কিশোরিদের উদ্যত হাত আর বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো তরুণেরা আমাদের ভবিষ্যত

প্রকাশিত: ৮:৪৩ অপরাহ্ণ, জুন ২৮, ২০২২

কিশোরিদের উদ্যত হাত আর বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো তরুণেরা আমাদের ভবিষ্যত

সুশান্ত দাশ |

আমাদের শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব বা বার্ধক্য কোন কালেই জন্মদিন পালনের সুযোগ হয়নি। আমাদের জন্মটা যে যুগে সে সময়, নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত কারোর ঘরেই এই রেওয়াজ ছিল না। একটু যারা সম্পন্ন তাদেরও যে হতো তা বলা যায় না, হলেও একেবারেই স্বল্প পরিসরে অন্য আংগিকে। কিন্তু যুগ পাল্টালো। মধ্যবিত্ত এমন কি নিম্নবিত্তর ঘরেও ছেলেমেয়েদের জন্মদিন পালিত হতে শুরু হলো। কিন্তু ‘ইন্টারনেট’ হবার পর শুরু হলো ‘ভার্চুয়াল জন্মদিন’। গুগল সাহেব স্মরণ করিয়ে দেন, তারপর জন্মদিনের শুভেচ্ছা আসতে শুরু করে। প্রথম দিকে অনভ্যাসের অস্বস্তি হতো। এখন ভালো লাগে এই ভেবে যে, আমরা এই বয়সেও কিছুটা হলেও এখনো প্রাসঙ্গিক আছি। আমার সন্তানসম ছাত্রছাত্রীরা, রাজনীতির সব বয়সের সহকর্মীরা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় সবার কাছ থেকেই এই শুভেচ্ছা আসে। আমি সবাইকে আমার হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই।

