কমিউনিস্টদের ফিরতে হবে ইতিহাসের কাছে

প্রকাশিত: ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২৮, ২০২০

কমিউনিস্টদের ফিরতে হবে ইতিহাসের কাছে

|| রাশেদ খান মেনন || ২৮ নভেম্বর ২০২০ : করোনাকালে গৃহবন্দি থাকার মধ্যে কুফল যেমন ছিল, তেমনি সুফলও ছিল। ছিল বলছি এ কারণে যে, বছরের শেষের দিকে ভ্যাকসিন পাওয়ার আশার কথা বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তা ছাড়া গবেষণায় বলেছে ঢাকা মহানগরের ৪৫ শতাংশ লোকের মধ্যে করোনার অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। সেটা হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছেছে কিনা- এ নিয়ে কথা না বললেও সাধারণভাবে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ কমে এসেছে। শীতে নতুন ঢেউ না এলে ভ্যাকসিনের কল্যাণে গৃহবন্দিত্ব থেকে কিছুটা মুক্তি মিলবে। ভ্যাকসিন সবার না জুটলেও আমাদের বয়সীরা অগ্রবিবেচনা পাব বলেই ধারণা। ফলে নতুন বছরের শুরুতে স্বাভাবিক জীবনে (নতুন স্বাভাবিকতা?) ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনায় মনটা উৎফুল্ল। এর চেয়েও উৎফুল্ল বোধ করছি করোনাকালে বাধ্যগত অবসরে আত্মসমীক্ষার সুযোগ পেয়ে। এই আত্মসমীক্ষা যেমন নিজের ব্যক্তিজীবনের, তেমনি রাজনৈতিক জীবনের। আত্মসমীক্ষা করতে গিয়ে বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক বই পড়ে ফেলেছি। এর মধ্যে রয়েছে বন্ধু কমরেড হায়দার আকবর খান রনোর সাদামাটা ভাষায় লেখা কয়টি বই। মনে হয়েছে বইগুলো সম্পর্কে এ দেশের নতুন প্রজন্মকে জানানো প্রয়োজন।

এমনিতেই নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের (বেশ কিছু ব্যতিক্রম বাদে অবশ্যই) ইতিহাসজ্ঞান কম। এটা তাদের দোষ না। স্কুল-কলেজের পাঠক্রমে সমাজপাঠে ইতিহাস-ভূগোল-রাষ্ট্র-সমাজ সম্পর্কে যে ধারণা দেওয়া হয়, তাতে তাদের ওই দুই বিষয় সম্পর্কে গভীরে যাওয়া দূরের কথা, খুব একটা সাধারণ ধারণাও হয় না। অবস্থাটা এমনই ছিল যে, কলেজ পর্যায়ে দেশ-বিদেশের ইতিহাস দূরের কথা, বাংলাদেশের ইতিহাসটা পর্যন্ত পড়ানো হতো না। আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকার সময় দেশের কিছু স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ যে প্রচেষ্টা নেন, তাকে আমি সমর্থন দিই। এবং তারই ধারাবাহিকতায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পর্যায়ে বাংলাদেশের ইতিহাস বাধ্যতামূলক বিষয় করা হয়। কিন্তু তার পরও দেশের কলেজ পর্যায়ে ইতিহাসের ছাত্র পাওয়া যায় না।

কমিউনিস্ট কর্মী হিসেবে ইতিহাসজ্ঞান কত প্রয়োজন নয়াচীনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মাও সেতুং সেটি বলে গেছেন। তিনি চীনের পার্টি কর্মীদের দেশের একশ বছরের ইতিহাস সম্পর্কে জানার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে কমিউনিস্ট ও বাম কর্মীদের এসব ব্যাপারে জ্ঞানের পরিধি খুবই সীমিত। এর প্রধান কারণ ছোটবেলা থেকে তারা যা পড়ে এসেছে, যা সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে, সেটি তাদের ওই জ্ঞান শক্ত দূরে থাক, সাধারণ ভিতের ওপরেও দাঁড় করায় না। তার চেয়ে বড় কথা, সমাজতান্ত্রিক কর্মী হিসেবে সমাজ বিকাশের ধারা, সমাজের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও তার বিকাশ সেই গোড়া থেকে সমাজ বিপ্লবের ইতিহাস, তার উত্থান-পতন এবং সর্বোপরি ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে তা দেখার জন্য যে স্ট্রাকচার বা পাঠকাঠামো প্রয়োজন তা প্রায় সব কমিউনিস্ট ও বাম দলে অনুপস্থিত বা উপস্থিত থাকলেও তা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে না। দু-একটি দল বা দু-একজন ব্যক্তি এতে আপত্তি করবেন। তারা বলবেন আমাদের খুবই স্ট্রাকচার্ড পাঠচক্র আছে। তার যথাযথ অনুশীলনও হয়। কিন্তু একটু আঁচড়ালেই তার অন্তঃসারশূন্যতা বেরিয়ে আসবে। আবার বলছি এটা সাধারণ অবস্থা। ব্যতিক্রম সবকালে ছিল, এখনও আছে।

