সত্যাশ্রয়ী মানবী প্রীতিলতা

প্রকাশিত: ৭:১৩ পূর্বাহ্ণ, মে ৮, ২০২২

সত্যাশ্রয়ী মানবী প্রীতিলতা

তাহেরা বেগম জলি |
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন বাজি রাখা এক বিস্ময় কন্যার নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। চট্টগ্রামের জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং প্রতিভা দেবী দম্পতির মেয়ে রানী-প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার নাম নিয়ে ১৯১৮ সালে যখন চট্টগ্রাম ডাঃ খাস্তগীর স্কুলে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু করেন,উত্তাল ভারতবর্ষ তখন বিদ্রোহের দাবানলে জ্বলছে। মারো অথবা মরো নয়, মারো এবং মরো-মহান এই মন্ত্রে উজ্জীবিত ভারতযোদ্ধারা তখন মরণ সাগরে ঝাপিয়ে পড়ার প্রতিযোগিতায় যেন মেতে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই দখলদার ইংরেজ বাহিনীও তখন মরিয়া। এবং তারাও দমন পীড়ন নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। রক্তাক্ত রাজপথ,ফাঁসির রজ্জু এবং উপচে পড়া কারাগার,এই ছিলো তখন ভারতবর্ষের প্রকৃত চিত্র। এ রকমই একটা শ্বাসরুদ্ধকর সময়ে,ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের ময়দানে উজ্জ্বল নক্ষত্র-বীরকন্যা প্রীতিলতার শুভ আবির্ভাব।

১৯২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর,সূর্যসেনের বিপ্লবী গুপ্ত সংগঠন-কথিত সরকারী কোষাগারের ১৭,০০০ হাজার টাকা ছিনতাই করে নেয়। ঘটনার দুই সপ্তাহের মাথায় গ্রেফতার হয়ে যান দলনেতা সূর্যসেন এবং সহযোদ্ধা অম্বিকা চক্রবর্তী। ইংরেজ সরকার কথিত রেলওয়ে ডাকাতির মামলায় স্বাধীনতা সংগ্রামী এই দু’জন বিপ্লবী নেতাকে ডাকাত হিসেবেই দাঁড় করায় আসামীর কাঠগড়ায়। কলকাতা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেন গুপ্ত অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী হিসেবে মাস্টারদা এবং অম্বিকা চক্রবর্তীর পক্ষে দাঁড়ান। মাস্টারদা এবং অম্বিকা চক্রবর্তী তাঁরা দু’জনই সাজানো ডাকাতি মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে যান। সাড়া জাগানো এই মামলা তৎকালীন সময়ে যুবসমাজের মধ্যে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিলো। খেলাধুলা এবং লেখাপড়ায় বিদ্যালয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন ক’রে নেওয়া-ব্যতিক্রমী কিশোরী মেয়ে প্রীতিলতার মনেও মাস্টারদা সম্পর্কে কৌতূহল দেখা দেয়। তিনি বাবার কাছে জানতে চান-“মাষ্টার মশায় ডাকাত কেন বাবা?” “বাবা বলেন,”ওঁরা স্বদেশী ডাকাত। দেশের জন্য ওঁদের অনেক কিছুই করতে হয়।“ কিন্তু ছোট্ট এই উত্তরে প্রীতিলতা সেদিন যেন সন্তষ্ট হতে পারেন নি। তাঁর কিশোরী মন ব’লে ওঠে মাস্টারদা সম্পর্কে এটাই শেষ কথা নয়। নিশ্চয় তাঁকে ঘিরে আছে আরও অনেক গল্প। আরও অনেক কথা। তিনি এবার কথা বলেন তাঁর প্রিয় শিক্ষক ঊষাদির সঙ্গে। বাঁশিতে সুর তুলে চারপাশের সকলকে মোহিত করে তোলা শান্ত মেয়েটার দিকে ঊষাদি খানিকটা বিস্ময় নিয়েই চেয়ে থাকেন। কারণ চাঞ্চল্যকর এই মামলা সম্পর্কে,আগ্রহী হয়ে ওঠা কোন স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। বা কোনো সাধারণ নিরীহ মেয়েরও এটা জানতে চাওয়ার কথা নয়। তাছাড়া বিস্ময়কর ব্যাপার হোলো প্রীতিলতা তখন নেহায়েতই কিশোরী। তবে নতুন এই প্রীতিলতাকে চিনতে ঊষাদির এক মুহূর্ত দেরি হয়না। প্রীতিলতার অন্তরের সেই আগুন যেন স্পর্শ করে ঊষাদিকেও। কারণ তিনি নিজের বুকেও জ্বালিয়ে রেখেছেন ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ের অগ্নি মশাল। তিনি কোন দ্বিধা না করে,সরাসরি প্রীতিলতাকে বলেন “মাস্টারদা যা কিছু করেন,তা দেশের স্বাধীনতার জন্যই করেন। ওঁরা ডাকাত নয়,বিপ্লবী। প্রীতিলতা এই উত্তরের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলেন। আলোচিত এই ঊষাদি এবং দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারই প্রীতিলতার মনে ধূমায়িত হওয়া কুণ্ডুলিতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সংযোগ ঘটিয়েছিলেন। ইতিহাসের শিক্ষক ঊষাদি একদিন তাঁর হাতে তুলে দেন ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈয়ের জীবনীগ্রন্থ। ব্রিটিশের আতংক মহারাণী লক্ষ্মীবাঈয়ের জীবন প্রীতিলতাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। তিনি তাঁর অন্তরচক্ষু দিয়ে অনুভব করেন,ঘোড়ায় চ’ড়ে,তলোয়ার হাতে,রণসাজে সজ্জিত এক ভারতকন্যা ছুটে চলেছেন ইংরেজ নিধনে। তাঁর কানে ধ্বনিত হতে লাগলো মহারানী লক্ষীবাঈয়ের রোমাঞ্চকর অমর ঘোষণা।“মেরে ঝাঁসি নেহি দুঙ্গি।“ মহারানীর ঘোষণার রেশ ধরে তিনিও আপন মনে উচ্চারণ করেলেন,“তবে আমরা কেন ছেড়ে দেবো আমাদের ভারতবর্ষ?” স্কুলে ঊষা দি এবং বাড়িতে পূর্ণেন্দু দস্তিদার এই দু’জনের সান্নিধ্যে ক্রমে প্রীতিলতা বেড়ে উঠতে থাকেন। এবং দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদার এ সময় প্রীতিলতার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ হয়ে ওঠেন।

