নারীর একাল-সেকাল : অগ্রযাত্রা ও পিঞ্জরাবদ্ধ রাখার ভেদবুদ্ধি

প্রকাশিত: ৫:১৬ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৫, ২০২৩

নারীর একাল-সেকাল : অগ্রযাত্রা ও পিঞ্জরাবদ্ধ রাখার ভেদবুদ্ধি

গোলাম কিবরিয়া পিনু |

আমরা জানি, বহু ধরনের সামাজিক অবরোধ, কুসংস্কার আর শিক্ষার অভাবের কারণে যুগ যুগ ধরে বাঙালি নারীর অগ্রসর হওয়া অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে সন্তানের জন্ম ও তার লালনপালন, পতিসেবা ও গৃহকর্মের মধ্যেই জীবন বৃত্তাবদ্ধ করে রাখতে তাঁরা বাধ্য হন।
রাষ্ট্রের আইন, সামাজিক বিধিনিষেধ, ধর্মীয় বিবেচনা ও অর্থনৈতিক কারণে নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হন নারীরা। এ ছাড়া বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, দাসপ্রথা ও সতীত্ব ধারণার কবলে থাকার ফলে তাঁদের শৃঙ্খল আরো বেশি করে জোরালো হয়ে থাকে। ১৮ শতক পর্যন্ত এই একরৈখিক ধারা বেশ বজায় থাকে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সতীদাহ প্রথা, বিধবাবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও নারীদের অধিকার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এর ফলে নারী তাঁর আত্মশক্তি খুঁজে পেতে থাকেন।
নারীশিক্ষার গুরুত্ব ও বিকাশ ১৯ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে দেখা যায়। এই সময় থেকে নারীকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করার বিষয়টি গুরুত্ব পেতে থাকে। সামাজিক অত্যাচার, বিধিনিষেধ, প্রথা, পশ্চাৎপদতা যা নারীকে সীমায়িত করে রাখার শৃঙ্খল হিসেবে বিবেচিত হত, সেইসব শৃ্ঙ্খল থেকে নারীকে মুক্ত করার জন্য সেই সময়ে সমাজে ব্যাপক আলোচনা, উদ্যোগ ও আন্দোলন শুরু হয়। এর ফলে নারীর সামাজিক মর্যাদা ও জীবনের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়।
অন্যদিকে, নারী তাঁর নতুন জীবনবোধ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার সাহস ও শক্তি অর্জন করেন। ২০ শতক নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার যুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই শতকে নারীরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন। আর ২১ শতকে এসে এই বাংলাদেশেও নারীরা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়েছেন।

এ দেশেও নারীদের কিছুটা ক্ষমতায়ন এবং ধীরে ধীরে কিছু পর্যায়ে তাদের দারিদ্র্য মুক্তি হচ্ছে! নারীর মুক্তির জন্য শিক্ষারও বিস্তার ঘটছে। আজ শিক্ষার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ প্রায় সমান। জাতিসংঘের ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা এমজিডি) অর্জনের ফলে বিভিন্ন পরিধিতে নারীর উন্নয়ন ঘটেছে। নারীর মুক্তির ক্ষেত্রে শুধু সরকার নয়, রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, মহিলা সংগঠন ও অন্যান্য বেসরকারী সংগঠনগুলোর ধারাবাহিক অবদান আছে। গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীরা অনেক এগিয়েছে। এখনো নারীর মুক্তি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
১৯ শতকে এসে খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে যে নারীশিক্ষার সূচনা হয়েছিল, তারই অংশ হিসেবে অন্তঃপুরে নারীশিক্ষার গোড়াপত্তন হতে আমরা দেখি। বিভিন্ন পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অনুকূল পরিস্থিতিতে শুধু মিশনারিরা নয়, ব্রাহ্মসমাজ, শিক্ষিত হিন্দু-মুসলমান, বিভিন্ন সমিতি-সংস্থা ও সরকার এই ধারার শিক্ষা-কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে।
১৮৮২ সালে ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার যখন শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হন, তখনকার অবস্থা ১৮৩৫ সালের থেকে ভিন্ন ছিল। ওই সময়ে বাংলায় প্রাথমিক পর্যায়ে ১,০১৫টি বালিকা বিদ্যালয় ছিল, যেগুলোতে ছাত্রীসংখ্যা ছিল ৪১,৩৪৯। স্কুলগুলোর মধ্যে অধিকাংশই ছিল বেসরকারি, তবে এগুলো সরকার থেকে কিছু আর্থিক সাহায্য লাভ করত। ১৮৯৯ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে প্রাথমিক বালিকা স্কুলের সংখ্যা ৩,০৯৪-এ পৌঁছায় এবং ছাত্রীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১,০৭,৪০৩ জনে। এই সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বালক ছিল ২৮.৯০ শতাংশ এবং বালিকা ১.৯০ শতাংশ। অথচ ১৮৮৬-৮৭ সালে এই হার ছিল যথাক্রমে ২৫.২৫ শতাংশ এবং ০.৯১ শতাংশ।

