ডায়েরি পড়লে জানা যায়, তিনি একের পর এক ছবিতে অভিনয় করছেন আর শুটিং শেষ করে সারা রাত ধরে প্রগতি আন্দোলনের পোস্টার মারছেন রাস্তায় রাস্তায়। লিখছেন, “একটাই স্বপ্ন, বাঁচার মতো করে পৃথিবীটাকে তৈরি করতে হবে। আর কোনো কাজ নেই— সামনে দু’হাতে পাথর ঠেলে সরিয়ে সবুজ ঘাসে ঢাকা সেই জমিটা আমাদের খুঁজে বার করতে হবে যেখানে জীবনটা অন্যরকম— সেই জন্যই তো আন্দোলন।”

সে যুগের গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে কাজ করেছেন করুণা। চুনিবালা দেবী, পাহাড়ি সান্যাল, ছবি বিশ্বাস, কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে চুটিয়ে কাজ করেছিলেন। পাশাপাশি নজর কেড়েছিলেন করুণা। ১৯১৯-২০১৯, কোনো জাঁকজমক নেই, কোনো আড়ম্বর নেই, প্রায় নিঃশব্দেই কেটে গেছে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম শতবর্ষ। এই অভিনেত্রীকে ‘সর্বজয়া’ ছাড়া তাঁর নাম হিসাবে কজনই বা মনে রেখেছেন! আর অভিনেত্রী বাদে, একজন কমিউনিস্ট হিসেবে মনে রাখার আশা করা অবাস্তব! ওনাকে কি এত সরলভাবেই আমরা ভুলে যাব?

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৫৯ সালে ‘ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি অব ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন আর্ট’ তাদের দ্বাদশ ব্রিটিশ ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার জন্য ছয়জন বিদেশি অভিনেত্রীর তালিকা তৈরি করেন। সেই তালিকার মধ্যে ছিলেন ইনগ্রিড বার্গম্যান, তাতিয়ানা সামজলোভা, জোয়ানে উডওয়ার্ড, গুইলেত্তা মাসিনা, আনা ম্যাগনানি— এই পাঁচ অভিনেত্রীর সঙ্গে জ্বলজ্বল করছিল একটি নাম, তিনি করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বঙ্গদর্শন থেকে,