গণস্বার্থের সাংবাদিকতার জন্যই সংবাদপত্রকে বদলে দিয়েছিলেন যিনি 

প্রকাশিত: ১১:২০ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ৯, ২০২১

গণস্বার্থের সাংবাদিকতার জন্যই সংবাদপত্রকে বদলে দিয়েছিলেন যিনি 

||সৈয়দ আমিরুজ্জামান ||

০৯ এপ্রিল ২০২১ : গণস্বার্থে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্যই সংবাদপত্রকে বদলে দিয়েছিলেন এবিএম মূসা।  মুক্তচিন্তার কলামলেখক ও প্রখ্যাত এই সাংবাদিকের ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।

এবিএম মূসা ছিলেন তার সময়ে সাংবাদিকতা পেশার পথিকৃৎ ও এক বৃহৎ খুঁটি। সাংবাদিকতা পেশায় থেকে তিনি বরাবরই মেধা, যুক্তিবোধ, পেশাদারিত্ব, দায়িত্বশীলতা, অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা এবং বুদ্ধির মুক্তিসহ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ লালন-পালনের জন্য নিরবচ্ছিন্ন চর্চা করে গেছেন। তিনি ছিলেন বরাবরই এক আপসহীন ও অকুতোভয় সাংবাদিক, কলম লেখক। পুরো নাম আবুল বাশার মুহাম্মদ মূসা (সংক্ষেপে এবিএম মূসা)।  বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় এক প্রবাদতুল্য পুরুষ তিনি। আমরা যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন থেকেই এই নামটির সঙ্গে পরিচিত।

১৯৩১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার কুতুবপুর গ্রামে এই ক্ষণজন্মা সাংবাদিক জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

২০১৪ সালের ৯ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের সবার প্রিয় মূসা ভাইকে এ দিনে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। এই দেশবরেণ্য সাংবাদিক গেল শতাব্দীর পঞ্চাশ দশক থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশের সংবাদমাধ্যমের ক্রমবিবর্তনের পথে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন। সাংবাদিকতা পেশায় যারা বাংলাদেশে এক আলোর ভুবন তৈরি করে গেছেন, এবিএম মূসা তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব।

এবিএম মূসার বাবা ছিলেন সে সময়ের একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বাবার চাকরির সুবাদে তিনি চট্টগ্রামের গভর্নমেন্ট মোসলেম হাইস্কুলে মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা করেছেন। ১৯৪৫ সালে তার বাবা বদলি হয়ে নোয়াখালী ফিরে এলে তিনি নোয়াখালী জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৪৬ সালে এই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও চৌমুহনী কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।

কলেজ জীবন থেকেই এবিএম মূসা লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারুণ্যের শুরুতেই প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনা তাকে শিহরিত করত। তিনি জীবন সংগ্রামকে দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন ভিন্নমাত্রায়, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। চৌমুহনী কলেজে ছাত্রাবস্থাতে তিনি পাক্ষিক ‘কৈফিয়ত’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। এ ছাড়া ফেনীতে খাজা আহমদের সংগ্রাম পত্রিকায়ও তিনি নিয়মিত লিখতেন। এবিএম মূসা বিএ পরীক্ষা দিয়ে ১৯৫০ সালে ঢাকায় এসে ‘ইনসাফ’ পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। তার পেশাগত সাংবাদিকতার শুরু এখানেই।

সেই পঞ্চাশের দশকেই দৈনিক আজাদ পত্রিকা থেকে কে. জি. মুস্তাফার নেতৃত্বে একদল সাংবাদিক বের হয়ে আসেন। তাদের অনেকে যোগ দেন ইনসাফ পত্রিকায়। এই পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ছিলেন কে. জি. মুস্তাফা। ইনসাফ পত্রিকায় তিন মাস কাজ করার পর এবিএম মূসা ১৯৫০ সালের নভেম্বরে শিক্ষানবিশ সহ-সম্পাদক হিসেবে পাকিস্তান অবজারভারে যোগ দেন।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন ছাপার কারণে পাকিস্তান অবজারভার বন্ধ হয়ে গেলে এবিএম মূসা দৈনিক সংবাদ-এ যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে আবার অবজারভার পত্রিকা পুনঃপ্রকাশিত হলে সেখানে তিনি সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে তিনি এ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। এবিএম মূসা ১৯৬১ সালে কমনওয়েলথ প্রেস ইনস্টিটিউটের বৃত্তি নিয়ে লন্ডনে যান। অক্সফোর্ডে কুইন এলিজাবেথ হাউজে তিনি সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা করেন। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি অবজারভারের সনাতনী চেহারা বদলে দেন। নতুন বিষয় ও নবতর অঙ্গসজ্জা অবজারভারের ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি অবজারভারের বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব নিরবচ্ছিন্নভাবে পালন করেন।