১৯২৪ সালে ‘বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স’ নামে জরুরী আইনের ক্ষমতায়,সন্দেহ হলেই গণহারে আটক করা হচ্ছিলো যুবক ছেলেদের। এবং তা চলতে থাকে অনেকদিন ধরে। ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদের সমস্ত প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। সরকার কতৃক নিষিদ্ধ বই পূর্ণেন্দু দস্তিদার এ সময় প্রীতিলতার কাছে রাখতেন,প্রীতিলতা ততোদিনে দশম শ্রেণীর ছাত্রী। এবং এ সময় তিনি দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারের প্রকৃত শিষ্য হয়ে উঠেছেন। ইংরেজের অত্যাচার এবং সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে প্রীতিলতার সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করতেন পূর্ণেন্দু দস্তিদার। ব্রিটিশবিরোধী বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক তিনি সযত্নে প্রীতিলতার নিয়মিত পাঠ্য তালিকায় নিয়ে আসেন। প্রীতিলতার সামনে এর মধ্যে এসে যায় ম্যাট্রিক পরীক্ষা। কিন্তু তিনি স্কুল পরীক্ষার গুরুত্ব দিতে গিয়ে,জীবনের পরীক্ষাকে আড়াল হতে দেননি। এ সময় তাঁর জীবনের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো আর এক মহান পরীক্ষা-মুক্ত করতে হবে স্বদেশ। আমাদের বীরকন্যা দুটো পরীক্ষার জন্যই নিজেকে তৈরি করার কাজে নেমে পড়লেন অত্যন্ত বলিষ্ঠতা এবং একাগ্রতার সঙ্গে। তাঁর জীবনের সে ছিলো এক মহান সাধনার সময়। তাঁকে মাষ্টারদার যোগ্য শিষ্য হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতেই হবে। এব্যাপারে কোনো আপোষ নয়। মাস্টারদা তখন চট্টগ্রাম যুবসমাজের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী শিবিরের কেন্দ্র হয়ে উঠেছেন।

১৯২৮ সালে কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগ নিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেন প্রীতিলতা। পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উন্নীত হয়ে তিনি যান তাঁর প্রিয় শিক্ষক ঊষাদিকে প্রণাম করতে। ঊষাদি তখন তাঁকে এই ব’লে আশীর্বাদ করেন,”সংসার প্রতিপালনে মেয়েদের জীবন সার্থক—এই মিথ্যা মোহের বিরুদ্ধে মেয়েদের মাথা উঁচু ক’রে দাঁড়াতে হবে।“ ঊষাদির এই আশীর্বাদের মধ্যে তিনি যেন পেয়ে যান প্রকৃত মানুষ হিসেবে দাঁড়ানোর মহামন্ত্র।

