ও বন্ধু চল যাই রোদ্দুরে

প্রকাশিত: ৭:৫৬ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ৩, ২০২২

ও বন্ধু চল যাই রোদ্দুরে

Manual5 Ad Code

ফারহিম ভীনা | ঢাকা, ০৩ জানুয়ারি ২০২২ : নারায়নগঞ্জে বন্ধু রুমা আর টুটুলের বাড়িটা বেশি দূরে নয়- অথচ ওরা যখনই আমাদের ডাকে আমরা বলি, না-রা-য়-ণ-গ-ঞ্জ? সে তো অনেক দূর। রুমা আশা জোগায়, ওরে অত্ত দূর নয় রে, ঐ যে বিশ্বরোড, তিনশো ফিট দিয়ে সোজা যাবি, একদম কাঞ্চন ব্রীজ। তারপর ভুলতা ছাড়িয়ে মদনপুর। সেখান থেকে আরো যাবি তারপর মীরের টেক। তারপর যাবি, যাবি…. রুমার আর তারপর শেষ হয় না। আর আমাদেরও যাওয়া হয় না। ফেইসবুকে রুমার বাড়ির ছবিই শুধু দেখে যাচ্ছি। শুক্রবার বন্ধু রুনা ফোন দিল, ‘শোন শারমিন আপা আসছে তিমুর থেকে। রুমার বাসায় যাচ্ছি আমরা। যাবি? এবার আর কোন আপত্তি নয়’। প্রিয় শারমিন আপা আসছে- চল চল রুমার বাড়ি। এই শনিবার সাংবাদিকতা বিভাগের পাঁচজন হাজির হলাম সটান রুমার বাসায়।

রুমার বাড়ি বাংলো বাড়ি। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়- সামনে পেছনে বাগান- আর চারপাশে আদি ও অকৃত্রিম গ্রাম, সবুজ আর সবুজ। আমরা ঘুরে বেড়াই, উড়ে বেড়াই। দেখি ঘাসেরা বড় হচ্ছে- রুমার বাড়ির পেছনে গ্রামের কৃষকরা বুনে চলেছে গুচ্ছ গুচ্ছ ধান- জলাভূমিতে কাদামাখা শরীরের ছেলে মেয়েরা থপ থপ করে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আহ্ কোথায় ছিল এসব? রুটিন জীবনে ক্লান্ত আমরা। মনে হয় আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন । আনন্দ এমন জিনিষ-সঞ্চারিত হয়্। আমরা তখন মাটির বুকে হাঁটার সুখ পাচ্ছি- গাছদের খুশি দেখছি। এমন দীর্ঘ রাঙা দুপুর কতকাল দেখিনি। রোদের রঙ চোখের সামনে বদলে যেতে থাকে। আমরা দেখি প্রকৃতির সাতরঙ্গা-রুপ আকাশ, মাটি, বৃক্ষ, সব নতুন রঙে ও রুপে আমাদের সামনে। আমরা ঘুরে বেড়াই- কোথায় চলে যাই। আমাদের ভাল লাগে, সময় গড়ালে আরও ভাল লাগে। আমরা ঘুরে বেড়াই রোদ্দুরে। আমরা দৌড়ে বেড়াই- ‘রুমা, মুলা ফুল এত সুন্দর? ওমা সীমের দুরকম ফুল’? রুনার চোখে পড়ে অপূর্ব নীল মাছরাঙা পাখি। রুনা ক্যামেরায় ফোকাস করতে না করতে পাখি দেয় উড়াল। যাহ্ চলে গেল এক টুকরো সুন্দর।