বার্তা সম্পাদক হিসেবে তার সাহস ও দৃঢ়তাই পাকিস্তান অবজারভারকে ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার করে তোলে। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান ও বহির্বিশ্ব বাঙালির মনের কথা জানতে পারত পাকিস্তান অবজারভার পড়ে। এ সময়ে তিনি বাংলাদেশের পত্রিকায় কাজ করার পাশাপাশি বিবিসি, লন্ডনের দ্য টাইমস, দি ইকোনমিস্টসহ বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যমের বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। লন্ডন টাইমসের প্রখ্যাত সাংবাদিক হ্যারল্ড ইভান্সের সঙ্গে তার বিশেষ পরিচয় ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হ্যারল্ড ইভান্সের উদ্যোগে এবিএম মূসা হংকংয়ে চলে যান। তার পরামর্শ অনুযায়ী সেখান থেকে মুজিবনগরে গিয়ে যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করে বিদেশি গণমাধ্যমে পাঠাতেন। হংকংভিত্তিক বার্তা সংস্থা এশিয়ান নিউজ এজেন্সির মাধ্যমে তিনি ভারত থেকে যুদ্ধের খবর বিবিসিকে জানাতেন (কেননা একাত্তরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ভারতে বিবিসির কার্যক্রম বন্ধ ছিল)।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে এবিএম মূসা আর কোনো পত্রিকায় যোগ দেননি। এ সময় তিনি বিবিসি, লন্ডনের দ্য টাইমস, নিউইয়র্ক টাইমস ও দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর একজন স্নেহধন্য ভাবশিষ্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর এবিএম মূসা বাংলাদেশ টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে নিয়োগ পান। এর কিছু দিন পর তিনি অধুনালুপ্ত মর্নিং নিউজ পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর তিনি আবার লন্ডনে চলে যান। সেখানে তিনি সানডে টাইমস পত্রিকার রিসার্চ ফেলোর কাজ করেন। তিনি ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ইউএনইপির আঞ্চলিক তথ্য পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। তিনি পরে দেশে ফিরে প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের মহাপরিচালক এবং তারপর বার্তা সংস্থা বাসসের প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কাজ করেন।

১৯৯১ সালে নিউজ ডে নামে একটি ইংরেজি দৈনিকে সম্পাদক হিসেবে বছর খানেক কাজ করেন। ২০০৪ সালে কিছু দিন তিনি দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি সময় তিনি বর্তমান দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের অনুরোধে ও উৎসাহে কলামিস্ট হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৯৫ সালের ১৮ মার্চ ভোরের কাগজ-এ তার প্রথম কলাম ‘আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বন্ধুবরেষু’ ছাপা হয়। এরপর তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। ইংরেজি সাপ্তাহিক কুরিয়ার-এও তিনি দুই বছর কলাম লিখেছেন।

এবিএম মূসা পাকিস্তানের সাংবাদিকদের ইউনিয়ন আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন। তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম। প্রয়াত এসএম আলী যখন ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে পাকিস্তান জার্নালিস্টস ওয়েজ বোর্ডের সদস্য, এবিএম মূসা তখন ওই ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সে সময়েই প্রথম বেতন বোর্ড রোয়েদাদ কার্যকর হয়।

১৯৬৫ সালে তাসখন্দে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে চুক্তি সম্পাদন করার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশসহ বিভিন্ন কারণে এবিএম মূসা আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুস সালামের বড় জামাতা। তার স্ত্রী সেতারা মূসা, মেয়ে পারভিন সুলতানা ঝুমা প্রত্যেকেই সাংবাদিকতা পেশায় পরিচিত নাম।

মুক্তচিন্তা আর পেশাদারি মূল্যবোধের কারণে আমাদের প্রিয় মূসা ভাই বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে এক প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বিরল প্রজন্মের এক সাংবাদিক, যিনি পরিস্থিতি আত্তীকৃত করে কোনো খবর কিংবা ঘটনাকে অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে পরিবেশন করতে পারতেন। তার ক্ষুরধার সংবাদমনস্কতা, তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস ও ক্ষমতা এবং ব্যতিক্রমী লেখার সাবলীলতা এবং একই সঙ্গে ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষার ওপর দক্ষতা তাকে সাংবাদিকতায় অতুল্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। তার অভাব আমরা আজও ক্ষণে ক্ষণে অনুভব করি। তিনি মারা গেলেও ফুরিয়ে যাননি। কর্মে, সিদ্ধতায় এবং পেশাদারিত্বে তিনি যেমন স্থান করে নিয়েছিলেন, তেমনি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেনও তার সময়ের অনেককে। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ফুরিয়ে যেতে নয়, জীবিত থাকতে মানুষের মাঝে। তাই মৃত্যুর পরও আমরা প্রগতিশীল ও কৃৃতিমান এই সাংবাদিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, তাকে স্মরণে রাখি।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