১৯২৯ সালে ঢাকা চলে আসেন প্রীতিলতা। এবং ইডেন কলেজে আই এ পড়ার জন্য ভর্তি হন। এখানে ছাত্রী থাকা অবস্থায় তিনি‘শ্রীসঙ্ঘ’নামে একটি বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। শ্রীসঙ্ঘের মহিলা শাখা-‘দীপালী সঙ্ঘে’র একজন সক্রিয় এবং বলিষ্ঠ কর্মী হয়ে ওঠেন তিনি। নারী সচেতনতা এবং নারী শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি-গোপনে মেয়েদের বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দেওয়া ছিলো এই সংগঠনের প্রধান কাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী ছাত্রী বিপ্লবী লীলা নাগ(লীলা রায়)ছিলেন এই সংগঠনটির প্রধান নেতা। ইডেন কলেজের শিক্ষক নীলিমাদি ছিলেন লীলা নাগের খুবই ঘনিষ্ঠ এবং নির্ভরযোগ্য। এই নীলিমাদির মাধ্যমে লীলা নাগের সঙ্গে প্রথমে পরিচিত এবং পর্যায়ক্রমে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন বীরকন্যা প্রীতিলতা। লীলা নাগের অনুপ্রেরনাতেই তিনি দীপালী সঙ্ঘের একজন সক্রিয় এবং চৌকস সদস্য হয়ে উঠেছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না,অত্যন্ত সচেতন ভাবেই এই বিপদসংকুল পথে অগ্রসর হয়েছিলেন আমাদের সত্যাশ্রয়ী বীরকন্যা। বিপ্লবী লীলা নাগ তখন ব্যস্ত,কীভাবে বাংলার মেয়েদের বিপ্লবের কাজে যুক্ত করা যায়। দেশপ্রেমিক লীলা নাগ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন নারী সমাজের অংশগ্রহন ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী ভিত্তি দেবে। তাঁর উদ্যোগে তখন একদিকে চলছে বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র এবং মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ। অন্যদিকে দীপালী সংঘের মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী নারী যোদ্ধা তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। বিপ্লবী লীলা নাগের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়াকে-প্রীতিলতা দেখেছেন-বিপ্লবের সঙ্গে তাঁর মঙ্গলসুত্রে আবদ্ধ হওয়ার মতো। বিশেষ ক’রে প্রীতিলতাকে লীলা নাগ যখন বলেন, “প্রিয় নয় খাঁটি হওয়ার চেষ্টা করতে হবে আমাদের।“ লীলাদির এই বাক্য প্রীতিলতার কাছে মনে হয়েছিলো এক মহৎ বাণী,যে বাণী তাঁর চলার পথে আলোর দিশারীর মতো কাজ করেছিলো। এবং তিনি তখন এতোটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন,এই স্থির বিশ্বাস তাঁর মনে স্থায়ী আসন ক’রে নিয়েছিলো যে,তিনি প্রকৃতই পারবেন মাস্টারদার যোগ্য শিষ্য হিসেবে গড়ে উঠতে।

দীপালী সংঘে যোগ দিয়ে লাঠি খেলা এবং ছোরা খেলায় বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি। প্রীতিলতার জীবনে এ সময়ই মুলত শুরু হয় তাঁর বহু কাঙ্ক্ষিত এবং রোমাঞ্চকর অধ্যায়। তিনি এ সময় লিখেছিলেন “আই এ পড়ার জন্য ঢাকায় দু’বছর থাকার সময় আমি নিজেকে মহান মাষ্টারদার একজন উপযুক্ত কমরেড হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছি।“ ইতিহাস সাক্ষী দেয়, তাঁর এই কথা তিনি জীবনের শেষ নিশ্বাস দিয়ে প্রমাণ ক’রে গেছেন।

১৯২৯ সালে যে সময় প্রীতিলতা ইডেন কলেজের ছাত্রী,সে সময় চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের উদ্যোগে,চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেস সম্মেলন এবং জেলা ছাত্র ও যুব সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ এ আয়োজন অনুষ্ঠিত হয় মাস্টারদা সূর্যসেনের উদ্যোগেই। বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদারের আগ্রহ এবং চেষ্টায় এ সময় জেলা মহিলা কংগ্রেসের সম্মেলনের আয়োজনও করা হয়। কংগ্রেস নেত্রী লতিকা বোসের সভাপতিত্বে এ সম্মেলনে ঢাকা থেকে প্রীতিলতা এবং কলকাতা থেকে কল্পনা দত্ত যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের দু’জনের একান্ত ইচ্ছা ছিলো সেবারই মাস্টারদার অধীনে চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়া। কিন্তু তাঁরা মাস্টারদার সঙ্গে একান্তে কথা বলার সুযোগ না পেয়ে অনেকটা মনোকষ্ট নিয়ে যে যার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফেরত যান। এখানে উল্লেখের দাবী রাখে,যুগান্তর দলের সিদ্ধান্ত ছিলো কংগ্রেসের সব রকম আন্দোলনে সহযোগিতা করা। এবং চট্টগ্রাম যুগান্তর দল পরিচালনা হোতো মাস্টারদার নেতৃত্বেই। চট্টগ্রাম কংগ্রেসের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন পরই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মাস্টারদা কংগ্রেসের সঙ্গে সব রকম সম্পর্কের ইতি টানেন। এবং সক্রিয় ক’রে তোলেন তাঁর সশস্ত্র গুপ্ত সমিতি। এই গুপ্ত সমিতির সদস্যবৃন্দই নিজেরা বসে,ভবিষ্যৎ সংগ্রাম পরিচালনার জন্য গঠন করেছিলেন ইণ্ডিয়ান রিপাব্লিকান আর্মি,চট্টগ্রাম ব্রাঞ্চ।

