চট্টগ্রামের সংগ্রামী ইতিহাস (পর্ব-১)

প্রকাশিত: ৭:৫০ পূর্বাহ্ণ, জুন ১৯, ২০২২

চট্টগ্রামের সংগ্রামী ইতিহাস (পর্ব-১)

টিপু চৌধুরী, ১৯ জুন ২০২২ : চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে নব্য প্রস্তর যুগের ছয়টি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে দুটি অশ্মীভূত কাঠের অস্ত্র প্রাপ্তির সূত্রে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সংগ্রামী সুপ্রাচীনতা সম্পর্কে নৃতাত্ত্বিকগণ বর্তমানে নিঃসন্দেহ (রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৭৪: ৭; আবদুল হক চৌধুরী ১৯৯৪: ৫)। এমনকি চট্টগ্রামকে মহাভারতে বর্ণিত কিরাতরাজ্য এবং গ্রিক ভূগােলবিদদের বর্ণিত কিরাপীয় রাজ্যের অন্তর্গত বলে পণ্ডিতরা বিবেচনা করেছেন। মহাভারতীয় যুগে এ অঞ্চল বলির পুত্র সুহ্মের এবং পরে কর্ণের পুত্র বিকর্ণের শাসনাধীন ছিল বলেও কিংবদন্তি রয়েছে। ড. আহমদ। শরীফ একে ইতিহাসের দূরাগত ধ্বনি’ রূপে বিবেচনা করেছেন (আহমদ শরীফ ২০০১: ১১)। তবে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে কিংবা শাসন লিপিতে চট্টগ্রামের নাম সুস্পষ্টরূপে পাওয়া না গেলেও ঐতিহাসিক যুগের সূচনায় খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের স্ট্রাবাের ভ্রমণবৃত্তান্ত এবং জল বাণিজ্য তত্ত্বের আদি গ্রন্থ রােমান ঐতিহাসিক প্লিনির Periplus of the Erythraean Sea থেকে সমুদ্রবন্দর হিসেবে চট্টগ্রামের পরিচয় জানা যায়।
বিবিধ ইতিহাস সূত্রে গবেষকগণের অভিমত এই যে, খ্রিষ্টপূর্ব দুই শতক হতেই এয়মন ও ব্যাবিলনীয় অঞ্চলের (অমুসলিম) আরবগণ চীন ও ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সহিত ব্যাবসাবাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকারী ছিল। চাটগা এভাবে দুই হাজার বছরের অধিক কাল পর্যন্ত এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্দররূপে পরিগণিত ছিল এবং পশ্চিমে আরব, আবিসিনিয়া, এয়মন, আশিরিয়া, গ্রীস ও রােম এবং পূর্বে চীনের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনা করত (আবদুল হক চৌধুরী ১৯৯৪: ৩০)। সমুদ্র উপকূলের বিখ্যাত বন্দর, পর্তুগিজ ভাষায় ‘Porte grando’ বা ‘বড় বন্দর হিসেবে এবং নৌযান প্রস্তুত, বিশেষ করে বাণিজ্য ও রণতরি নির্মাণ প্রযুক্তির। সহজলভ্যতা ও উৎকর্ষের কারণে চট্টগ্রাম প্রাচীন শক্তিশালী দেশ ও জাতিসমূহের নিকট Gateway of the east (আজাদী ১৯৯৫: ৮৬) এবং কালক্রমে Gateway to Bengal (Qanungo 1988: xi) নামে সুপরিচিত হয়। সুতরাং প্রাচ্যের বা বাংলার প্রবেশদ্বার হিসেবে চট্টগ্রামে কালান্তরে বিভিন্ন জাতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্পর্শ প্রবাহ ছিল অবারিত। একই সঙ্গে বিদেশি যােদ্ধজাতির রক্তের মিশ্রণও ঘটেছে অজস্র।
খ্রিষ্টপূর্ব আর্যীকরণের প্রবল প্রভাব থেকেও চট্টগ্রাম বিমুক্ত থাকে নি। কানুনগাে এ প্রভাবের অপ্রতিরােধ্য বিস্তারকে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এতদঞ্চলে বুদ্ধবাদ ও পালি ভাষা প্রবর্তনের সময়ের সমান্তরাল বলে উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, সমুদ্রমেখলা এবং পাহাড়-পর্বত বেষ্টিত চট্টগ্রামের বন্দর সুবিধা, বাণিজ্য প্রসার, প্রাকৃতিক অঢেল সম্পদ, রণকৌশলগত ভৌগােলিক অবস্থান, এমনকি তৎকালীন নৌ প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ইত্যাদির কারণে প্রাচীন শক্তিশালী সামরিক জাতিসমূহের নিকট এ অঞ্চল সব সময়েই আকর্ষণীয় ছিল। ড. কানুনগাে এ অবস্থার ফলাফল বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে, Chittagong became a meeting ground of