সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গীকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

প্রকাশিত: ৩:০২ অপরাহ্ণ, জুন ২৩, ২০২৫

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গীকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

আনু মুহাম্মদ |

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বয়স বাড়িয়ে দিল, আমাদের মন-মনোযোগে রাষ্ট্র-রাজনীতি-সমাজ এলো প্রবলভাবে। মুক্তিযুদ্ধের পর পর, আমি তখন স্কুলের ছাত্র, কিন্তু খুঁজছি নতুন নতুন সব প্রশ্নের জবাব। ১৯৭১ আমাদের মধ্যে স্বপ্ন তৈরি করেছে, দায়িত্ববোধ এনেছে, এই দেশকে কিভাবে মানুষের দেশে পরিণত করা যাবে? মুক্তিযুদ্ধের কারণে তখন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বিপ্লবী লড়াইয়ের খবর আমাদের কাছে আগ্রহ-উদ্দীপনা তৈরি করেছে—ভিয়েতনাম যুদ্ধ, কিউবার মোকাবেলা, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশে মুক্তির লড়াই। সে সময়ে সমাজের বিপ্লবী রূপান্তর প্রশ্ন নিয়ে, সমাজ-রাষ্ট্র নিয়ে যাঁরা ভিন্নভাবে কথা বলতেন, কাজ করতেন, যাঁদের বক্তৃতা ও লেখনীর প্রতি আমাদের আগ্রহ তৈরি হলো, তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আহমদ শরীফ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করে যিনি বিপ্লবী রাজনীতির তাত্ত্বিক হিসেবে তখন পরিচিত, বদরুদ্দীন উমর।

সেই সময় বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার পথ ও পদ্ধতি নিয়ে যেসব প্রশ্ন মনের মধ্যে তৈরি হচ্ছিল, তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতাম নানাভাবে, তাঁদের লেখা ও বক্তৃতা থেকে যেন কিছু পথ খুঁজে পেতাম। এভাবেই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা ও বক্তৃতার সঙ্গে আমার পরিচয়। তাঁর বক্তৃতা সব সময় খুবই আকর্ষণীয়। কৈশোর কিংবা কলেজে অধ্যয়নকালে অনেক কঠিন বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর লেখা ও বক্তৃতা খুবই সহায়ক হয়েছিল।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ‘উপর কাঠামোর ভেতরই’ নামে সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে নিয়মিত কলাম লিখতেন। তিনি আরেকটি কলাম লিখতেন ‘গাছপাথর’ নামে দৈনিক সংবাদে। তাঁর বই পড়ার আগে তাঁর কলামের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সত্তরের দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশ লেখক শিবির সূত্রে তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি যোগাযোগ হয়।

লেখক শিবির তখন নতুনভাবে সংগঠিত হচ্ছিল। এতে তাঁরা সবাই ছিলেন। সেই সময় থেকে আমাদের একসঙ্গে কাজ করা শুরু।
শিক্ষক হিসেবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বরাবরই খুবই জনপ্রিয়। অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে তিনি নতুন চিন্তা, আগ্রহ নিয়ে এসেছেন।

ক্লাসের বাইরেও তাঁর লেখা ও বক্তৃতার মধ্য দিয়ে অসংখ্য মানুষ এমন সব বিষয়ে আগ্রহী হয়েছে, যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে কঠিন, জটিল ও প্রথাবিরুদ্ধ; সেগুলোকে তিনি সহজ ও আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরেছেন। আমরা জানি, জ্ঞান-বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎও একটি বড় লড়াইয়ের জায়গা। সেখানকার লড়াই চোখে দেখা যায় না, বাইরে থেকে বোঝা যায় না। মানুষ-অমানুষে শারীরিক সংঘাত কিংবা মাঠে-ময়দানে লড়াই তার থেকে ভিন্ন কিন্তু আবার পরস্পর সম্পর্কিত। জ্ঞান-বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের লড়াই চোখে দেখা না গেলেও এর একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকে। এই লড়াই জোরদার না হলে মানুষের মুক্তির সামগ্রিক লড়াই যথাযথ ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারে না। এই লড়াই এমনকি বিদ্যায়তনের শ্রেণিকক্ষেও হয়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অবিরাম এই লড়াইয়ে আছেন। সাহিত্যের শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিভিন্ন ক্ষেত্রে নজর দিয়েছেন। মানুষ ইতিহাসকে যেভাবে জানে সেখানে প্রশ্ন করেছেন, ইতিহাসের মধ্যে যাঁরা পরিচিত ব্যক্তিত্ব, তাঁদের নতুনভাবে সন্ধান করেছেন। সমাজের মধ্যে মানুষের পারস্পরিক যে সম্পর্ক তার মধ্যকার গ্রন্থি বা বিভিন্ন মাত্রা সেগুলোকে খুলে দেখেছেন, বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি সামনে এনেছেন। সাহিত্য ও সমাজ, রাজনীতি-সাহিত্যের কারিগর ব্যক্তিত্বদের পর্যালোচনা করেছেন। রাষ্ট্র ও রাজনীতির ভূমিকায় মানুষের অবস্থান বিশ্লেষণ করেছেন। মানুষের সঙ্গে চিন্তার যোগাযোগ সহজ করার পদ্ধতি আয়ত্ত করেছেন দক্ষতার সঙ্গে, যার মাধ্যমে তিনি মানুষের সব দিকে নতুনভাবে আলো ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন। সাহিত্যের সঙ্গে যে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও শ্রেণি অবস্থানের গভীর যোগ, সেটিই বারবার দেখাতে চেষ্টা করেছেন।

