সিলেট ৩১শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:০৪ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২১
|| অনুবাদ : শরীফ শমশির || ঢাকা, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ : প্রথম আন্তর্জাতিকের হেগ কংগ্রেসে প্রদত্ত কার্ল মার্কসের ভাষণ —
[১৮৭২ সালের ২-৭ সেপ্টেম্বর হেগে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং মেনস এসোসিয়েশন (প্রথম আন্তর্জাতিকের)-এর পঞ্চম কংগ্রেস আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কংগ্রেসে সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের পথ ও পদ্ধতির প্রশ্নে আদর্শগত এবং সাংগঠনিকভাবে নৈরাজ্যবাদীদের পরাজয় ঘটে। এছাড়া, সত্যিকার প্রলেতারিয় বিপ্লবী শক্তি বনাম মধ্যবিত্ত সংকীর্ণবাদ, ছদ্ম-বিপ্লবীবাদ এবং বুর্জোয়া সংস্কারবাদের মধ্যে একটা পার্থক্য নিরূপিত হয়ে যায়। মার্কসবাদের প্রসারে এই পদক্ষেপ অনেকদূর এগিয়ে যায় এবং শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনে মার্কসবাদ মিশে যায়। হেগ কংগ্রেসের কার্যবিবরণীতে এই প্রথম শ্রমিক শ্রেণির স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যা মার্কস এবং এঙ্গেলস চল্লিশের দশক থেকে বলে আসছিলেন এবং প্যারিস কমিউনের অভিজ্ঞতায় যা বাস্তব দাবি হয়ে উঠেছিল। শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বের বিষয়টিও এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো। এই মঞ্চেই মার্কস এবং এঙ্গেলসের অন্যতম একটি মূলনীতি, স্ব স্ব দেশে শ্রমিকশ্রেণির পার্টি গঠনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলো। এই কংগ্রেসে ১৫টি ইউরোপীয় দেশ ও আমেরিকা মহাদেশ থেকে মোট ৬৫ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এই কংগ্রেসের শেষে ৮ সেপ্টেম্বর ১৮৭২ তারিখে আর্মস্টারডাম-এ কার্ল মার্কস বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন। এই বক্তৃতাটি একজন প্রতিবেদক ধারণ করে প্রকাশ করেছিলেন। বক্তৃতাটি La Liberte, সংখ্যা: ৩৭, সেপ্টেম্বর ১৫, ১৮৭২-এ এবং Der Volksstaat, সংখ্যা-৭৯, অক্টোবর ২, ১৮৭২ তে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে Documents of the First International; The Hague Congress of the First International, September 2-7 1872, Reports and Letters, Progress Publishers Moscow – 1978 সংকলিত হয়। এই সংকলনে অনূদিত ইংরেজী থেকে বক্তৃতাটি অনুবাদ করা হয়। সব দিক থেকেই মার্কসের বক্তৃতাটি ছিল ঐতিহাসিক এবং আজো সমান প্রাসঙ্গিক।]
প্রিয় নাগরিকবৃন্দ,
অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা এবং নৃপতিগণ এই হেগে নিজেদের রাজতন্ত্রের স্বার্থাদি নিয়ে আলোচনার জন্য নিয়মিত বৈঠকে বসতেন। অনেক ভয়ভীতি দেখানো সত্তে¡ও আজ আমরা এখানে শ্রমিক সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল জনগণের মধ্যেও আমরা আমাদের মহৎ সমিতির অস্তিত্ব, বিকাশ এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনা দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করতে চেয়েছি।
