কিংবদন্তি বিপ্লবী কমরেড অমল সেন লাল সালাম!

প্রকাশিত: ১:৫২ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১৯, ২০২৫

কিংবদন্তি বিপ্লবী কমরেড অমল সেন লাল সালাম!

Manual5 Ad Code

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

“ত্যাগে ত্যাগ নয়, ত্যাগে হচ্ছে অর্জন।”- অমল সেন

Manual6 Ad Code

‘৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তি কমরেড অমল সেনের ১১২তম জন্মবার্ষিকী আজ।

Manual8 Ad Code

কমরেড অমল সেনের সাথে খুব বেশি ঘনিষ্ঠতা ও সান্নিধ্যে দীর্ঘ সময় কথা বলার সুযোগ হয়েছিল ৯২ সালে তিন পার্টি (বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ ও সাম্যবাদী দল) একীভূত হওয়ার জন্য ঐক্য কংগ্রেসে। পরবর্তীতে প্রতি বছর ঢাকায় পার্টির প্রোগ্রামে গেলে সুযোগ পেলেই খুব আন্তরিকতার সাথে কাছে টানতেন এবং দীর্ঘ সময় কথা বলতেন। তরুণদের সাথেই তাঁর সখ্যতা ছিলো বেশি।

আজীবন বিপ্লবী মহান এই নেতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা! যৌবনের প্রারম্ভে আরাম-আয়েশ তুচ্ছ করে তিনি সংগ্রাম আর শিক্ষার আলোকবর্তিকা হাতে কৃষকের কুঁড়েঘর থেকে মানবমুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিপ্লবী জীবন ও রাজনীতি শুরু করেছিলেন। তাঁর স্মৃতিসৌধের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁরই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে হবে সকলকে। আজও শপথ নিতে হবে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাওয়ার।

১৯১৩ সালের ১৯ জুলাই কমরেড অমল সেনের জন্ম যশোর জেলার আফরা গ্রামে এক জমিদার পরিবারে। কিন্তু প্রায় শতাব্দীকাল এই ভূখণ্ডে কৃষক আন্দোলন আর কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যদিয়ে সার্বিক ভূমিকা রাখার পরও তিনি নড়াইলের অমল সেন ছিলেন। মৃত্যুর পরেও তিনি ফিরে গেছেন তাঁরই অতি প্রিয় মানুষদের কাছে, যারা তাঁকে স্মরণ করবে অনাগতকাল ধরে লোকজ সংস্কৃতির আবহে ‘অমল সেন’ মেলার মধ্য দিয়ে।

Manual8 Ad Code

তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আবহে বেড়ে ওঠা কমরেড অমল সেনও অতি অল্প বয়সেই জড়িয়ে পড়েন ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী আন্দোলনে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে এ দেশেও। তিনি দ্রুতই আকৃষ্ট হন মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী আদর্শের প্রতি। গড়ে তোলেন যশোর-নড়াইল অঞ্চলের ঐতিহাসিক তেভাগা কৃষক আন্দোলন। ‘নড়াইলের তেভাগা আন্দোলনের সমীক্ষা’ বইটিতে কমরেড অমল সেন তাঁর বিশ্লেষণী দক্ষতায় কৃষকের সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরেছেন।

নড়াইলের তেভাগা আন্দোলন স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসে। এ আন্দোলনের রয়েছে সমষ্টিগত সাফল্য, পাশাপাশি কী ত্যাগ-তিতিক্ষা করতে হয়েছিল এ এলাকার জনগণের, সেটাও ইতিহাসের অংশ। কত পরিবার ধ্বংস হয়েছে, কত জেল-জুলুম আর নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে, তা কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম? কমরেড অমল সেনের বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি সংগ্রামে ছিলেন সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে থাকা নেতা। যখন নির্যাতন, নিপীড়ন নেমে এসেছে, তখনো তিনি সামনে দাঁড়িয়েই তা সহ্য করেছেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তি যা করতো, তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের পর, পাকিস্তান আমলে, বিপ্লবী সংগ্রামীদের জীবনে নেমে আসে সেই নির্যাতন। পাকিস্তান আমলে ১৯ বছরই তাঁকে কাটাতে হয়েছে জেলে।