১৯৩০ সালের ১৯ শে এপ্রিল আই এ পরীক্ষা দিয়ে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। তিনি ঢাকা থেকে ফিরে আসার আগের রাত্রে চট্টগ্রামে ঘটে যায় এক যুগান্তকারী ঘটনা। সূর্যসেনের নেতৃত্বে ‘ইণ্ডিয়ান রিপাব্লিকান আর্মি’ দখল ক’রে নেয় পুরো চট্টগ্রাম। সাময়িক হলেও তা ‘স্বাধীন চট্টগ্রামে’ রূপ নেয়। এবং গোটা ভারতবর্ষে এ ধরণের ঘটনা এই প্রথম। বিপ্লবীদের এই উত্থানে নতুন ক’রে প্রাণ পায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম। কেঁপে ওঠে ভারতীয় ব্রিটিশ সিংহাসন। চট্টগ্রাম দখলের এই সফলতা পরিচিত হয়ে ওঠে‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’নামে। বলার অপেক্ষা রাখেনা,প্রীতিলতার মনেও এই বিদ্রোহ গভীর রেখাপাত করেছিলো। তিনি এ ব্যাপারে লিখেছিলেন,“পরীক্ষার পর ঐ বছরেরই ১৯ শে এপ্রিল সকালে বাড়ি ফিরে আমি আগের রাতে চট্টগ্রামের বীর যোদ্ধাদের মহান কার্যকলাপের সংবাদ পাই। ঐ সব বীরদের জন্য আমার হৃদয় গভীর শ্রদ্ধায় আপ্লুত হল। কিন্তু ঐ বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে অংশ গ্রহন করতে না পেরে এবং নাম শোনার পর থেকেই যে মাষ্টারদাকে গভীর শ্রদ্ধা করেছি তাঁকে একটু দেখতে না পেয়ে আমি বেদনাহত হলাম।” চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে’র পর তিনি আরও তৎপর হয়ে ওঠেন মাষ্টারদার সঙ্গে কীভাবে দেখা করা যায়। ইতিমধ্যে তাঁর আই এ পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এবং মেধা তালিকায় সকলের মধ্যে অধিকার ক’রে নেন ৫ম স্থান। আই এ পরীক্ষার এই ফলের জন্য মাসিক ২০ টাকা বৃত্তি লাভ করেন তিনি। কিন্তু তৎকালীন সময়ের প্রথা অনুযায়ী প্রীতিলতার উপর এক ধরণের চাপ আসে বিবাহিত জীবন মেনে নেওয়ার জন্য। কিন্তু সংগ্রামী এই নারী তাঁর পরিবারকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন,তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চান। অতঃপর তাঁর শিক্ষাযাত্রার এবারের গন্তব্য হয় কলকাতা বেথুন কলেজ। পারিবারিকি ঝঞ্ঝা এবং শিক্ষা জীবনের সুদুর প্রসারী লক্ষ্য নিয়েও প্রীতিলতার মন পড়ে থাকে ‘ইণ্ডিয়ান রিপাব্লিকান আর্মি’র কমান্ডার ইন চিপ মাষ্টারদা সূর্য সেনের কাছে। এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি যোগ দেওয়াই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য। বেথুন কলেজে পড়বার সময় তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন বিপ্লবের কর্মকাণ্ডে। কল্যাণী দাসের নেতৃত্বাধীন ছাত্রীসঙ্ঘের কলকাতা কেন্দ্রিক একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন তিনি । ছাত্রীসংঘের সদস্যদের যোগাযোগ ছিলো বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের সঙ্গে। বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের পিসির (গুনু পিসি বলে তিনি বিপ্লবীদের কাছে পরিচিত ছিলেন ) কলকাতার বাসা ছিলো বিপ্লবীদের নিরাপদ ঘাটি। ছাত্রীসঙ্ঘের সদস্যরা এই গুনু পিসির বাসায় বসেই নিজেদের আলোচনার কাজ সেরে নিতেন। পরস্পরের সঙ্গে এখানেই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন মনোরঞ্জন রায় ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ছাত্রীসঙ্ঘের সদস্যরা মাস্টারদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা ক’রে চলতো। একাজে বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায় ছাত্রীশঙ্ঘকে বিশেষভাবে সহযোগীতা করতেন। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের পর মাষ্টারদার পাঠানো ইশ্‌তেহার বিলি করবার বিশেষ দায়িত্ব পালন করেছিলেন ছাত্রীসংঘের সদস্যরা। এই ইস্তেহার বিলির কাজে প্রীতিলতা নিজে সরাসরি অংশগ্রহন করেছিলেন। দর্শন শাস্ত্রে অনার্স নিয়ে প্রীতিলতা ভর্তি হয়েছিলেন বেথুন কলেজে। কিন্তু লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার প্রয়োজনে অনার্স নিয়ে পড়াটা সময়ের অপচয় মনে ক’রে,শেষ পর্যন্ত তিনি পাসকোর্সে বি এ পরীক্ষা দেন।

বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে এ সময় বন্দী ছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসকে দেখতে আসা তাঁর পরিবারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছিলো। মনোরঞ্জন রায় তখন বন্দি হয়ে আছেন হিজলি জেলে। রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের পরিবারের সমস্যার কথা মাস্টারদা সূর্যসেন বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের কাছে পৌঁছে দেন। মনোরঞ্জন রায়ের মা হিজলি জেলে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গেলে,মায়ের মাধ্যমে তিনি প্রীতিলতার কাছে গোপনে একটা চিঠি পাঠান,সেই চিঠিতে বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায় প্রীতিলতাকে অনুরোধ করেন রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করতে এবং নিয়মিত খোঁজ খবর রাখতে। প্রীতিলতা এই সংবাদ পেয়ে,সময় নষ্ট না ক’রে ‘অমিতা দাস’ছদ্ম নামে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে দেখা করেন রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে। এটা ছিলো তার জীবনের এক নতুন অভিজ্ঞতা। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত নির্ভীক রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি অনুভব করেন,‘আমি স্বাধীনতা সংগ্রামী’ শুধু এই কথার কোন মানে নেই। মরণকে জয় করতে পারার মহত্ত্বই সংগ্রামের মূল কথা। রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের অবিচল চরিত্র প্রীতিলতাকে ক’রে তোলে আত্মপ্রত্যয়ী এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। প্রীতিলতা তখন নিজের ভিতর আবিষ্কার করেন,রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের বিকল্প তাঁর সামনে আর কিছু নাই। মৃত্যু পথযাত্রী এক বীরের মরণ জয় করা মোহনীয় শক্তি সত্যানুসন্ধানী বীরকন্যাকে ক’রে তোলে আরও দুঃসাহসী। রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে প্রীতিলতা লিখেছেন,“তাঁর(রামকৃষ্ণ বিশ্বাস)গাম্ভীর্যপূর্ণ চাউনি,খোলামেলা কথাবার্তা,নিঃশঙ্ক চিত্তে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা,ঈশ্বরের প্রতি অচলা ভক্তি,শিশুসুলভ সারল্য,দরদী মন এবং প্রগাড় উপলব্ধিবোধ আমার উপর গভীর রেখাপাত করলো। আগের তুলনায় আমি দশগুন বেশি কর্মতৎপর হয়ে উঠলাম। আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত এই স্বদেশপ্রেমী যুবকের সঙ্গে যোগাযোগ আমার জীবনের পরিপূর্ণতাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিলো।” ১৯৩১ সালের ৪ আগস্ট রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসি কার্যকর হয়ে যায়। বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসকে যখন ফাঁসিতে ঝোলানো হয় তখন তিনি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেকটা বেহুঁশের মধ্যে ছিলেন। মর্মান্তিক এই ঘটনায় ইংরেজের প্রতি বিক্ষুব্ধ প্রীতিলতার মনে জন্ম নেয় তীব্র ঘৃণা। বিক্ষোভ এবং ঘৃণার আগুনে পুড়ে জন্ম হয় আত্মপ্রত্যয়ী,যুদ্ধে প্রস্তুত অবিচল এক বীরকন্যা প্রীতিলতার। তাঁর কথায়, “রামকৃষ্ণদার ফাঁসির পর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত হবার আকাংখা আমার অনেক বেড়ে গেলো।“ অতঃপর এই সিদ্ধান্তে তিনি উপনীত হন,জীবন বলিদানের বিনিময়ে হলেও চাই ভারতের স্বাধীনতা। নির্ভীক হয়ে ওঠা দুঃসাহসী বীরকন্যা এ সময়ে কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে বোমা তৈরির জন্য বিস্ফোরক দ্রব্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেছেন।