Manual3 Ad Code

এখানে রুমার বাড়িতে আকাশ আশ্চর্য সুন্দর, আশ্চর্য তার সুর্য আর চারপাশে আশ্চর্য নীরবতা। এই রকম আশ্চর্য ছুটির দিন দুপুরে আমরা সব কল কল করতে থাকি।‘ওমা শারমিন আপা তোমার চুলেও সাদা রং ধরেছে’| আমাদের লাবণ্যময়ী আপা, ভার্সিটি জীবনের সুতী শাড়ির সাথে টিপ পরা বনলতা সেন হেসে খুন-‘বয়স হচ্ছে না’। আর রঞ্জনা আপা যিনি লেখা ও কথায় সবাইকে জমিয়ে রাখেন-মাতিয়ে রাখেন আজকে হলুদ কামিজে যেন উজ্জ্বল হলুদ গাঁদা ফুল। সৌন্দর্য বৃদ্ধির কথা বলতেই স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে বলে উঠল, ‘আর স্বাস্থ্যের সমৃদ্ধি দেখছিস না? অবশ্য ডায়েটে আছিরে’। রুনা আমাদের মেডিটেশন আপা, মহাজাতকের কঠিন চামচা। ওর তাৎক্ষণিক উত্তর, ‘ তা বটে, সকালে তিনশ ফিটের আলমের দোকানে নান, কলিজা আর নেহারী খাওয়া দেখলে বোঝা যায় মাসুম ভাই আর তুমি ডায়েটে আছ’। খুব হাসি হল। চারপাশে এমন আনন্দ ঝরে পড়ছে যেন এইবার গান করে উঠবে আকাশ।

Manual5 Ad Code

রুমার বাড়ির সামনে ফুলের বাগান ফুলকপি বাগান-চা খাওয়ার জন্য ছাতা ও চেয়ারের পরিপাটি আয়োজন।বাড়ির পেছনে মূলা, সীম, শাক এমনকি ফটোশুটিং এর জন্য একটুখানি শর্ষে বাগানও। আমরা ছবি তুলছি। বিস্ময়ের শেষ নেই এখানে। রুমার বাড়ির পেছনে আলাদা ছোট বাড়ি, বেড়াল বাড়ি। সব হুলো বেড়াল, তুলো বেড়াল আর ভুলো বেড়াল থাকে সেখানে। ওদের আলাদা খাট আছে, দোলনা আছে, ওদের নিজস্ব বারান্দায় ওরা রোদ পোহায়। রুমা ওর বেড়ালের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। জানিস তো মন্টু (মোটা বেড়াল) কত ভাল, আমার কথা সব বুঝতে পারে। ‘পড়ার টেবিল আছে ‌ওদের? আমার প্রশ্ন শুনে রুমা বলে, ‘যাহ্ ঠাট্টা করিস না – ওরা কি ভাল, কি বুঝদার। দ্যাখ আমাকে আম্মা বলে ডাকে। ঠিক সেসময় সেই মন্টু ডাকে, ‘ম্যাও’। রুমা উচ্ছ্বসিত হয়, দ্যাখ ‘মা’ বলে ডাকল। মন্টু আবার ডাকে ম্যাও- রুমা শোনে ‘মা’। রুমাদের কুকুর আদুরীর সাথেও মোলাকাত হল। ইস্কাটন থেকে আসার সময় বাড়ির সামনের কুকুরটি রুমাদের গাড়িতে চড়ে চলে এসেছে। ও আদুরী। আদুরীও ঘেউ ঘেউ করে হ্যালো বলল আমাদের

Manual8 Ad Code

রুমার বাড়ির রোদ্দুর এখন কমলা হচ্ছে। রুমা ওর চমৎকার ডাইনিং রুমে সবার খাবার বাড়ে। আবার আমরা কল কল করে উঠি। কি সুন্দর মেন্যু। রংধনু রঙের সালাদ-তাতে শীতের সব রং খেলা করছে। বাগানের সীম ভর্তা, বাগানের মুলা শাকের সবুজ ভাজি, লাল ঝাল ডিম ভুনা, নতুন আলুর কোর্মা, মুরগী ভুনা, রুই মাছের দোপেঁয়াজি সাথে ঘন ডাল। আমরা মজা করে খাই। রুমা বলে, ‘এই আরেকটু মাছ নে’ ভর্তাটা দেই! কিন্তু আমাদের সাথে মেহমানদারী চলবে না। রুমা তার অসুস্থ শরীরে কত কিছু আয়োজন করেছে। ওর সব আয়োজনে ভালবাসা ওম ছড়াচ্ছে। খাবার পর ফের আড্ডা- আয়েশি ঢং-এ রুমার ড্রইং রুমে আমরা বসি। মাসুম ভাই ভার্সিটি জীবনের কথা বলছে, সবাই উৎসাহী হয়ে শুনছি- আমাদের প্রথম তারুণ্যের স্বপ্রবাণ বন্ধুদের হাল হকিকত। আহা কি সব উজ্জ্বল দিন ছিল আমাদের। গল্পে আমরা সেই ছেলেবেলা খুঁজে নেই। আহা ছোটবেলায় বড় হবার কত স্বপ্ন ছিল আর এখন এই মধ্যবয়সে এক টুকরো ছোট বেলার গল্পের জন্য আমরা কতটা তৃঞ্চার্ত হই।