‘বামাবোধিনী’ পত্রিকার ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসের সংখ্যায় শিক্ষা বিভাগের ১৮৭১-৭২ সালের রিপোর্ট আলোচিত হয়। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী কোলকাতায় সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ১১০টি। এছাড়া ১৪টি বালিকা বিদ্যালয় ছিল যেগুলো সরকারি সাহায্য পায় না।
এই উভয় ধরনের স্কুলে ছাত্রীসংখ্যা ছিল ৭৩২, এর মধ্যে মাত্র ৫৮ জন ছিল মুসলিম। এর চেয়েও অধিকতর করুণ চিত্র পাই ১৮৮০ সালে ইডেন বালিকা বিদ্যালয়ে; সেখানে মোট ১৫৩ ছাত্রীর মধ্যে মুসলিম ছাত্রীর সংখ্যা ছিল মাত্র একজন।
আর বর্তমানে সরকারি হিসাব থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রাথমিক পর্যায়ে বর্তমানে ভর্তির হার শতকরা ৯১, যার মধ্যে মেয়েশিশুরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে (যথাক্রমে ৯৪.৭ শতাংশ ও ৮৭.৮ শতাংশ)। গত কয়েক বছরের এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফল থেকেও দেখা যায়, সব শিক্ষা বোর্ডেই মেয়ে শিক্ষার্থীরা ছেলেদের তুলনায় ভালো কিংবা সমান ফলাফল করছে।

২০১২ ও ২০১৩ সালের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় মেয়ে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছেলে পরীক্ষার্থীর চেয়ে লক্ষাধিক বেশি ছিল। জুনিয়র সমাপনী পরীক্ষার ক্ষেত্রেও ২০১৩ সালে ছেলে পরীক্ষার্থীর চেয়ে লক্ষাধিক বেশি মেয়ে পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছে। দারিদ্র্য, পারিবারিক অনীহা, ধর্মীয় কুসংস্কার, ইভটিজিং, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার মতো বাধাসমূহ অতিক্রম করেই মেয়েরা এই সাফল্য অর্জন করেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীর এই অগ্রগতির ধারা কোনোভাবেই সীমাবদ্ধ করার প্রবণতাকে মেনে নেওয়া যায় না।
শিক্ষার উল্লিখিত অবস্থান থেকে আমরা যদি নারীর অর্থনৈতিক অবস্থান সেকাল ও একালের চিত্রের ভিত্তিতে টেনে আনি, তাহলে বিরাট পার্থক্য লক্ষ্য করব। গোলাম মুরশিদ তাঁর ‘সংকোচের বিহ্বলতা’ গ্রন্থে উনিশ শতকে নারীদের অর্থনৈতিক ভূমিকা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন:
‘‘সেকালে বঙ্গমহিলাদের মধ্যে কেবল দাসী, অশিক্ষিত ধাই এবং বারবণিতাদেরই স্বাধীন আয় ছিল। তছাড়া, শ্র্রমজীবীদের মধ্যে মহিলারা গৃহপালিত জন্তুদের খাইয়ে, গরু দুইয়ে, ধান ভেনে এবং মাছ বিক্রি করে তাদের অর্থনৈতিক কার্যে সহায়তা করতেন। ফসল রোপণ করে এবং কেটেও অনেক মহিলা অর্থনৈতিক কার্যে সহায়তা করতেন। সংক্ষেপে, নগদ অর্থ আয় করুন বা নাই করুন, নিম্ন শ্রেণির মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করতেন। এটা করার জন্য তাদের স্বাভাবিকভাবেই পর্দাপ্রথা অমান্য করতে হত। তাছাড়া, ভদ্রলোক পরিবারে মহিলাদের যে মর্যাদা ছিল, নিম্ন শ্রেণির পরিবারে তা ছিল উন্নততর। ভদ্রলোকদের মধ্যে মহিলারা কোনো অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করতেন না, অন্তত অর্থ আয় তো করতেনই না। বস্তুত, তাদের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে মনোভাব প্রচলিত ছিল।’’
১৯ শতকের নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের ফলে তাঁরা ঘরের গণ্ডির বাইরে গিয়ে জীবন-বিকাশের শক্তি অর্জন করতে থাকেন। এর ফলে এ সময়ে নারীরা শিক্ষিত হয়ে পারিবারিক দায়িত্বের বাইরে পেশাগতভাবে বিভিন্ন বৃত্তিতে সম্পর্কিত হতে থাকেন। ধীরে ধীরে নারী কর্মজীবীদের সংখ্যা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বর্তমানে বাংলাদেশের চিত্রে নারীর অর্থনৈতিক অবস্থান খুঁজে পাই, সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) এক গবেষণাপত্রে। ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে:
‘‘অর্থনীতিতে অতিদ্রুত বিশেষ করে চাকরি, ব্যবসায় নারীর সংখ্যা বাড়ছে। মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ১৯৯৫-৯৬ সালে ১৫.৮ শতাংশ, ২০০২-০৩ সালে ২৬.১ শতাংশ, ২০০৫-০৬ সালে ২৯.২ শতাংশ এবং ২০১১-১২ সালে ৩৯.১ শতাংশ।’’
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস পোশাক শিল্প, হিমায়িত চিংড়ি, চামড়া, হস্তশিল্পজাত দ্রব্য, চা শিল্পসহ অন্যান্য পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি নারী জড়িত। এসব শিল্পের প্রধান কাজগুলো করেন নারী।
১৯ শতক হয়ে ২১ শতকের এই সময় এসে মনে পড়ে রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের কথা:
‘‘উড়তে শেখার আগেই পিঞ্জরাবদ্ধ এই নারীদের ডানা কেটে দেওয়া হয় এবং তারপর সামাজিক রীতিনীতির জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয় তাদের।… নারীর দাসত্বের প্রধান কারণ, পুরুষশাসিত সমাজ ধর্মের নাম করে নারীর দাসত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ এবং অলৌকিক মহিমা দিয়েছে।’’