১৯৩২ সালে ডিসটিংশান নিয়ে বি এ পাশ করেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ততোদিনে তিনি কলকাতা থেকে ফিরে এসেছেন তাঁর প্রিয় চট্টগ্রামে। পিতা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার চাকরি হারিয়ে তখন অত্যন্ত দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিন পার করছিলেন। প্রীতিলতা সংসারের প্রয়োজনে সেই মুহূর্তে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এবং প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন চট্টগ্রাম নন্দন কানন হাই স্কুলে,বর্তমানে যেটা অপর্ণাচরণ হাই স্কুল। কিন্তু এর মধ্যেই তিনি নীরবে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিলেন কীভাবে ভারত মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত হওয়া যায়। কারণ এখন এটাই তাঁর ব্রত। ছাত্র পড়ানোর পাশাপাশি তিনি চেষ্টা করতে থাকেন কীভাবে মাস্টারদার সঙ্গে দেখা করা যায়। দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদার এ সময় ছিলেন কারারুদ্ধ। শেষে কল্পনা দত্তের মাধ্যমে প্রীতিলতা দেখা করেন বিপ্লবী নির্মল সেনের সঙ্গে। অনেক আলোচনার পর,নির্মল সেন তাঁর কাছে জানতে চান “পরিবারের প্রতি তাঁর কেমন টান আছে।” প্রীতিলতা বলেন,“টান আছে,কিন্তু “Duty to family-কে Duty to country-র কাছে বলি দিতে পারব।” ইতিহাস জানে,আমাদের মহান বীরকন্যা তাঁর এই উচ্চারণ পালন করেছিলেন অক্ষরে অক্ষরে। অতঃপর প্রীতিলতার জীবনে আসে তাঁর কাঙ্ক্ষিত শুভ মুহূর্ত। বিপ্লবী নির্মল সেন তাঁকে মাস্টারদার সঙ্গে দেখা করবার ব্যবস্থা করে দেন। তবে শুরুতে নির্মল সেন বলেননি আজ কালই দেখা হবে মাস্টারদার সঙ্গে। যুব বিদ্রোহের রেশ ধ’রে চট্টগ্রামে তখন বিরাজ করছিলো একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ। তখন চলছে গণহারে ধরপাকড় এবং বিপ্লবীরা পালিয়ে যেতে চাইলে ছিলো গুলির নির্দেশ। এ রকম জীবন মৃত্যুর টানাপোড়েনের সময় অতি সতর্কতার মধ্যে মিলন হয়েছিলো মহান দুই যোদ্ধার। প্রীতিলতার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়া সম্পর্কে মাস্টারদা লিখেছেন, “প্রথম দর্শনে সে আমার মনের মধ্যে কি Imoression create করল ঠিক ভাষা দিয়ে বুঝাতে পারব না। দেখেই তাকে বেশ Smart,cheerful,Inteligent এবং Cultured বলে মনে হ’ল। তার চোখে মুখে একটা আনন্দের আভাস দেখলাম।” বিপ্লবী নির্মল সেনের তদারকিতে সেদিন রাত থেকেই প্রীতিলতাকে পরিচয় করানো হয় আগ্নেয় অস্ত্রের সঙ্গে। প্রীতিলতা এ যাত্রায় দুইদিন আত্মগোপন জীবনের ধারণা এবং আগ্নেয় অস্ত্রের প্রশিক্ষন নিয়ে ফিরে আসেন বাড়ি। অবশ্য বাড়িতে তিনি বলে গিয়েছিলেন এক সহপাঠীর কাছে যাচ্ছেন। ফিরতে দু’দিন দেরি হ’তে পারে। ফিরবার সময় মাস্টারদা তাঁকে কথা দেন,সময় হ’লে প্রয়োজন মতো অবশ্যই তাকে ডেকে নেওয়া হবে। প্রীতিলতার এবার অপেক্ষার পালা। কেবলি দিন গুনে চলেছেন,কবে আসবে তাঁর জীবনের সেই শুভ মুহূর্ত।

