রুপম জেগে উঠো

প্রকাশিত: ১:১৩ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২১

রুপম জেগে উঠো

|| জিয়াউল হক জিয়া || মন্ট্রিয়ল (কানাডা), ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ : আজ ১৩ ফেব্রুয়ারী ছাত্রমৈত্রী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহসভাপতি দেবাশীষ ভট্টাচার্য রুপমের ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৫ সনে ছাত্র মৈত্রীর নেতৃত্বে অপরাপর প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের সাথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র শিবিরের তুমুল সংঘর্ষের পর শিবিরের রক্ষক ছাত্রদল ও তাদের বিএনপি সরকার বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে এবং ছাত্রদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। শিবির সেদিন ক্যাম্পাস দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আশেপাশের গ্রামগুলি থেকে জামাত-শিবির বিরোধী ছাত্র-ছাত্রিদের উপর চোরা গোপ্তা হামলা শুরু করে। রুপম রাজশাহী সাহেব বাজার মোড় থেকে ঢাকা গামী নাইট কোচ সকাল-সন্ধ্যা’য় করে পাবনা তার নিজের বাড়িতে ফিরছিল ওইদিন রাতে। রুপম ছাত্র মৈত্রীর একজন সাহসী যোদ্ধা ছিল। শিবিরের অনুচর তাকে গোপনে অনুসরন করে এবং বাস টার্মিনাল থেকে তাদের টীম বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ প্রান্তে বিনোদপুর-সায়েন্স ল্যবরেটরীর মোড়ে শিবির সন্ত্রাসীদের খবর দিলে তারা বাসটি ওই স্থান দিয়ে যাওয়ার পূর্ব থেকেই সেখানে মধ্যযুগীয় অস্ত্রশস্ত্র সহ অপেক্ষা করতে থাকে। বাসটিকে তারা বেরিকেড দিয়ে থামায় এর পর হায়েনার দল বাসের ভিতরে চালককে ফ্রিজ করে ফেলে। রুপম ছিল বাসের মধ্যের সারিতে বসা। হতবাক নির্ভীক রুপম কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে প্রায় ৪৫ জন যাত্রীর সামনে চাপাতি, দা, চাইনিজ কুরাল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। তার মেরুদন্ড প্রায় দ্বিখণ্ডিত করে, হাত পায়ের রগ কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করার পর বাসের চালক কে অনুমতি দেয় গাড়ি চালিয়ে যেতে তাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। বাস চালক রুপমের লাশ ও যাত্রি সহ প্রায় ৩০ মাইল পথ অতিক্রম করে নাটোর জেলা বাস কাউন্টারে এসে বাস চালানো বন্ধ করে দেয়, নাটোর ছাত্র মৈত্রীর নেতাকর্মীরা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয় কিন্তু সেতো আগেই চলে গেছে না ফেরার দেশে। আমি তখন ছাত্র মৈত্রীর কেন্দ্রীয় সাধারন সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলিতে সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত ছিলাম। নীলক্ষেত বাবুপুরা, কাটাবনে ছাত্র মৈত্রীর কেন্দ্রীয় অফিসে ফোন আসে নাটোর ও ঢাকা ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় অফিস থেকে। হলে থাকতেই খবরটি শুনে দ্রুত পার্টি অফিসে যাই এবং রাত আনুমানিক দশটার দিকে পাবনার উদ্দেশ্যে রওনা হই। গাবতলী গিয়ে দেখি উত্তরবঙ্গের সব নাইটকোচ ততক্ষনে ছেড়ে চলে গেছে। তখন বঙ্গবন্ধু সেতু ছিলনা, ফেরী পারাপারই ছিল উত্তরবঙ্গের সাথে মুল যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পথে মিনিবাস, ট্রাক, ফেরি এবং নগরবাড়ি গিয়ে পাবনা গামী সরাসরি একটি বাসে করে পাবনা পৌছাই ভোর আনুমানিক ৬-৩০ থেকে ৭ টায়। শহরে