ভারতীয় উপমহাদেশে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিটি বাঁকে তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। দেশ বিভাগের প্রাক্কালে তৎকালীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গৃহীত রনদিভে লাইনের বাম বিচ্যুতি পার্টিকে যে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে, তা তিনি তাঁর কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক চেতনা থেকে বুঝতে পেরেছিলেন এবং তার বিরোধিতা করেছিলেন। ষাটের দশকে যখন বিশ্বব্যাপী চীন-সোভিয়েত কমিউনিস্ট মতাদর্শগত বিতর্ক, দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে দ্বন্দ্ব ও ভাঙনের মুখোমুখি করে, তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিও সে বিতর্ক এড়িয়ে যেতে পারেনি। ফলে, পার্টির ভাঙন আর তার ফলাফল এখন ইতিহাস। গোটা বিষয় তাত্ত্বিকভাবে যেভাবে মোকাবিলা করেছেন, তার দুটি ঐতিহাসিক দলিলে তা তিনি লিখেছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্টদের ভূমিকা সামনে নিয়ে তিনি যেমন রাজনৈতিকভাবে অবস্থান নিয়েছেন, তেমনি তৎকালীন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্টদের ঐক্যবদ্ধ করার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের ঐক্যবদ্ধ করার যে কাজ তিনি শুরু করেছিলেন, তা তিনি আমৃত্যু অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকের সব রাজনৈতিক সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, তা যেমন নির্দেশ করেছেন, তেমনি কমিউনিস্টদের ঐক্যের প্রতিভূ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছেন।

কোনো দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতিটি বাঁকে পার্টিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতে হয়, প্রয়োজনও বটে; কিন্তু সেসব রাজনৈতিক সংগ্রামে শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে তার নিজস্ব বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতেই হয়। কমরেড অমল সেন তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নির্যাস হিসেবে জনগণের বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দিয়েছেন তাঁর ‘জনগণের বিকল্প শক্তি’ লেখায়।
বর্তমান সমাজব্যবস্থার সার্বিক অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে তাঁর লেখা ‘কমিউনিস্ট জীবন ও আচরণ রীতি প্রসঙ্গে’ বইটি শুধু কমিউনিস্টদের নয়, সার্বিকভাবে ব্যক্তি ও সমাজকল্যাণের দিকনির্দেশক দর্শনের ভূমিকা পালন করতে পারে।

ইতিহাস তার গতিপথে কিছু মানুষ সৃষ্টি করে, আবার কিছু মানুষ তাঁদের জীবন দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তাঁরা কিংবদন্তি। কমরেড অমল সেন তেমনই একজন মানুষ, যাঁরা পাঁজরের হাড় জ্বালিয়ে, পথভ্রষ্টদের পথ দেখান। তিনি বিপ্লবী জীবনাদর্শ ও মনুষ্যত্বের প্রতীক।
ইতিহাসের জটিল পথপরিক্রমায় আমরা আজ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে সামনে এগোনোই আমাদের একমাত্র রাস্তা। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সংকট, বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের লগ্নি পুঁজির আগ্রাসন, বিশ্বায়ন, দেশের অভ্যন্তরে চরম সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান, শ্রমজীবী ও গণতান্ত্রিক শক্তির বিভ্রান্তি, কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল শক্তির বিভাজন ও হতাশা—এসব সংকট মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কমরেড অমল সেন তাঁর জীবদ্দশায় এর প্রতিটি সংগ্রামে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাত্ত্বিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর রেখে যাওয়া তাত্ত্বিক লেখা জনগণের বিকল্প শক্তি গড়ে তোলা এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অমূল্য শিক্ষা। তাঁর দেখানো পথ সামনে রেখে ইতিহাসের এই দায়কে কাঁধে নিতে হবে এ প্রজন্মকেই।
২০০৩ সালের ১৭ জানুয়ারি কমরেড অমল সেন চলে গেছেন। কিন্ত রেখে গেছেন এমন মহান এক আদর্শ, যার মৃত্যু নাই। তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন।
মহান ও কীর্তিমান মানুষদের নিয়ে সব সময়ই লেখা যায় আমরা এটা বিশ্বাস করি। পরিশেষে, সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনেই বিশ্বজনীন মহান এই গুণীর রাজনীতি, জীবন সংগ্রাম, কীর্তি, ইতিহাস, তত্ত্ব ও অনুশীলন সম্পর্কে পাঠ প্রাসঙ্গিক ও জরুরী।
রেড সেলুট কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তি বিপ্লবী কমরেড অমল সেন!

Manual1 Ad Code

#
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ;
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি;
সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা;
‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।
সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন।
সাধারণ সম্পাদক, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি।
প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ আইন ছাত্র ফেডারেশন।
E-mail : syedzaman.62@gmail.com
WhatsApp : 01716599589
মুঠোফোন: ০১৭১৬৫৯৯৫৮৯
Bikash number : +8801716599589 (personal)

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code