১৯ শতকের পূর্বেও যুগ যুগ ধরে নারীদের জন্য অবরোধপ্রথা (পর্দাপ্রথা) শুধু ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও প্রচলিত ছিল। ১৯ শতকে এসেও অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কারণে নারীরা ছিল পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। নারীদের শিক্ষার বিস্তার ও সুযোগ বিস্তৃত না হওয়ার কারণেও নারীরা গৃহের অভ্যন্তরে জীবন নির্বাহ করত। আর্থিক ক্ষমতা না থাকার কারণে নারীরা ছিলেন আরও পরনির্ভরশীল, বিবাহিত জীবনে স্বামীর ওপর এবং অন্যান্য জীবনে অভিভাবকদের ওপর। অন্যদিকে, ধর্মীয় সংস্কার ও বাধ্যবাধকতার জন্যও নারীরা অবরোধের মধ্যে বাস করতেন।
হিন্দু পরিবারের মেয়েদের চেয়ে মুসলিম পরিবারের মেয়েদের অবরোধ-বিষয়ক বাধ্যবাধকতা বেশি ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। ‘নবনূর’ (অগ্রহায়ণ ১৩১১) পত্রিকায় ‘আমাদের শিক্ষার অন্তরায়’ শিরোরামে এক লেখায় বিবি খায়রুন্নেসা লিখেছেন:
‘‘আমরা মুসলমানকূলে জন্মগ্রহণ করিয়াছি; সুতরাং আমাদিগকে ইসলাম ধর্মের বিধিব্যবস্থা মান্য করিয়া চলিতে হয়। করুণাময় জগৎমাতা আমাদিগকে যে গণ্ডির অর্ন্তভূত করিয়া সৃজন করিয়াছেন, তাহার সীমা অতিক্রম করিবার সাধ্য আমাদের নাই এবং করাও অবৈধ। হিন্দুর মেয়েছেলেদের ন্যায় আমাদের গ্রামান্তরে যাওয়ার অবাধ অধিকার নাই। বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে তো অবরোধপ্রথার মর্যাদা রক্ষা না করিয়া অন্য বাড়িতে যাওয়াই নিষিদ্ধ।’’
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবনের ঘটনা থেকেও সেই সময়ের অবরোধের চিত্র আমরা লক্ষ করি। ‘অবরোধবাসিনী’তে তিনি জানিয়েছেন যে, তাদের বাড়িতে কয়েকজন আত্মীয়া কিছুদিনের জন্য বেড়াতে এলে তাঁকে পর্দা মেনে চলার হুকুম দেওয়া হয়। তিনি তখন কখনও দরজার আড়ালে, কখনও খাটের তলায়, কখনও চিলেকোঠায়– এমনি করে লুকাতে শুরু করেন। এ রকম লুকানোর ফলে তাঁর মা কয়েকবার তাঁকে খাবার দিতে ভুলে যান। ফলে তাঁকে না খেয়ে থাকতে হয়। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর (১৮৮৫)।
রোকেয়া আরেকটি ঘটনার কথা লিখেছেন। রংপুরের এক জমিদার মেয়ে নিজ বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে হাত ধুচ্ছিল, পাশে দাসী আলতার মা জল ঢেলে দিচ্ছিল। এমন সময় উঠোনে একটি লম্বা-চওড়া কাবুলি মেয়ে ঢুকলে আলতার মা চেঁচিয়ে উঠল, ‘বাড়ির ভেতর পুরুষ মানুষ।’ কাবুলি মেয়েটি হেসে জানাল, ভয় নেই, সে পুরুষ নয়। জমিদারকন্যা তবু প্রাণপণে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে ঘরে গিয়ে মাকে বলল, ‘পাজামা-পরা একটা মেয়েমানুষ আসিয়াছে।’ মা ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘সে তোমাকে দেখিয়া ফেলে নাই তো?’ মেয়ে কেঁদে ফেললে, ‘হ্যাঁ দেখিয়াছে।’