প্রবেশের আগেই জানতে পারলাম শহরে ততক্ষনে আওয়ামি লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, সিপিবি সহ সর্বদলীয় ব্যানারে রুপম হত্যার প্রতিবাদে হরতাল শুরু হয়েছে। আমি বাইপাস সড়কে নেমে একটি রিক্সা ভ্যানে করে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে শহরের নিকটে পৌঁছার পরে সেখান থেকে পায়ে হেটে দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে হরতালে যোগ দেই। রুপমের লাশ শহরে তার বাড়িতে আসার পর থেকেই মানুষের ভীড় বাড়তে থাকে এই সাহসি যোদ্ধাকে এক নজর দেখবার জন্য। বাবা মায়ের আহাজাড়িতে ভুমি কেপে উঠছিল, বাতাস ভারী হয়ে আসছিল। আমার সাহস হচ্ছিলনা ওর বাবা মায়ের সামনে যাবার, কারণ তাদের সন্তান হারানোর শোকের ওই চরম মুহূর্তে সান্ত্বনা বা সমবেদনা প্রকাশের কোন ক্ষমতা আমার ছিলনা। ওর লাশ দেখে একজন সুস্থ মানুষও অসুস্থ ও ভীত হয়ে পড়বে। এতো ভয়ঙ্কর! একটি জীবন্ত মানুষকে কষাইরা মৃত পশুর মাংসের ন্যায় কুপিয়েছে। রুপমের মত ছাত্র মৈত্রীর অন্যান্য সহযোদ্ধা জামিল, ফারুক ও রিমু কে শিবিরের খুনিরা একই কায়দায় হত্যা করেছিল বিভিন্ন সময়। দলের দায়িত্ব প্রাপ্ত একজন কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা হিসেবে রুপম হত্যার সেই দায়দায়িত্ব থেকে নিজেকে বাইরে রাখতে পারিনি। ওই হত্যাকান্ডের বীভৎসতা আমাকে আজও কাঁদায়। রুপমদের মত অসংখ্য শহিদের রক্তদানের মধ্য দিয়েই সেদিন শিবির বিরোধী যে আন্দোলনের সুচনা হয়েছিল তার ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলাদেশ। শত শহিদের খুনী এই জামাত-শিবির বিরোধী আন্দোলনে আমরা ছাত্রজীবনে কখনই আপোষ করিনি। এখনও আছি সেই প্রতিজ্ঞায় অটল। শুধু কষ্ট, রুপমরা সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল একটি শোষোণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ধারণ করে; আজ সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন থেকে আমরা দূরে, বহুদূরে, স্বপ্ন যেন বারবার দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে এসেছে আমাদের মাঝে। আজকে আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, রুপমের আদর্শের সেই সংগঠনের আর সেই ব্যাপকতা নেই, রুপম দিবসের কর্মসূচিও ডিজিটাল কর্মসূচিতে রুপ নিয়েছে,স্মার্ট ফোন আর কমপিউটারে এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে দু একটি স্ট্যাটাসের মধ্যেই যার সীমাবদ্ধতা। রাজপথে রুপম হত্যার প্রতিশোধের আগুন আর জ্বলে না। শুনি রুপমের ছাত্র মৈত্রীর অনেক নেতাই যাদের ভাত খাওয়ার পয়সা ছিলনা, তারা আজ কোটি কোটি টাকার মালিক। আমরা যখন দল করেছি তখন অর্থ কষ্ট থাকার পরেও তেজ ছিল, সততা ছিল, সংগঠন গড়ার জালা ছিল, এখন আমাদের ক্ষমতা আছে, অর্থ আছে, কিন্তু সততা নেই, সংগঠন গড়ার সেই আদর্শিক মনোবল নেই। রুপম তোমাদের আত্মদান কখনই বৃথা যেতে পারেনা, কখনই না। আমরা এতদিন শ্লোগান দিয়েছি-ঘুমাও শান্তিতে রুপম, আমরা জেগে আছি অবিচল। এখন আমরা আর জেগে নেই, তাই বলি তোমরা ঘুমিয়ে থেকোনা, জেগে উঠো, জ্বালিয়ে দাও সবকিছু, আমাকেও, আমাদের সবকেই, যারা সেদিন তোমাকে ওই খুনীদের বিরুদ্ধে ঢাল বানিয়েছিল একটি স্বপ্ন দেখিয়ে।
#
জিয়াউল হক জিয়া
প্রাক্তন সভাপতি
বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, কেন্দ্রীয় কমিটি।
১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