conflicting races, religions and nationalities। এ বিষয়ে তিনি আরাে বলেছেন, Besides her strategic position, the abundance of resources, excellent facilities of ports and harbours and similar other factors made the district an invaluable one, for the possession of which the powers both foreign and of the subcontinent shed blood through the ages ফলে এ অঞ্চলের জনজীবন, সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই যে সার্বক্ষণিক সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ করত তা সহজেই অনুমেয়। সে কারণে এই তথ্য অস্বীকার করা যাবে না যে, চট্টগ্রাম সবসময়েই ছিলাে ‘Battleground of the neighbouring ambitious monarch’ । প্লেটোর আদর্শ ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রমাত্রেই আক্রমণােদ্যত রাষ্ট্র পরিবেষ্টিত এবং সেজন্য সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রনীতির তত্ত্বটি এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযােগ্য (প্লেটো ১৯৭৬ ১০২-৩)। এই তথ্য-উপাত্তের সাদামাটা অর্থ এই যে, চট্টগ্রামবাসীকে যাবজ্জীবন কোন না কোনােভাবে যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে কাটাতে এবং যােগ্যতমেরই কেবল অভিষেক- এই ডারউইন তত্ত্বকে প্রণিধান করে নিয়ত সংগ্রামশীল থাকতে হয়েছে।
সাহসিকতা ও সংগ্রামশীলতাঃ
এ এলাকার ভৌগােলিক-প্রাকৃতিক অবস্থা এবং প্রভাব এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার্য। এ কথা সবারই জানা যে পাহাড়-পর্বত, নদী, খাল, সমুদ্র, উপত্যকা, অরণ্য প্রভৃতি নৈসর্গিক বৈশিষ্ট্যের মিশেলে এ অঞ্চল সমতল ভূমি থেকে এক ভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশে সংস্থাপিত। তাই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই যােগ্যতমের প্রতিভূ হিসেবে জীবনের উপাদান আহরণেও আলােচ্য ভূপ্রাকৃতিক এবং জলবায়ুগত কারণে এ অঞ্চলের মানুষকে অবিরত লড়াকু অবস্থায় দিনাতিপাত করতে হয়েছে। উর্মিমুখর উত্তাল সুগভীর সমুদ্র থেকে সে উপাদানের সন্ধান, সংগ্রহ ও সঞ্চয়ে অসমসাহস ও সংগ্রামের পরিচয় প্রদান করতে হয়েছে। চট্টগ্রামের নাবিকরা ইতিহাসে তাদের সাহসিকতা এবং দক্ষতার জন্য সুবিদিত। সুউচ্চ পাহাড় ও শ্বাপদসংকুল পরিবেশে চট্টগ্রামের অরণ্যবাসীকে কঠোর শ্রম, ধৈর্য এবং সাহসিকতার সাথে বাঁচতে হয়েছে। উপকূলের বাসিন্দাদের প্রতিনিয়ত সামুদ্রিক ঝড়-ঝঞা, লােনা পানির জলােচ্ছাস ও অতিবর্ষণ জনিত প্লাবনের মােকাবিলা করে জীবনযাপনের ইতিহাস আবহমানকালের।
অনিবার্যভাবেই চট্টগ্রামবাসীর বিদ্যমান চারিত্র বৈশিষ্ট্যের নেপথ্যে এসব কারণ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। সুতরাং এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে সাহসিকতা ও সংগ্রামশীলতা এই অঞ্চলবাসীর সুপ্রাচীন ঐতিহ্যিক সত্তা। সে পরিচয় কালান্তরের ইতিবৃত্তে বিধৃত। চট্টগ্রাম নামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থেও সংগ্রামী পরিচয় চট্টগ্রাম নামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থও আলােচ্য সাহসিক যুধ্যমান বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাসের পরিচায়ক। অবশ্য সুপ্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পরিব্রাজক, ভূগােলবিদ এবং পণ্ডিতগণের লিখিত বিবরণে, প্রণীত মানচিত্রে, শাসন লিপি এবং মুদ্রায় চট্টগ্রাম বিবিধ নামে অভিহিত হয়েছে; যেমন: জলন্দর, সামন্দর, চৈত্যগ্রাম, চাটিগ্রাম, শ্যাগাঙ, সুদকাওন, কর্ণবুল, চট্টল, ইসলামাবাদ ইত্যাদি। এসব নাম প্রধানত এ এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক গঠন, অভিবাসন প্রক্রিয়া, বিজয়, রাজনৈতিক বা কিংবদন্তিকে কেন্দ্র করেই সৃষ্ট, প্রদত্ত, বর্ণিত ও প্রচলিত এবং অর্থব্যবস্থা নিরূপিত। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নামের নেপথ্যেও সামরিক ইতিহাস নিহিত। আরাকানি শব্দ ‘চইট্টেগং’ বা ‘চইট্রেকুং’ থেকেই চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি বলে এই অন্বেষণের সিদ্ধান্ত (আবদুল হক চৌধুরী ১৯৯৫: ৮৩)।