আমাদের সময়ের কথা বলি। তখন ঘোর সামরিক শাসন। পাকিস্তানের প্রায় পুরোটা সময়ই কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। নিষিদ্ধ ছিল কমিউনিস্ট সাহিত্য অথবা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার কোনো বই, পত্রপত্রিকা সবই। আমার মনে আছে, আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। ‘৫৪-র নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ভেঙে দিয়ে দেশের ৯২-ক ধারায় কেন্দ্রীয় শাসন জারি হয়েছে। আমাদের ময়মনসিংহের বাসায় বড় ভাইদের সংগ্রহের মার্ক্সবাদী ও বাম প্রগতিবাদী ধারার যে বইপত্র ছিল আমার জেলা জজ পিতা সেগুলো বের করে পুড়িয়ে ফেলেন। বড় ভাইয়েরা সবাই কমিউনিস্ট পার্টি, তার ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অন্যদিকে বাষট্টির দিকে এসে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের ধাক্কায় সামরিক শাসনে বরফ গলা শুরু হয়েছে, তখন যে মার্ক্সবাদ শিক্ষার বই দিয়ে আমাদের হাতেখড়ি তার নাম ‘ছোটদের রাজনীতি’, ‘ছোটদের অর্থনীতি’। বন্ধু রনোর কলকাতার নানাবাড়ির সুবাদে সে কলকাতা বেড়াতে গেলে লুকিয়ে ছাপিয়ে কিছু মার্ক্সবাদী বই আনত। সেখান থেকে যে বইটা প্রথম হাতে পেয়েছিলাম, সেটি ছিল অনিল মুখার্জীর লেখা ‘সাম্যবাদের ভূমিকা’। তাও পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর আইবি অফিসের টয়লেটে ছিঁড়ে ফেলে ফ্লাশ করে দিয়েছিলাম। তবে ‘৬৪টি’ জেলখানা আমার জন্য বড় শিক্ষালয় ছিল। পুরোনা সব কমরেড ছিলেন, যারা মার্ক্সবাদ পড়তে ও বুঝতে সাহায্য করেছিলেন। এর বাইরে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘লোকায়ত দর্শন’, রাহুল সাংকৃত্যায়নের বইগুলো ছাড়াও জেল লাইব্রেরি পুরোনো রাজবন্দিদের দান করা ‘রেডস্টার, ওভার চায়না’, ‘ফরম কপিয়াম ওয়ার টু লিবারেশন’ জাতীয় বই পড়ার সুযোগ হয়েছিল।

বস্তুত ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান আমলের প্রথমভাগে জেলখানা ছিল কমিউনিস্ট কর্মীদের শিক্ষালয়। ষাটের দশকের মধ্যভাগে এসে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নত করলে মস্কোর প্রগতি প্রকাশন ও চীনের ‘গৌজী সুদিয়ানের’ প্রচুর বই, বেইজিং রিভিউ, মস্কো টাইমস পত্রিকা এ দেশে আসতে শুরু করে। কিন্তু ততদিনে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিতর্ক-বিভক্তির ধারা শুরু হয়েছে। ওই সময়ে সমাজতান্ত্রিক চিন্তার মূল ভিত সম্পর্কিত বইগুলো এলেও প্রধান যেসব বই তরুণ কর্মীদের আকর্ষণ করত তা হলো পলেমিকাল বা বিতর্কমূলক বই। কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভিতরকার বিতর্ক- যখন মস্কো-পিকিং বিভক্তি ঘটে গেছে, তখন সোভিয়েত সাহিত্যের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ, শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতা, পুঁজিবাদী পথ এড়িয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ, শ্রেণি রাষ্ট্রের বদলে জনগণের রাষ্ট্রের তত্ত্ব প্রভৃতি। অন্যদিকে চীনের সাহিত্যে প্রথম দিকে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী আদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হলেও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর তা ‘লালবই’ আর মাও সেতুংয়ের কোটেশনে রূপ নেয়। সেসব মুখস্থ ও উদ্ৃব্দত করে কথা বলে যখন কমিউনিস্ট বিপ্লবী হওয়া যেত, তখন কমিউনিস্ট আদর্শের মূল সাহিত্য পড়ার প্রয়োজন অনুভূত হতো না।