১৯৩২ সালের ১২ই জুন মাষ্টারদা তাঁকে আবার ডেকে নেন। তাঁদের দু’জনের এবার দেখা হয় পটিয়া থানার ধলঘাটে-সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে। দ্বিতীয়বার তিনি এসে দাঁড়ালেন তাঁর মহান পথ প্রদর্শকের সামনে। প্রীতিলতা সেদিন লক্ষ্য করেছিলেন-চারিদিকের সতর্কতার মাত্রা আগের থেকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ সে সময় মাস্টারদাকে গ্রেফতার করবার জন্য ইংরেজ বাহিনী হয়ে উঠেছিলো বেপরোয়া। সামান্য দূরে দুরেই তারা ছাউনি ফেলেছিলো। ধলঘাটের সাবিত্রী দেবীর বাড়ি থেকে ১০ মিনিটের পথেই ছিলো ইংরেজের একটা ছাউনি। আমি আগেই উল্লেখ করেছি,ইংরেজের এ সব তৎপরতার লক্ষই ছিলো মুলত মাস্টারদাকে গ্রেফতার করা। এবং শেষ পর্যন্ত সাবিত্রী দেবীর বাড়ি এবার ইংরেজ কোপানলে পড়লোই। ১৩ই জুন সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন ক্যামেরুনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ বাহিনী-ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। প্রীতিলতা একদিন আগেই প্রবেশ করেছে বিপ্লবীদের এই আস্তানায়। আকস্মিক হলেও সেদিনই প্রীতিলতার হয়ে যায় সশস্ত্র যুদ্ধের হাতে খড়ি। সেই সন্ধ্যায় ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে মাস্টারদার বাহিনীর একটা দুঃসাহসিক খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই খণ্ড যুদ্ধে ইংরেজ পুলিশ কর্মকর্তা মিঃ ক্যামেরুন,বিপ্লবী নির্মল সেন এবং বিপ্লবী অপূর্ব সেনের মৃত্যু সামনে থেকে দেখবার দুর্ভাগ্য এবং সৌভাগ্য দুটোই সেদিন প্রীতিলতার হয়েছিলো। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর বিপ্লবী নির্মল সেনের রাণী বলে ডাক তার কানে ভেসে আসে। যে ডাক প্রীতিলতাকে দগ্ধ করেছে আমৃত্যু। রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসি এবং বিপ্লবী নির্মল সেনের খণ্ড যুদ্ধে মৃত্যু প্রীতিলতাকে পার্থিব জীবনের সকল বন্ধন থেকে ছিন্ন ক’রে দেয়। মাষ্টারদার সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং খণ্ড যুদ্ধ শেষে,রক্তাক্ত-ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ পথ পেরিয়ে তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন ঠিকই,কিন্তু মানসিকভাবে ছিন্ন হয়ে যায় বাড়ির সঙ্গে তাঁর সকল বন্ধন। তাঁর চোখের সামনে কেবলি ভাসতে থাকে বিপ্লবী নির্মল সেন এবং অপূর্ব সেনের আত্মাহুতি দেওয়ার বীরত্বপূর্ণ দৃশ্য। তাঁর কানে কেবলই ভেসে আসতে থাকে গুলিবিদ্ধ নির্মল সেনের রাণী ডাক। ধলঘাটের যুদ্ধ প্রীতিলতাকে ইংরেজ বিরোধী সশস্ত্র শিবিরে সরসরি প্রবেশ করবার সোপান হিসেবে কাজ করেছিলো।

এদিকে ধলঘাট যুদ্ধের সূত্র ধরে ব্রিটিশ পুলিশ বিপ্লবী হিসেবে প্রীতিলতাকে সনাক্ত ক’রে ফেলে। ধলঘাটের সাবিত্রী দেবীর বাড়ি থেকে প্রীতিলতার একটা ছবি পুলিশের হস্তগত হয়। ১৯৩২-১৯ শে জুন থেকে ৩০ শে জুন পর্যন্ত ক্রমাগত পুলিশি তল্লাসির মুখে পড়েন প্রীতিলতা এবং তাঁর পরিবার। ফিরিঙ্গী বিনাশী কাজে তাঁর যুক্ত থাকবার অনেক তথ্য চলে যায় ব্রিটিশ পুলিশের কাছে। তখন বাকি আছে কেবল গ্রেফতার হওয়া। অবশেষে মাষ্টারদার নির্দেশে-বাড়ির সকলের অজ্ঞাতে ৫ই জুলাই বিপ্লবী মনিলাল দত্ত এবং বিপ্লবী বীরেশ্বর রায়ের সঙ্গে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন তাঁর স্বপ্ন লালিত আরাধ্য জীবনে।