তিনি দেখিয়েছেন, আরাকানি ভাষায় ‘চইট্টে’ অর্থ সেনানিবাস বা দুর্গ। আর ‘গং’ অর্থ শক্তিশালী, দুর্ভেদ্য, শ্রেষ্ঠ, সর্বোত্তম, প্রধান, শীর্ষস্থানীয় এগুলাের মধ্যে যে-কোনাে একটি। চইট্টে’ আর ‘গং’-এর মিলনে এই ‘চইট্টেগং’ শব্দটি সৃষ্ট এবং এর অর্থ শক্তিশালী, দুর্ভেদ্য ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক সেনানিবাস। তেমনি ‘চইট্টেকুং’ শব্দটিও সমার্থক এবং এ এলাকার ভূতাত্ত্বিক গঠনশৈলীর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। এখানে ‘কুং’ অর্থ পাহাড়চূড়া। চইট্রেকুং’ মানে পাহাড়চূড়ার সেনানিবাস।
এই অঞ্চলের বহমান ইতিহাসের কথা মনে রাখলে চট্টগ্রামের নামের এই নতুন অর্থ-উৎস অধিকতর গ্রহণযােগ্য। শুধু তাই নয়, ইতিহাসের পাতাতেও চট্টগ্রাম কর্ণফুলি নদীতীরে পাহাড় সারি বেষ্টিত এক দুর্ভেদ্য দুর্গের কথা বিধৃত। সেটিই বর্তমানের ‘আন্দরকিল্লা’। ১৬৬৫ সালে মােগল অভিযানে অংশগ্রহণকারী ঐতিহাসিক শিহাবুদ্দিন তালিশ তার ফতিয়াহ-ই-ইব্রিয়া গ্রন্থে আরাকানিদের দুর্ভেদ্য ও শক্তিশালী চাটিগাঁ দুর্গের বিবরণ লিপিবদ্ধ এবং সুরক্ষিত দুর্গ হিসেবে এটাকে মহাবীর আলেকজান্ডারের দুর্গের সাথে তুলনা করেছেন।
আবার এটাও ইতিবৃত্ত যে, মােগলদের তিন বারের আক্রমণ প্রচেষ্টার পরই কেবল চাটগাঁ দুর্গ অধিকৃত হয়েছিল এবং এর নবতর নাম প্রদত্ত হয়েছিল ‘আন্দরকিল্লা’ (পূর্ণচন্দ্র চৌধুরী ১৯২০:১৩)। পর্বত ও সমুদ্র বেষ্টিত এ অঞ্চল একটি প্রাচীন ভূখণ্ড এবং এর সঙ্গে আরাকানের সম্পর্কও সুপ্রাচীন। গবেষকরাও সুনিশ্চিত, প্রকৃতপক্ষে আরাকান ও চট্টগ্রাম একই ভূখণ্ড। একটি সুপ্রতিষ্ঠিত রাজশক্তি হিসেবে পুরাকালেই আরাকান চট্টগ্রামে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং সভ্যতা-সংস্কৃতি-সাহিত্যের ক্রমবিকাশের মাধ্যমে প্রভূত প্রভাব বিস্তার ঘটায় (আহমদ শরীফ ২০০১:২০-২১)।
এখানকার জনজীবনের সঙ্গে আরাকানিদের সুগভীর সংশ্লিষ্টতা এবং সকল পর্যায়ে আরাকানি ভাষা-সংস্কৃতির অনিবার্য প্রভাব অনস্বীকার্য। সে পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের নামের উৎস মূলে আলােচ্য সামরিকত্ব, সংগ্রামশীলতা তথা সাহসী জীবনের ইতিবৃত্ত নিহিত। ইতিহাস এই সাক্ষ্য দেয়, আরাকান আমলে উত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে স্বীয় সামরিক প্রতিরক্ষার প্রয়ােজনে মাটির দুর্গ ‘কোট’ এবং কাঠের দুর্গ ‘কাঠগড়’ নির্মিত হয়েছিল। এসব দুর্গ প্রধানত নির্মিত হতাে শত্রুপক্ষের সম্ভাব্য অভিযান পথের ওপর, বিশেষত নদী বা সমুদ্রতীর সন্নিহিত এলাকায় (আবদুল হক চৌধুরী ১৯৯৫: ১০৬)। মনে রাখা প্রয়ােজন, চট্টগ্রামের ভূ-প্রাকৃতিক গঠনবৈশিষ্ট্যের জন্যে এ অঞ্চল সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে অদ্যাবধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম-আরাকান রাজ্য স্থাপিত আরাকানের প্রাচীন ইতিহাস রাজোয়াং-এর বর্ণনানুযায়ী খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি চন্দ্রসূর্য নামের এক মগধ সামন্ত কর্তৃক চট্টগ্রাম-আরাকান সমন্বিত প্রাচীন ভূভাগে রাজ্য স্থাপিত হয়। আল হাসান।

তথ্যসূত্রঃ সংগ্রামের নোটবুক।।

চলবে…..