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মন্তব্য– “কেহ বাঘ ভাল্লুকের ভয়েও বোধ হয় এমন করিয়া পলায়ন করে না।”
রাসসুন্দরী দেবী (১৮০৯-১৮৯৯) ২৫ বছর বয়সে পড়তে শেখেন, লিখতে শেখেন ৫০ বছর বয়সে। ৫৯ বছর বয়সে লেখেন একমাত্র গ্রন্থ ‘আমার জীবন’। গ্রন্থটি বাঙালি কোনো নারীর লিখিত প্রথম আত্মজীবনী। তিনি ‘আমার জীবন’এ সেই সময়কালের তাঁর নিজস্ব জীবনের অবরোধপ্রথার সকরুণ চিত্র তুলে ধরেছেন:
‘‘যে বউ হইবে, সে হাতখানেক ঘোমটা দিয়া ঘরের মধ্যে কাজ করিবে, আর কারও সঙ্গে কথা কহিবে না, তাহা হইলেই বড় ভালো বউ হইল। সেকালে এখনকার মতো চিকন কাপড় ছিল না, মোটা মোটা কাপড় ছিল। আমি সেই কাপড় পরিয়া বুক পর্যন্ত কাপড় দিয়া সেই সকল কাজ করিতাম। আর যে সকল লোক ছিল, কাহারও সঙ্গেই কথা কহিতাম না। সে কাপড়ের মধ্যে হইতে বাহিরে দৃষ্টি হইত না। যেন কলুর বলদের মতো দুইটি চক্ষু ঢাকা থাকিত। আপনার পায়ের পাতা ব্যতীত অন্য কোনো দিকে দৃষ্টি চলিত না। এই প্রকার সকল বিষয়ে বৌদিগের কর্মের রীতি ছিল। আমি ঐ রীতিমতেই চলিতাম।… আমার নারীকুলে কেন জন্ম হইয়াছিল? আমার জীবনে ধিক্।… আমি যদি পুত্রসন্তান হইতাম, আর মার আসন্নকালের সংবাদ পাইতাম, তবে আমি যেখানে থাকিতাম, পাখির মতো উড়িয়া যাইতাম। কী করিব, আমি পিঞ্জর-বদ্ধ বিহঙ্গী।’’
সেই পুরনো সময়ের অবস্থাটা এখনও আছে, প্রবলভাবে আছে, শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে আছে। এখনও হেফাজতে ইসলামসহ কিছু সংগঠনের লোকেরা নারীর অগ্রযাত্রা রোধ করার জন্য বিভিন্ন মনগড়া কথাবার্তা শুধু বলে না, দীর্ঘদিনের সংগ্রাম ও বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে যে নারীর অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, তা ভেদবুদ্ধি দিয়ে রোধও করে দিতে চায়। এমনকি নারীর সম্মানহানিকর কথাও বলে গোটা নারীজাতির অবদানের অবমূল্যায়ন করতে চায়।
যুক্তির বালাই নেই, ধর্মীয় সততার বালাই নেই, মিথ্যে বেসাতির খেলায় এইসব শক্তি সেই পুরনো সুরে জিগির তুলে মিথ্যে আর অসততার সীমানা ছাড়ায়, সে বিষয়ে নারীদের সবসময় সচেতন থাকতে হবে। এইসব জিগিরে পূর্বে কাজ হয়নি, এই সময়েও যেন না হয়, সেদিকে সবারই সর্তক থাকা জরুরি।