প্রীতিলতার আত্মগোপনের খবর ১৯৩২-১৩ই জুলাই আনন্দ বাজার পত্রিকায় ফলাও ক’রে প্রকাশ করা হয় ব্রিটিশ পুলিশের পক্ষ থেকে। প্রীতিলতার সরাসরি ব্রিটিশ বিরোধী অবস্থানের কারণে তাঁর পরিবার পড়ে যায় ভয়াবহ বিপর্যয়ের সামনে। কিন্তু ধীর স্থির স্বভাবের প্রতিভা দেবী অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে পরিবারের সে বিপর্যয়ে হাল ধরেন। প্রীতিলতা এবার নিজেকে পুরোই সমর্পণ করেন স্বাধীনতা সংগ্রামের বেদিমুলে। তিনি একদিন যে পন করেছিলেন,ছেলেরা পারলে মেয়েরা নয় কেন? যুদ্ধংদেহী বীরকন্যা আজ সেই প্রশ্নের জবাব দিতে এসে দাঁড়িয়েছেন সশস্ত্র লড়াইয়ের উন্মুক্ত ময়দানে। ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী শিবিরের প্রথম সশস্ত্র নারী,মাতৃভূমি মুক্ত করতে সশস্ত্র যোদ্ধার তিলক পরে,নিজেকে সমর্পণ করলেন জীবনদানের বেদিমুলে। ঘাত প্রতিঘাতের নানান পথ পেরিয়ে,‘ইণ্ডিয়ান রিপাব্লিকান আর্মির’একজন গর্বিত সদস্য হিসাবে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবার শুরু করেন তাঁর নতুন পথ চলা। এবার তাঁর সাধনা হয়ে দাঁড়ায়,বিশ্বের দরবারে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে,পুরুষের পাশাপাশি এদেশের নারিসমাজও পারে দেশের জন্য রক্ত দিতে। এবং অচিরেই তাঁর হাতের মুঠোয় ধরা দেয় সেই মহেন্দ্রক্ষণ।‘ইণ্ডিয়ান রিপাব্লিকান আর্মি’র বিপ্লবীরা দু’বার ‘পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাব’আক্রমণ ক’রে ব্যর্থ হয়। দলনেতা সূর্যসেন তৃতীয়বার আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে,এবার নেতৃত্ব নির্বাচন করেন নারীদের মধ্য থেকে। স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় নারী সমাজের স্বক্ষমতা প্রমাণ করা ছিলো মাষ্টারদার এবারের উদ্যেশ্য। কথা ছিলো এবারের নেতৃত্ব দেবেন কল্পনা দত্ত। কিন্তু আক্রমনের সাত দিন আগে কল্পনা দত্ত গ্রেফতার হয়ে যান। এবং‘পাহাড়তলি ইউরপিয়ান ক্লাব’আক্রমণের পরবর্তী নেতৃত্ব হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করা হয় প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের উপর। একজন নারীর উপর এই কঠিন দায়িত্ব অর্পণ প্রসঙ্গে মাস্টারদা বলেন, “বাংলার বীর যুবকের আজ অভাব নাই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ,কালারপোল পর্যন্ত এদের দৃপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে বীর যুবকের রক্তে সিক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে,ইতিহাসে সে অধ্যায় আজও অলিখিত রয়ে গেছে। মেয়েদের আত্মদানে সে অধ্যায় রচিত হোক এইই আমি চাই। ইংরেজ জানুক,বিশ্বজগৎ জানুক এদেশের মেয়েরাও মুক্তি যুদ্ধে পেছনে নেই।“ ইউরপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব পেয়ে প্রীতিলতার হাতের মুঠোই যেন পৃথিবী ধরা দেয়। তাঁর জন্য ছিলো সে এক মহাগৌরবের দিন। মাস্টারদা নিজের হাতে সামরিক বেশে সাজিয়ে দিয়েছিলেন সেদিনের ক্যাপ্টেন প্রীতিলতাকে। জীবন বাজী রাখার মহান গৌরবের তিলক পরে মাস্টারদার যোগ্য শিষ্য বীরকন্যা প্রীতিলতা-১৫ জনের একটি চৌকশ দল নিয়ে রওনা দেন ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের উদ্যেশ্যে।

১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর-শনিবার রাত ১১ টায় তাঁরা হামলা চালায় ‘পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাবে’। এবং সে আক্রমণ স্বার্থকতায় পূর্ণ হয়ে ওঠে কানায় কানায়। সেখানে হতাহত হয়েছিলো ৫৩ জন ইংরেজ। আজ এ ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা-প্রীতিলতা নামের মহান যোদ্ধা সেদিন আর ফিরে আসেননি। সগৌরবে আত্মাহুতি দিয়ে সেদিন তিনি প্রমাণ করেছিলেন,মরণেই আছে জীবন জয়ের অধিকার। বীরত্বপূর্ণ সেই যুদ্ধে বীরকন্যা প্রীতিলতার নেতৃত্ব-লিখিত হয়ে যায় স্বর্ণাক্ষরে। পুরুষবেশে যুদ্ধে গিয়েছিলেন আমাদের সত্যাশ্রয়ী মানবী বীরকন্যা প্রীতিলতা। সকাল হতেই সূর্যের তীব্র আলোয় ঝলমল ক’রে সেদিন বেরিয়ে এসেছিলো প্রীতিলতার প্রকৃত চেহারা। বেণিয়া ইংরেজ পরদিন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো পুরুষবেশি নারী প্রীতিলতাকে আবিষ্কার ক’রে। অন্যদিকে নতুন প্রেরণার শক্তি নিয়ে সেদিন জয়োল্লাস করেছিলো গোটা ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষের কানে সেদিন ভেসে এসেছিলো নতুন এক বাণী-আজ আমাদের পথ রোধ করে এমন শক্তি গোঁটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরও নেই। ব্রিটিশের কফিনে আমরা ঠুকে দিয়েছি শেষ পেরেক। সে নারী পুরুষের যৌথ শক্তি। নারী পুরুষের এই যৌথ শক্তি আজ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণের সামনে অপ্রতিরোধ্য শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা,যুদ্ধের ময়দানে নারী পুরুষের এই ঐতিহাসিক মেল বন্ধনের রাখি বন্ধন ক’রে গেলো মহান এক বীর কন্যা-প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরের নতুন এক সকালে ভারতবাসী শ্রদ্ধাবনত চিত্তে মাথা নত করেছিলো মহান যোদ্ধা বীর কন্যা প্রীতিলতাকে স্মরণ ক’রে ।

# ছবিতে লেখা আছে বাংলায় প্রথম নারী শহীদ। ওটা ভুল। প্রীতিলতা ব্রিটিশ ভারতের প্রথম নারী শহীদ।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