আমাদের সিদ্ধান্ত যখন প্রকাশিত হলো তখন অনেকেই বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, এখানে ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য আমরা আমাদের দূতদের পাঠিয়েছিলাম। হ্যাঁ, সব জায়গায়ই আমাদের দূত আছেন, আমরা এটা অস্বীকার করি না, কিন্তু তাদের অধিকাংশই আমাদের অপরিচিত। হেগে আমাদের দূতরা হলেন শ্রমিকবৃন্দ, যারা দিন-রাত হাঁড়ভাঙা পরিশ্রম করেন, এই আর্মস্টারডামেও তারা হলেন শ্রমিক যারা দিনে ষোল ঘণ্টা খাটুনি খাটেন। এই শ্রমিকরাই হলেন আমাদের দূত অন্য কেউ নন, প্রায় প্রত্যেকটা দেশেই তারা আমাদের উপস্থিতিকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত থাকেন, কারণ তারা দ্রæতই উপলব্ধি করেন যে আমরা তাদের ভাগ্যন্নোয়নের লক্ষ্যে কাজ করি।
হেগ কংগ্রেসে তিনটি প্রধান বিষয় অর্জিত হয়ঃ এতে ঘোষণা করা হয় যে, পুরনো ক্ষয়িষ্ণু সমাজের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির সামাজিক ক্ষেত্রের মতোই রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রয়োজনিয়তা রয়েছে; এবং আমরা সন্তোষের সঙ্গে লক্ষ্য করি যে, এখন থেকে লন্ডন কনফারেন্সের প্রস্তাব আমাদের নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত হবে।
আমাদের মধ্যে একটা দল রয়েছেন যারা শ্রমিকদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন।
এই পরামর্শ কত ভয়ঙ্কর ও আত্মঘাতি তা শ্রমিকদের জোর দিয়ে বোঝানো আমরা আমাদের দায়িত্ব বিবেচনা করেছি।
নিজস্ব সংগঠন তৈরি করে শ্রমিকদের একদিন রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করতে হবে; যে সকল নীতি পুরনো প্রতিষ্ঠানকে ঠিকে থাকতে সহায়তা করে সেগুলো তাদের উচ্ছেদ করতে হবে যদি তারা প্রথম যুগের খ্রিস্টানদের মতো হতে না চায়, যারা রাজনীতিকে অবহেলা ও তুচ্ছ জ্ঞান করায় পৃথিবীতে নিজেদের সা¤্রাজ্য কখনও দেখে নি।
কিন্তু কোনোভাবেই আমরা একথা বলছি না যে, সব জায়গায় এই লক্ষ্য পূরণের পন্থা একই হবে।
আমরা ভালোকরেই জানি বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠান, রীতিনীতি ও প্রথাগুলোকে হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে; এবং আমরা অস্বীকার করি না আমেরিকা, ব্রিটেন এবং আমি যদি আপনাদের প্রতিষ্ঠানকে ভালোভাবে জানি তবে হল্যান্ড; এসব দেশে শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে। এসব সত্য জানা সত্তে¡ও আমাদের স্বীকার করতে হবে এই মহাদেশের বেশিরভাগ দেশেই আমাদের বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি হবে; শক্তি প্রয়োগ। শ্রমিকদের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একটা সময়ে শক্তি প্রয়োগই হবে শেষ অবলম্বন।*
হেগ কংগ্রেস সাধারণ পরিষদকে নতুন ও অধিকতর ক্ষমতা দিয়ে শক্তিশালী করেছে। বস্তুত যখন একই সময়ে বার্লিনে রাজারা সমবেত হচ্ছে এবং যখন সামন্ততন্ত্র এবং অতীতের ক্ষমতাশালী প্রতিনিধিদের সভা থেকে আমাদের ওপর নতুন ও আরো তীব্র নিপীড়ন চালাবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হচ্ছে এবং এমন এক সময়ে যখন আমাদের উপর নির্যাতন সংঘটিত হচ্ছে তখন হেগ কংগ্রেস যথার্থই মনে করে সাধারণ পরিষদকে আরো কেন্দ্রীভ‚ত এবং ক্ষমতাশালী করা জরুরি এবং তা হবে বিচক্ষণতার পরিচায়ক। তা না হলে আসন্ন সংগ্রামের সময় বিচ্ছিন্নতার কারণে আমাদের কর্মকান্ড শিথিল হয়ে যেতে পারে। প্রসঙ্গত বলি, সাধারণ পরিষদের ক্ষমতাবৃদ্ধিতে আমাদের শক্ররা ছাড়া আর কে বেশি আতঙ্কিত হবে?