সুফিয়া কামাল এক সাক্ষাৎকারে তাঁর বেড়ে ওঠা সময়কালের সামাজিক অবস্থা যেভাবে বর্ণনা করেন, তা থেকেও আমরা ২০ শতকের নারীর চিত্র খুঁজে পাই:
‘‘তখনকার সময়টাতে শ্রেণিভেদ একটা বড় ব্যাপার ছিল। বড়লোক, ছোটলোক, সম্ভ্রান্ত লোক, চাষী-কৃষক, কামার-কুমার ইত্যাদি সমাজে বিভিন্ন ধরনের বংশ ছিল এবং এইসব বংশে শ্রেণিবিভেদ ছিল। সেই শ্রেণিভেদ অনুসারে বলা যায়, তখন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের ঘরের মেয়েরা পড়ালেখা বেশি জানত না। তারা বড়জোর কুরআন শরিফ পড়া শিখত। আর হয়তো বাবা-মায়ের কাছে দোয়া-দরুদ নামাজ পড়া শিখত। এই ছিল তাদের শিক্ষা। স্কুল-কলেজের বালাই তো ছিলই না। তবে ধর্মীয় শাসনের একটি প্রক্রিয়া ছিল। সেটা ছেলেমেয়ে সকলের ওপরই কার্যকর থাকত।’’
[আহমদ কবির, সুফিয়া কামাল, বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৪, পৃষ্ঠা ২২২]
আমরা কি সেই যুগে ফিরে যাব? পর্দাপ্রথার নামে নারীর অন্ধকার আরও ঘনীভূত করে কঠোর মধ্যযুগীয় পরিবেশের সৃষ্টি করব? সেই বিবেচনাবোধ আজ আমাদের সবার মধ্যে জাগ্রত না হলে সমাজ পিছিয়ে গিয়ে শুধু নারীর অধিকার সঙ্কুচিত করবে না, সমাজের সামগ্রিক মানবিক অবস্থা করে তুলবে বিপদগ্রস্ত!
নারীর সামগ্রিক মুক্তির জন্য সুফিয়া কামালের ভূমিকা ছিল সমসময়ের জন্য উদ্দীপনামূলক ও আগ্রহোদ্দীপক। তাঁর জবানিতে:
‘‘আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগে এই দেখে যে, মেয়েরা আগের তুলনায় এখন অনেক সাহসী হয়েছে। মেয়েরা এখন রাস্তায় বেরিয়ে অন্তত নিজেদের কথা বলতে শিখেছে। আমরা চেয়েছিলাম, মেয়েরা কথা বলতে শিখুক, সাহসী হয়ে উঠুক, নিজেদের অধিকার তারা বুঝতে পারুক। এটা এখন হয়েছে। এটা বড় আনন্দের।’’
[নূরজাহান মুরশিদ, ‘বেগম সুফিয়া কামালের মুখোমুখি’, একাল, ঢাকা, দ্বিতীয় সংখ্যা, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৩৫]
এই মতের সঙ্গে আমরাও একমত।
নারীরা ১৯ শতক থেকে ২১ শতকের এই সময় পর্যন্ত অনেকদূর এগিয়েছে। কিন্তু এই পথচলা রুদ্ধ করে দেওয়ার জন্য বহু রকমের টালবাহানা, উপদ্রব ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়ে নারীকে আবারও ‘অবরোধবাসিনী’ হিসেবে সীমায়িত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিকট অতীত থেকে ভবিষ্যতের পথ ধরে এগিয়ে যেতে চায় নারীরা, কিন্তু কোনো কোনো মহল বহু যুগ আগের অতীতে নিয়ে যেতে চাইছে তাদের। আবার কোনো কোনো গোষ্ঠী শত শত বছর আগে প্রতিস্থাপন করতে চাইছে নারীদের।
তা হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু কালজ্ঞ শক্তির লোকেরা ধর্মের নামে, পোশাকের নামে, একরৈখিক ভেদবুদ্ধি দিয়ে ও যুক্তিহীন অমানবিকতার পটভূমি তৈরি করে আবারও শৃঙ্খলার নামে শৃঙ্খল পরাতে চাইছে নারীদের।

গোলাম কিবরিয়া পিনু : কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