বীর মুক্তিযোদ্ধা পাপড়ি বসু সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিল

প্রকাশিত: ৫:৫৭ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৬, ২০২০

বীর মুক্তিযোদ্ধা পাপড়ি বসু সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিল

কুমিল্লা (দক্ষিণ), ১৬ ডিসেম্বর ২০২০ : বিদ্যালয় জীবন থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামের সামনের সারিতে কুমিল্লার পাপড়ি বসু। আগরতলায় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সাথে নেচে-গেয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। দিনের পর দিন রুটি বানিয়ে সরবরাহ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের।

কুমিল্লায় ১৯৫৬ সালের ২ মার্চ জন্ম গ্রহণ করেন পাপড়ি বসু। মা মায়া ধর এবং বাবা প্রমথ চন্দ্র ধর। ছোট থেকেই নাচ-গানসহ সাংস্কৃতিক ধারায় নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছেন পাপড়ি। একইসাথে উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল তাঁর চলন-বলনে। ফলে তিনি যখন মাত্র অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী তখনই পাকিস্তান সরকারের চাপিয়ে দেওয়া একটি পাঠ্যবই প্রত্যাহার করার দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন পাপড়ি বসু। এমনকি দাবি আদায়ে শিক্ষা বোর্ডের সামনে অনশন ধর্মঘট করেছিলেন তারা। সেখানে তৎকালীন পাকিস্তানি নিরাপত্তা কর্মীদের মুখোমুখি হন তারা। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার নামে পরিচিত ফরিদা বিদ্যায়তনের ছাত্রী হিসেবে সেই বিদ্যালয় জীবন থেকেই মুক্তি সংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন পাপড়ি।
এরপর ১৯৭১ সালে আসে ২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাত্রি। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুর এ দিনগুলো সম্পর্কে পাপড়ি বসু বাসসকে বলেন, আমাদের বাড়িটা হচ্ছে বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার সংলগ্ন যেখানে কাজী নজরুল ইসলাম আসতেন আমার দিদিমার কাছে। ঐ বাড়ির বিশাল মাঠ ছিল। সেখানে যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই প্রস্তুতিমূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরম্ভ করা হয়। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, যুদ্ধ আসন্ন৷ তাই আমরা সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। একদিন সত্যি সত্যি যুদ্ধ শুরু হলো। আমাদের বাসাটি কুমিল্লা পুলিশ লাইন থেকে একটু দূরে ছিল। ডিনামাইট দিয়ে রুস্তম আলীর বাড়ি উড়িয়ে দেওয়া হলো। সেই রাতের কথা কোনোদিনই ভুলবো না। আমাদের বাসার দু’টো বাসা সামনে যতীন্দ্র ভদ্রের বাসা ছিল। তার দুই ছেলে ডাক্তারি পড়তো – কাজল এবং রতন। বাবা-ছেলে এবং তাদের বাড়ির ভাড়াটিয়াসহ প্রায় ১০/১২ জনকে একইসাথে মেরে ফেলেছিল পাক সেনারা। তবে তাঁর মেয়ে শুভ্রা আমাদের বাড়ি দিয়ে পেছনে পালিয়ে বেঁচে যায়। এ অবস্থায় আমরা আর সেখানে থাকতে পারিনি। আমরা লাকসাম রোডে গিয়ে এক আতœীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। কিন্তু সেখানেও বেশি সময় থাকা সম্ভব হলো না। পরের দিন আমরা দেখলাম এন পি রায় চৌধুরী এবং প্রকাশ সাধুকে গুলি করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হলো। এমনকি সাথে কুকুরটিকেও মারা হয়েছিল। এরপর কারফিউ শিথিল হলে আমি মামার সাথে বুড়িচং দিয়ে পায়ে হেটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আগরতলায় চলে যায়।
দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য আরো বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখতে কখনো ঝোপ-জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে নানা বিপদ-আপদ মাড়িয়ে ভারতে পৌঁছান পাপড়ি এবং তাঁর সঙ্গীরা। সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কীভাবে কাজ করেন সেসব ঘটনা জানাতে গিয়ে তিনি বাসসকে বলেন, প্রথমে জেঠিমার বাড়িতে উঠলেও পরে আমরা সূর্যমনি শিবিরে চলে যাই। সেখানে আমরা একটি গোষ্ঠী তৈরি করি। অভিনেত্রী সুজাতার বড় বোন কৃষ্ণাসহ আমরা নৃত্যশিল্পী অসিত চৌধুরীর নেতৃত্বের একটি সাংস্কৃতিক ও নাট্য গোষ্ঠী গড়ে তুলি৷ সে সময় আমার দাদার এক বন্ধু একটি গাড়ি দিয়েছিলেন। সেই গাড়িতে করে আমরা বিভিন্ন জায়গায় নাচ-গান করতাম। সেই নাচ-গান পরিবেশন করে আমরা যে অর্থ পেতাম সেটা সেলিনা বানুর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের দিতাম। পরে যখন মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে আহত হয়ে আসতে থাকলেন তখন তিনি আমাদের বিশ্রামনগর শিবিরে নিয়ে যেতেন তাদের সেবা-শুশ্রুষা করার জন্য। এরপর ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী সুখময় সেন গুপ্তের সাথে পরামর্শ করে আমার জেঠিমা আমাদের রুটি বানানোর দায়িত্ব দেন। ফলে নাচ-গানের পাশাপাশি চিত্রাদি, আমি, আমার বড় বোন ভারতীসহ সবাই মিলে রুটি করে জেঠিমার হাতে তুলে দিতাম, কখনো সেলিনা বানুর হাতেও দিতাম। আমরা অনেক রুটি তৈরি করেছি। পাপড়ি বসু হলেন একজন বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, সমাজকর্মী ও নারী অধিকার কর্মী। তিনি ২০১৯ সালে বেগম রোকেয়া পদক লাভ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম রোকেয়া পদকটি তার হাতে তুলে দেন।