এটা মানা হলো কিনা তা আমলাতন্ত্র এবং সশস্ত্র পুলিশই কি নিশ্চিত করবে? তাদের এই কর্তৃত্ব কি পুরোপুরি নৈতিক নয় এবং এই সিদ্ধান্তগুলো কি ফেডারেশনগুলোকে জানানো হবে না যারা এগুলো বাস্তবায়ন করবে? এধরনের পরিস্থিতিতে, রাজাদের যদি কোনো সেনাবাহিনী, পুলিশ বা বিচারক না থাকে তবে বিপ্লবের অগ্রগতিতে তাদের বাধা দুর্বল হয়ে আসবে এবং নৈতিক প্রভাব খাটানোর মধ্যেই তাদের কর্তৃত্ব সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে।
সবশেষে, হেগ কংগ্রেস সাধারণ পরিষদের দপ্তর নিউ ইয়র্ক-এ স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অনেকেই, এমনকি আমাদের বন্ধুরাও এই সিদ্ধান্তে হতবাক হয়েছেন। তখন কি তারা বিস্মৃত হয়েছেন যে আমেরিকা শ্রমিকদের জন্য সর্বোত্তম আবাসস্থল হয়ে উঠছে; প্রতি বছর অন্য মহাদেশ থেকে পাঁচ লক্ষ মানুষ, শ্রমিক, অভিবাসী হিসেবে সেখানে পাড়ি জমাচ্ছেন। ফলে শ্রমিকরা যেখানে প্রাধান্য বিস্তার করছেন আন্তর্জাতিকের কী অবশ্যই সেখানে বলিষ্ঠভাবে শেকড় গাড়া উচিত নয়? তদুপরি কংগ্রেস সাধারণ পরিষদকে সংগঠনের কাজে যাদের উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় মনে করবে তাদের কো-অপ্ট করার ক্ষমতা প্রদান করেছে।
আমরা বিশ্বাস করি তারা ইউরোপে সমিতির পতাকা বহন করার মত কাজে পারদর্শী ব্যক্তিদের নির্বাচনে দক্ষতার স্বাক্ষর রাখবে।
প্রিয় নাগরিকবৃন্দ, আসুন আমরা আন্তর্জাতিকের এই মৌলিক নীতিটি আমাদের বুকে ধারণ করি; তাহলো: সংহতি। সকল দেশের সকল শ্রমিকের মধ্যে এই জীবনদায়ী নীতি যদি আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারি তবেই আমরা যে লক্ষ্যে সংগ্রামে নিয়োজিত আছি তা অর্জন করতে পারব। বিপ্লবে অবশ্যই এই সংহতির প্রকাশ ঘটতে হবে এবং এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমরা দেখি প্যারিস কমিউন ব্যর্থ হয়েছিল কারণ বার্লিন, মাদ্রিদ এবং অন্যান্য কেন্দ্রগুলোতে প্যারিস কমিউনের সমর্থনে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়নি।*
আমি ব্যক্তিগতভাবে আশ্বাস দিতে পারি আমি আমার কাজে সর্বক্ষণ নিয়োজিত থাকব এবং শ্রমিকদের মধ্যে সংহতি অর্জনের জন্য নিরন্তর কাজ করে যাব যা ভবিষ্যতে ফল বয়ে আনবে। না, আমি বরং সেই সামাজিক মতাদর্শের বিজয়ের জন্য অতীতের মত নিবেদিতভাবে বাকী জীবন কাজ করে যাব এবং আমি নিশ্চিত একদিন বিশ্বজুড়ে শ্রমিক শ্রেণির সর্বজনীন ক্ষমতা অর্জিত হবে।
* এই বাক্যের পূর্ববর্তী বাক্যটি Der Volksstaat এ ছিল: “কিন্তু এটা সকল দেশের ক্ষেত্রে একই রকম নয়”
* Der Volksstaat এ ছিল: কারণ সুনির্দিষ্টভাবে অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের মধ্যে এই সংহতির অভাব ছিল।
অনুবাদক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D