তাঁর দীর্ঘ ১০ বছর ধরে লেখা ‘জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি’ (১৯০৫-৪৭) গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যা লিখেছিলাম তার একটি অংশ এখানে প্রাসঙ্গিক, ‘আমাদের এই অঞ্চলে ভক্তির আতিশয্য একটু বেশি। ফলে কোনো ব্যক্তি যদি শ্রদ্ধা অর্জনের মতো কিছু করেন, তাহলে তাঁকে দেবতার আসনে বসানোর প্রবণতা থাকে, কারো কাজে যদি সমালোচনা থাকে, তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে শয়তানের জায়গায় নামানো হয়। বিশেষণের রক্ষাব্যূহ তৈরি করে ব্যক্তিকে সব রকম পর্যালোচনার ঊর্ধ্বে রাখার চর্চার কারণে ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায় ইচ্ছাপূরণের গল্প। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এই গল্পফাঁদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার বিষয়ে বরাবর সচেতন থেকেছেন।’

লেখালেখি ও শিক্ষকতার পাশাপাশি সম্পাদনায় রয়েছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সুদীর্ঘ ইতিহাস। ২৩ বছর ধরে তিনি ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত সম্পাদনা করছেন। এর আগেও তিনি ত্রৈমাসিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এসব প্রকাশনার মাধ্যমে নতুন লেখক সৃষ্টি করা বা বিভিন্ন লেখকের লেখা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা তিনি দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সংগঠন ও সাংগঠনিক তৎপরতার সঙ্গেও নিজেকে অবিচ্ছিন্ন রেখেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

‘সমাজ রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্র’, ‘সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সংঘ’—এগুলোর মধ্য দিয়েও চিন্তার জগৎ সংগঠিত করার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশে যাঁরা সমাজ রূপান্তরের জন্য কাজ করেন, তাঁদের কাছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বড় ধরনের গ্রহণযোগ্যতা আছে। এর কারণে তিনি বাংলাদেশে ‘অক্টোবর বিপ্লবের শতবার্ষিকী’ আয়োজনের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা রেখেছিলেন।

বাংলা-ইংরেজি মিলে ১২০টি বই লিখেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি গল্প-উপন্যাসও লিখেছেন। তবে প্রধানত গবেষণামূলক কাজের প্রতি তাঁর আগ্রহ বেশি। তাঁর শিক্ষকতা, লেখালেখি, সম্পাদনা ও সাংগঠনিক কাজে যে কেন্দ্রীয় তাগিদ বা কেন্দ্রীয় লক্ষ্য ও তার ধারাবাহিকতায় কোনো ছেদ পড়েনি। তাঁর সব তৎপরতার কেন্দ্রীয় তাগিদ পুঁজিবাদী সমাজের অমানবিক, নিষ্ঠুর, বৈষম্যমূলক, সহিংস যে চরিত্র, সেগুলোকে উন্মোচিত করে মানবিক মুক্তির পথ সন্ধান করা।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিশ্বজুড়ে মানুষের চিন্তা ও সংগঠিত লড়াই থেকে নিজে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, অন্যদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং লক্ষ্যকে সুনির্দিষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। তিনি সব কাজের মধ্যে, চিন্তার মধ্যে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্যে সমাজকে বদলে দেওয়া বা সমাজের বিপ্লবী রূপান্তরের লক্ষ্য স্থির করেছেন, সমাজতন্ত্রের অপরিহার্যতা তুলে ধরেছেন। এ জন্য প্রয়োজনীয় যে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ দরকার, সেই কাজগুলো করাকেই তিনি জীবনের মূল লক্ষ্য স্থির করেছেন। সারকথা বলা যায়, বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক সততা, পরিশ্রম এবং অঙ্গীকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি।

একই সঙ্গে আনন্দের ও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এই ৯০ বছর বয়সেও তাঁর লক্ষ্যে কাজ করতে গিয়ে সামান্য ক্লান্তি স্বীকার করেননি। এখনো তিনি অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছেন। তাঁর সেই সক্ষমতারও কোনো ঘাটতি আমরা দেখছি না। প্রতি সপ্তাহে একাধিক পত্রিকায় তাঁর কলাম আমরা দেখে থাকি। নতুন দিগন্তে নিয়মিত তাঁর দীর্ঘ ও ধারাবাহিক লেখা দেখতে পাচ্ছি। এখনো তিনি গবেষণামূলক কাজ করছেন। মতাদর্শিক অঙ্গীকার খুব শক্তিশালী হলেই কেবল এই বয়সেও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এতটা স্বচ্ছ এবং সক্রিয় থাকা যায়। আমরা আশা করি, আরো বহু বছর তিনি সুস্থ ও সক্রিয় থাকবেন এবং বৈষম্য ও নিপীড়ন বিরোধী মানুষের চলমান লড়াইয়ে তাঁর কাজগুলো অনুপ্রেরণা দেবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পথ নির্দেশ করবে।

স্যারের ৯০তম জন্মদিনে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও বিনম্র ভালোবাসা।

#
লেখক : অর্থনীতিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