বাংলাদেশ-পরবর্তীকালে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ, সোভিয়েত বিপ্লব, চীন বিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তরুণদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারার, তরুণদের বড় অংশ ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে’র স্লোগানে ‘বিপ্লবের স্বপ্ন’ নিয়ে এগোতে থাকে। কিন্তু ওই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কোনো তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল না। প্রায়োগিক দিকও ছিল ভ্রান্ত। ফলে শিগগিরই তা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

আশির দশকে এসে মার্ক্সবাদ নিয়ে তরুণদের মধ্যে চর্চা শুরু হয়। অবশ্য যে কথাটা বলতে ভুলে গেছি তা হলো বাংলাদেশ-পরবর্তী সময়ে সিপিবি ও মোজাফ্‌ফর ন্যাপের কর্মীদের সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব জার্মানিতে পাঠানো হতো মার্ক্সবাদ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য। তবে সে জ্ঞান অর্জন যে কোনো কাজে লাগেনি তার প্রমাণ ওইসব নেতাকর্মীর অধিকাংশের কমিউনিস্ট মতবাদ পরিত্যাগের ঘটনায়। চীনও নকশালপন্থি ধারার নেতাকর্মীদের নিয়ে তাদের দেশে মাস-দু’মাস রেখে তত্ত্ব ও প্রয়োগের জ্ঞানদানের চেষ্টা করেছে। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই ভদকা মাওতাইয়ের ধ্বংস সাধন হয়েছে মাত্র। এসব ট্রেনিংপ্রাপ্ত মার্ক্সবাদী কেউই কোনো কিছু লিখেছেন বলে নজরে আসেনি। বরং মস্কোতে যারা লেখাপড়া করতে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই মার্ক্সবাদী অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি সম্পর্কে মেধার পরিচয় দিয়েছে। তবে তারা দেশে ফিরে এসে আর কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে সেভাবে যুক্ত থাকেনি। ইতোমধ্যে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটেছে। পুঁজিবাদী বুদ্ধিজীবী ও ইতিহাসবিদরা তাকেই সমাজতন্ত্রের ইতি বলে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছে। বলেছে পুঁজিবাদই ইতিহাসের শেষ সত্য। অন্যদিকে বিশ্ব রাজনীতিতে অবস্থান নিতে গিয়ে চীনের ‘অতিবামমোড়’ বাংলাদেশে কেবল আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনেও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, একটি প্রজন্মের ধ্বংস সাধন করেছে। পরবর্তী সময়ে চীনের স্বপথে ফিরে আসার পাশাপাশি তার ‘উন্মুক্তকরণ’ এও ‘সংস্কার’ নতুন নতুন প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। চীন অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পার্টির নেতৃত্ব, তাত্ত্ব্বিক ও সাংগঠনিক শুদ্ধতার ওপর জোর দিচ্ছে, চীনের পার্টি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে কিন্তু এখনও বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভ্রান্তি কাটেনি। ইতোমধ্যে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বিপর্যয়, বিশ্বায়ন, প্রভৃতি প্রশ্ন বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনকেই অনেক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির বিপুল উন্নতি ও তার প্রভাব, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনে আরও সব নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। উৎপাদন শক্তির সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব নতুন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এসবের উত্তর খুঁজে পাওয়া প্রয়োজন।

কিন্তু তার জন্য মার্ক্সের কাছে, লেনিনের কাছে ফিরে যেতে হবে। ফিরে যেতে হবে সমাজ বিকাশের যে ধারা সামন্ত সম্পর্ক থেকে পুঁজিবাদী সম্পর্কে উত্তরণ ঘটিয়েছে, উত্তরণ ঘটিয়েছে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের- সাম্যবাদী সমাজের পথযাত্রার পর-ইতিহাস জানতে হবে। জানতে হবে নিজ দেশকে, নিজ দেশের ইতিহাসকে। এটা একটা লম্বা তালিকা। কিন্তু তাও সহজভাবে তুলে সেই জ্ঞান নিজ দেশের বাস্তবতায় প্রয়োগ কীভাবে হতে পারে, সেই ধারণার সৃষ্টি হলে খুব একটা গুরুভার কিছু হবে না। কমরেড রনোর তিনটি বই ‘ফরাসি বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব’, ‘দুই খণ্ডে পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ’ তার নির্যাসই তুলে ধরেছে অত্যন্ত সহজ পাঠ্যভাবে। আবার ওই বই থেকেই মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের মূল সূত্রগুলোর সন্ধান কীভাবে পাওয়া যাবে তার নির্দেশও আছে। অবশ্যপাঠ্যগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণও আছে। বিবরণ আছে সমাজ বিকাশের ইতিহাসের। বিবরণ আছে শ্রেণিদৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস, সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি পাঠের।