আজ থেকে সত্তর বছর আগে মায়ের কোল ছাড়া কোন আশ্রয় ছিল না। আর আজ সত্তরতম জন্মদিনে পদ্মাসেতু পার হলাম। মা গত হয়েছেন প্রায় ৫০ বছর আগে। আমার জন্মস্থান পদ্মা আর যমুনার মিলনস্থলের পাশে। আশৈশব এই দু’টি নদী আমদের মায়ের মত। এই দু’টি নদী কখনো আমাদের আনন্দের উৎস ছিল, কখনো ছিল কীর্তিনাশার মত নিঃস্ব করে দেবার উৎস। এই আনন্দ বেদনা নিয়েই এ দু’টি নদী আমাদের কাছে চির প্রবহমান। আজ যখন পদ্মাসেতু দিয়ে পার হচ্ছিলাম, তখন আশৈশব বহু স্মৃতি ঘুরপাক খাচ্ছিল মনে। পদ্মাসেতু নিয়ে উচ্ছাস আবেগ অনেক হয়েছে। এ সম্পর্কে কিছু বলাটাই এখন ক্লীশে হয়ে যাবে। পদ্মাসেতু দেশের যেমন গৌরব এবং অর্জন, তেমনি এটা সামনের বেশ কয়েকবছরের জন্য ‘রাজনীতি’ও বটে। এটা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা পরে করার আশা রইলো। আজ প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলার চেষ্টা করা যাক। দেশ বিদেশের অনেকেই আমার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। কিন্তু একটি শুভেচ্ছা ছিল ব্যতিক্রম। যিনি করেছেন তিনি আমার একসময়ের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা। তিনি যা লিখেছেন তার বাংলা বহু প্রচলিত একটি কথা,’রোম যখন পোড়ে, নীরো তখন বাঁশি বাজায়।’ অর্থটা কিন্তু খুবই স্পষ্ট। অর্থাৎ দেশে যখন অনেক ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে তখন জন্মদিনের শুভেচ্ছার মত অদিখ্যেতাকে আর কীইবা বলা যায়? গত দু’সপ্তাহেরও বেশী সময় ধরে বাংলাদেশের উপর দিয়ে অশনি সংকেত বয়ে যাচ্ছে। সীতাকুন্ডের ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। অর্ধশত মানুষের নির্মম মৃত্যু, দ্বিশতাধিক মানুষের জীবম্মৃত হওয়ার এক দুসঃসহ স্মৃতি। কিন্তু এর মধ্যে ২৫ জুন বহু প্রত্যাশিত ‘পদ্মাসেতু’র উদ্বোধন ঘোষণা হয়েছে। স্বাভাবিক প্রশ্ন ওঠে সীতাকুন্ডের ঘটনা কি দূর্ঘটনা না অন্য কিছু। তা জানা যায় নি সঠিকভাবে। কিন্তু তা নিয়ে কিঞ্চিত রাজনীতি হয়েছে। তারপর হয়েছে ট্রেনে অগ্নিকান্ড। এটা কি নাশকতা? পদ্মাসেতুর উদ্বোধন এগিয়ে আসছে। শুরু হলো বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার। এক কোটিরও বেশী মানুষ চরম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত হলো। বাংলাদেশের মানুষকে যে যাই বলুক অমানুষ বলা যাবে না। সরকারি উদ্যোগ কি হলো না হলো তা নিয়ে রাজনীতি হবে, আলোচনা হবে, টানা পোড়েন হবে। কিন্তু মানুষ বসে থাকলো না। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলায় লেগে গেল। জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে এই সিলেটে। ফলে এক উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কাটলো দিন। তারপর দেখলাম শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক সহ চেনা রাজনীতির অনেকেই নেমেছে এই মানবিক বিপর্যয়কে রুখে দিতে। এখনো চলছে তা। কিন্তু পদ্মাসেতু উদ্বোধন হয়েছে এই বিপর্যয়ের মধ্যেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ আনন্দে উদ্বেল হয়েছে। মনে তো খটকা লাগেই। তারপরও আলো আঁধারের এই জীবন চলছেই।
এর মধ্যে শুরু হলো আর এক বিপর্যয়(?) নড়াইলের এক কলেজের শিক্ষক এবং ভারপাপ্ত অধ্যক্ষকে ‘পাদুকা মালা’ পড়তে হল ঐ এলাকার প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিদের সামনে। এই শিক্ষককে কেন তা পড়তে হলো তা আমি পুনরায় ব্যক্ত করতে চাই না। এটা বহল প্রচারিত। আমি এই শিক্ষকের ধর্মীয় পরিচয়ও আনছি না। তিনি একজন শিক্ষক এটাই তাঁর পরিচয়। এর প্রায় সঙ্গে সংগেই সাভারের একটি কলেজের এক তরুণ শিক্ষক প্রকাশ্যে সবার সামনে ছাত্রের হাতে নিগৃহীত এবং খুন হলেন। এরমধ্যে দেখছি আমাদের সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক বাংলাদেশের পদার্থবিজ্ঞানের একমাত্র এমিরিটাস প্রফেসর প্রফেসর অরুণ কুমার বসাকের বসত বাটি তাঁরই পড়শির দ্বারা আত্মসাৎ হচ্ছে। তিনি হাইকোর্টের নির্দেশ পেয়েছেন, কিন্তু সেখানকার প্রশাসন আত্মসাতকারীর পক্ষে। এই সব ঘটনাই কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? এখানে যদি কেউ সাম্প্রদায়িকতার স্পর্শ পায়, তাকে কি দোষ দেওয়া যাবে? আবার শুনলাম নড়াইলের এই ঘটনার বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে লেখার ফলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষককে হেনস্তা করা হয়েছে। তাঁর সন্ত্রস্ত পিতা অনেক রাতে টেলিফোনে আমাকে তাঁর ভয়ের কথা জানালেন। এই সকল ঘটনার প্রেক্ষিতে এর আগে একটি কথাও উচ্চারণ করিনি প্রকাশ্যে। কিন্তু সব জায়গাতেই যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। প্রকাশ্যে কেন করিনি তা এখন বলছি না। সময় হলে বলবো। কেউ কাপুরুষ বা ভীতু বললেও আপত্তি করবো না। এর মধ্যে কথা হলো নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয়ের সঙ্গে। তিনি নিজেই টেলিফোন করেছিলেন, নড়াইলের ঘটনায় তিক্ত বিরক্ত বিক্ষুব্ধ। তিনি প্রতিকারের লড়াইএ নামবেন। বাংলাদেশকে ফিরে পেলাম। অনেক বামপন্থী রাজনৈতিক দল এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। আশ্বস্ত হলাম। প্রধান প্রধান অনেক বৃহৎ দল বা যারা গণতন্ত্রের কথা, মানবাধিকারের কথা বলেন, তাঁদের নীরবতায় বিস্মিত হলাম না। কিন্তু যারা সরকারে আছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেন তাঁরা কি করছেন? তাঁদের নীরবতা যে তাদেরকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে তাঁরা কি তা বুঝতে পারেন? দুর্জনে তো বলেন তাঁদের বসনের আড়ালেই এই কাজ করছেন অনেকে। তাঁরা কতটা তাঁদের পর আর কতটা আপন এই কথাটা তাঁরা বোঝেন না? এর মধ্যে দেখি তাঁদের মন্ত্রীরা দেশে বিদেশে দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি রক্ষা করতে বদ্ধ পরিকর হচ্ছেন।
যাহোক এতসব অন্ধকারের শেষে বাংলাদেশকে ফিরে পেলাম যখন সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাভারের নিহত শিক্ষকের ছাত্র ছাত্রীরা বিশেষ করে ছাত্রীরা বিচারের দাবীতে রাস্তায় শ্লোগান দিচ্ছে তা দেখে। আমার মনে হয় এই প্রতিবাদ আমাদেরকে চপেটাঘাত করে জাগিয়ে দিতে পারে।
জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়ে গরীয়ান। প্রকৃতির নিয়মে সব মানুষই মাতৃহারা হয়, কিন্তু মানূষ কি জন্মভূমি হারা হয়? জন্মভূমি বহুবার বহু বাইরের শক্তি দ্বারা অধিকৃত হতে পারে । তখন তাকে ফিরে পেতে বহু রক্ত দিতে হয়। সে অভিজ্ঞতা জাতি হিসেবে আমাদের আছে। কিন্তু কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে নিজের ভাইকে দ্বারা যখন কেউ জন্মভূমি হারা হয়, সেই জন্মভূমি তো আর উদ্ধার করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই বিশ্বাসটা আমরা পেয়েছিলাম, এই বংগ ভূখন্ডের কেউ কখনো আর জন্মভূমি হারা হবে না। এই দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েই এদেশের মানুষ লড়াইটা করেছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে নামে অমানিশা । তখন রাস্তায় শ্লোগান দেওয়া কিশোরীরা আবার প্রমাণ করে এ প্রত্যয় হারিয়ে যাবার নয়। জীবন সায়াহ্নের জন্মদিনে এর চাইতে পাওনা আর কি হতে পারে?
নীরোর বাঁশি বাজানোর ইতিহাসটা পরে একদিন বলার ইচ্ছে রইলো। আজ কিশোরিদের উদ্যত হাত আর বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো তরুণেরা আমাদের ভবিষ্যত হোক।
#
অধ্যাপক ড. সুশান্ত দাশ
পলিটব্যুরোর সদস্য
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