Manual5 Ad Code

সময় কি আমাদের সে কথা শোনে? সময় হেঁটে চলেছে ক্রমাগত, দাঁড়াবার সময নেই তার-যাযাবরের মত যেন পিঠাঝুলি নিয়ে সে এগিয়ে যায়। আমরা তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলছি-বলছি, ‘ Time you old gipsy man/ Will you not stay? Put up your caravan/ Just for one day’? সময় আমাদের অনুরোধ রাখেনা। আমরাও কেমন করে মেনে নেই এই নিদারুন সত্যি। রঞ্জনা আপা হাত নেড়ে বলছে, রুমা তোর এ বাড়িতে তো পালা করে সবাই আসছে। এটা দিয়ে বিজনেস শুরু কর-জম্পেশ করে বিজ্ঞাপন দে, আপনার বাচ্চাকে ধানক্ষেত- ফুলকপি ক্ষেত দেখাতে চান আসুন রুমার বাড়ি। প্রতি ফুলকপি তোলার জন্য বিশ টাকা। ছবি তুললে আরও বিশ টাকা। তোর ব্যবসা ঠেকায় কে? আমরা আবার হাসতে থাকি। শারমিন আপা পূর্ব তিমুরে ইউনিসেফের বড় কর্মকর্তা। উনি বলেন, ‘নাহ্ এ আসর মুলতবি করে চল পূর্ব তিমুরে আস- থাকা, খাওয়া, বেড়ানো সব ফ্রি। সমুদ্র আর পাহাড়ের গল্প শুনে আমি আর রুনা হিসাব করি প্লেনের টিকেটের দাম কত পড়বে। ছুটির কি হবে, বাচ্চাদের ছাড়া কি যাওয়া সম্ভব? কুমীরের পেট থেকে পূর্ব তিমুরের উৎপত্তি- এ রকম রুপকথার গল্প বলে যাচ্ছে শারমিন আপা-নাহ্ একসাথে কদিন না থাকলে আমাদের আড্ডা ফুরাবে না।

এর মধ্যে গ্রাম থেকে নিয়ে আসা হল এক ঝুড়ি ফুলকপি। আমি মনে মনে বলি, ফুলঝুড়ি। একটু একটু করে বিকেল হচ্ছে। চা চক্রে রয়েছে গ্রামের তৈরি কালো জাম, সবার আনা পাঁচপদ মিষ্টি আর রুমার বানানো ঘন দুধের পায়েস। নাহ আমরা সবাই ডায়েটে আছি। রক্তে সুগারও প্রায় জানান দিচ্ছে। তা হোক আজ রুমার বাড়িতে বন্ধুদিন। মাসুম ভাইয়ের অফিসে জরুরি মিটিং থাকায় রঞ্জনা আপা আর মাসুম ভাই বিদায় নেয়। একটা দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে, এমন একটা আশ্চর্য দিন, জাগে আনন্দ, জাগে বিস্ময়। এবার আমাদেরও ফেরা পালা। আমরা যখন ফিরছি তখন বাঁশবাগানে সন্ধ্যা নেমেছে-রাস্তাঘাট ছায়া ছায়া। আমরা ফিরে আসছি শহরে। গাড়ির জানালা দিয়ে তাকালে দেখা যায় শীত নেমেছে । কুয়াশা ঘন হয়ে নেমে আসছে। মনে হচ্ছে মেঘেরা সব নেমে আসছে আর রাস্তা-ঘাট, অহংকারী উচু বাড়ি, গম্ভীর বৃক্ষ সব মেঘ মুড়ি দিয়ে ডুব দিচ্ছে- ঘুমুতে যাবে বলে।
আমরা রুমার বাড়ির আশ্চর্য দিনের অনুভূতি নিয়ে ফিরে আসি ঢাকায়। ঢাকাও আমাদের প্রিয় শহর, ছোটবেলার শহর, কবিতার শহর। তবে মাঝে মাঝে প্রিয় শহর থেকে ছুটি নিয়ে একদিন যাওয়াই যায় বন্ধুবাড়ি।
#
ফারহিম ভীনা

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code