প্রথম বইটি ‘ফরাসি বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব’। ফরাসি বিপ্লবকে আমরা সাধারণভাবে জানি সাম্য ভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতা-মন্ত্রে উজ্জীবিত বিপ্লব হিসেবে। কমরেড রনো কেবল ফরাসি বিপ্লব বা প্যারিকমিউনের ইতিহাসই বিবৃত করেননি। সে সময়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশের পুঁজিবাদের বিকাশ, শ্রমিক শ্রেণির বিকাশ, তাদের আন্দোলনের বিকাশ, উত্থান-পতন, দর্শনে নব নব আবিস্কারসমূহ খুবই সাধারণভাবে তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন কীভাবে মার্ক্স ও তার বন্ধু অ্যাঙ্গেলস ভাববাদকে খণ্ডন করেছেন, আবার হেগেলের বস্তুবাদী চিন্তাকে বিকশিত করেছেন। ইতিহাসের বস্তুবাদী প্রয়োগে সমাজ বিকাশ ধারাকে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন কীভাবে সমাজ বিকাশের গতিধারায় পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রের উত্তরণ ঘটেছে, সাম্যবাদী পথযাত্রার উন্মোচন ঘটেছে। আর এর দাত্রী হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টি জন্ম দিয়েছেন, এগিয়ে নিয়েছেন। তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছে মার্ক্সবাদ। রচিত হয়েছে কমিউনিস্ট ইশতেহার। গঠিত হয়েছে কমিউনিস্ট সংগঠন। কীভাবে পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ঘটবে সে সম্পর্কেও বিস্তারিত যা লিখে গেছেন মার্ক্স (ও তার সাথি অ্যাঙ্গেলস) তার সংক্ষিপ্তসার উপস্থাপন করেছেন রনো অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে, যা মার্ক্সবাদের বিশাল পরিধিকে সবার কাছে সহজবোধ্য করে তোলে। কিন্তু রনো সেখানেই থেমে যাননি। মূল বইগুলোর কথাও তুলে ধরেছেন, যাতে কেউ সেই সূত্র ধরে তা অধ্যয়ন করতে পারে। সেটি আত্মস্থ করতে পারে। এরপর রনো দেখিয়েছেন কীভাবে লেনিন মার্ক্সবাদের বিকাশ ঘটিয়েছেন। রুশ দেশের বাস্তবতায় তার প্রয়োগ ঘটিয়ে বিপ্লব সাধন করেছেন। অক্টোবর বিপ্লব সংঘটনে যে বিভিন্ন পর্যায়কাল অতিক্রম করতে হয়েছিল, এ জন্য লেনিনকে কী কঠিন ও তীক্ষষ্ট মতাদর্শগত লড়াই করতে হয়েছে তার বিবরণ পাই অক্টোবর বিপ্লবের ঘটনাক্রমের বিবরণে।

একজন কমিউনিস্ট কর্মীর নিজ দেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানা জরুরি। রনোর প্রথম বইটা পড়লে তার যে দৃষ্টিভঙ্গি জন্মাবে তা দিয়ে নিজ দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবে। উপলব্ধি করতে পারবে দেশের মানুষের সংগ্রামকে। সমাজ অর্থনীতির অগ্রগতিকে। একই সঙ্গে তার মধ্যে উপলব্ধি জন্মাবে নিজ দেশের সমাজ বিকাশ সম্পর্কে। সাহিত্য-সংস্কৃতির উত্তরণকে। কমরেড রনোর দুই খণ্ডের ‘পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ’ বইয়ের পলাশীর যুদ্ধ থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথ পরিক্রমাকে বিবৃত করেছেন। এই পথ পরিক্রমায় নায়ক-খলনায়কদের চিত্রিত করেছেন। সবচেয়ে বড় মানুষের সংগ্রামগুলোকে প্রতি সময়ের বাস্তবতার আলোকে তুলে ধরেছেন। আর এসবই তিনি করেছেন শ্রমিক শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। দেশের নতুন প্রজন্ম এই দু’খণ্ডের মধ্য দিয়ে নিজ দেশকে চিনবে, দেশের মানুষকে চিনবে, জানবে নিজ ঐতিহ্য। আর তাই তাকে দেশকে আরও ভালোবাসতে শেখাবে। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের লড়াইয়ে তাকে আরও দক্ষ ও যোগ্য করে তুলবে।

আমাদের দেশের কমিউনিস্ট কর্মীদের গড়ে উঠতে এই ধরনের বই কেবল সহায়ক হবে না, দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে সাহায্য করবে। প্রাথমিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নিজেদের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করতে ইতিহাসের কাছে ফেরার বিকল্প নেই। বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের ইতিহাসের কাছে ফেরা এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে সবচেয়ে বেশি জরুরি।

#
রাশেদ খান মেনন এমপি
সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