শীতে জবুথবু কুড়িগ্রাম, তীব্র শৈত্যপ্রবাহে দুর্ভোগে নিম্নআয়ের মানুষ

প্রকাশিত: ৫:০৫ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৮, ২০২৫

শীতে জবুথবু কুড়িগ্রাম, তীব্র শৈত্যপ্রবাহে দুর্ভোগে নিম্নআয়ের মানুষ

Manual5 Ad Code

বিশেষ প্রতিনিধি | কুড়িগ্রাম, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ : উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামে জেঁকে বসেছে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। কয়েকদিন ধরে সূর্যের দেখা মিলছে না বললেই চলে। সন্ধ্যা নামলেই ঘন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে নদী, চর ও জনপদ। গভীর রাত থেকে দুপুর পর্যন্ত তুষারের মতো শিশির ঝরছে, যা জনজীবনকে কার্যত স্থবির করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলের নিম্নআয়ের মানুষ, বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও দিনমজুররা।

রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহ ধরে কুড়িগ্রামের তাপমাত্রা ১২ দশমিক ২ থেকে ১১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। গত সোমবার (২২ ডিসেম্বর) জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আজ রবিবার (২৮ ডিসেম্বর) তা নেমে এসেছে ১১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সামনের কয়েকদিন তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকলেও রাতের বেলায় আরও কমতে পারে।

কুয়াশায় অচল চর ও নদীপথ

ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকছে নদীপথ। দূরের ঘরবাড়ি কিংবা নৌকার দেখা মিলছে না। এতে নৌযান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে, ঝুঁকিতে পড়ছেন নৌকাচালকরা।
রাজারহাট উপজেলার নৌকাচালক আব্দুল করিম বলেন, “সকালে নদীতে কিছুই দেখা যায় না। বিকেল হলেই আবার ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায় নদীপথ। অনেক সময় কুয়াশার কারণে পথ ভুলে যাই। এত ঠাণ্ডার মধ্যেও এখনও সরকারিভাবে কম্বল পাইনি।”

শিশু ও বৃদ্ধদের চরম দুর্ভোগ

চরাঞ্চলে শীতের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। কনকনে ঠাণ্ডায় শিশুদের কাঁপতে কাঁপতে ঘুম ভাঙে, আর বৃদ্ধরা রাতভর নির্ঘুম সময় কাটান। অধিকাংশ পরিবারের কাছে পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র নেই। ছেঁড়া কাঁথা, পাতলা কম্বল কিংবা পুরোনো জামা-কাপড় দিয়েই শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন তারা।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার গেন্দার আলগা চরের বাসিন্দা ছকিনা বেগম বলেন, “কয়দিন ধরে ছৈলপৈল (ছাওয়া) নিয়ে খুব কষ্টে আছি। জাম্পার দিয়েও জার (ঠাণ্ডা) দূর হয় না। সরকার আমকো (আমাদের) এখনও ঠুসে (কম্বল) দিল না।”

চর শোভারকুঠির কৃষক ফরিদ উদ্দিন বলেন, “দিনে সূর্যের দেখা নেই, রাতে বৃষ্টির মতো তুষার পড়ে। তারপরও সকালে কাজে বের হতে হয়। হাত-পা ঠিকমতো কাজ করে না।”

শীতজনিত রোগ ও কৃষিতে প্রভাব

Manual3 Ad Code

টানা ঠাণ্ডা ও কুয়াশার কারণে শীতজনিত রোগ বাড়তে শুরু করেছে। চর শোভারকুঠির কৃষক নূর জামাল বলেন, “রাতেও ঠাণ্ডা, দিনেও ঠাণ্ডা। এভাবে ঠাণ্ডা খাইতে খাইতে আমার দেড় বছরের বাচ্চার ডায়েরিয়া হয়েছে। কুয়াশা আর ঠাণ্ডায় বীজতলা, আলু, সরিষা ও শীতকালীন সবজিতে নানা রোগ দেখা দিচ্ছে।”

Manual8 Ad Code

জেলা সিভিল সার্জন ডা. স্বপন কুমার বিশ্বাস জানান, “শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডায়েরিয়া, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগসহ শীতজনিত রোগের প্রকোপ কিছুটা বেড়েছে। শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের ঘরের বাইরে বের হলে অবশ্যই মোটা কাপড় পরতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”

কম্বল বরাদ্দ থাকলেও মাঠে নেই বিতরণ

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল মতিন বলেন, “কুড়িগ্রাম জেলার ৯ উপজেলায় ২২ হাজার কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উপজেলাভিত্তিক বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিশেষ করে চরাঞ্চল ও ছিন্নমূলদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।”

তবে সরেজমিনে কুড়িগ্রাম সদরের চর যাত্রাপুর, চর শোভারকুঠি, উলিপুর উপজেলার চর গেন্দার আলগা, হকের চর, গুজিমারী, ঘুঘুমারীর চর, চর বালাডোবা, মোল্লাহাট এবং রৌমারীর চর শৌলমারীসহ একাধিক চরে ঘুরেও শীতবস্ত্র বিতরণের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি।

Manual6 Ad Code

সরকারের কার্যকর উদ্যোগের দাবি

কুড়িগ্রাম জেলা চর উন্নয়ন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বেবু বলেন, “চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ খুব একটা দেখা যায় না। বিশেষ করে এই শীতে দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষ চরম কষ্টে রয়েছে। দ্রুত পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।”

আরও কয়েকদিন শীতের আশঙ্কা

রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, “আগামী কয়েকদিন তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকতে পারে। দিনের তুলনায় রাতের তাপমাত্রা আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে।”

Manual6 Ad Code

শৈত্যপ্রবাহ দীর্ঘস্থায়ী হলে কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের। তাই দ্রুত ও সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে শীতবস্ত্র বিতরণ এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