রাষ্ট্রধর্ম বিল বাতিল ও মৌলবাদী রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবীতে প্রথম প্রতিবাদী শহীদ ডাঃ জামিল আকতার রতন

প্রকাশিত: ১:০৮ অপরাহ্ণ, মে ২৯, ২০২০

রাষ্ট্রধর্ম বিল বাতিল ও মৌলবাদী রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবীতে প্রথম প্রতিবাদী শহীদ ডাঃ জামিল আকতার রতন

Manual6 Ad Code

হাফিজ সরকার, ২৯ মে ২০২০ : রাষ্ট্রধর্ম বিল বাতিল ও মৌলবাদী রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবীতে প্রথম প্রতিবাদী শহীদ ছাত্রনেতা ডাঃ জামিল আকতার রতন।

Manual8 Ad Code

১৯৮৮ সালের ৩১ শে মে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখার তৎকালীন সভাপতি জামিল আকতার রতনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। দল-মত নির্বিশেষে অনেকের কাছেই এ এক দুর্বিষহ স্মৃতির একটা দিন। ৩২ বছর আগে এইদিনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি ডা: জামিল আকতার রতনকে প্রকাশ্য দিনের আলোতে ৩৪/৩৫ জন শিক্ষকের সামনে কুপিয়ে হত্যা করে শিবিরের গুন্ডারা।

Manual3 Ad Code

এ দিনটিকে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীসহ অপরাপর ছাত্র সংগঠনসমূহ ‘মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দিবস’ হিসেবে পালন করে। জামাত-শিবিরসহ সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদ-জঙ্গিবাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি রাজশাহীতে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন।
জেনারেল হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রবর্তনের চেষ্টাকালে তার বিরুদ্ধে রাজশাহীতে তিনি দুর্বার ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর রক্তের উপর দাঁড়িয়েই এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করেন।
১৯৮৮ সালের ৩১ মে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে একাডেমিক কাউন্সিলের ৩৪ জন শিক্ষকের সামনেই ছাত্র শিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাকে গুলি করে ও কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। সেই থেকে এ দিনটিকে ছাত্র মৈত্রীসহ অপরাপর অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠনগুলো ‘মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।

Manual3 Ad Code

যা ঘটেছিলো
——————-
সাল ১৯৮৮, তারিখ ৩১ শে মে। দল-মত নির্বিশেষে অনেকের কাছেই এক দুর্বহ স্মৃতির একটা দিন। ৩২ বছর আগে এইদিনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি ডা: জামিল আকতার রতনকে প্রকাশ্য দিনের আলোতে ৩৪/৩৫ জন শিক্ষকের সামনে কুপিয়ে হত্যা করে শিবিরের গুন্ডারা।
জামিলের গত্যাকান্ড আর দশটা হত্যাকান্ডের মত নয়। আজকাল শিক্ষাংগনগুলোতে যে নিরন্তর ছাত্র সংঘর্ষ আর রক্তপাতের ঘটনা দেখি আমরা, জামিলের হত্যাকান্ড ঠিক সেগুলোর সাথে মিলানো যায়না। আজ বিশ্লেষন করলে বুঝা যায়, এই হত্যাকান্ডের পিছনে গভীর আর সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিলো, ছিলো কিছু ঘৃন্য ষড়যন্ত্র।
নব্বিয়ের দশকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হয়ে উঠেছিলো সে সময়ের প্রগতিশীলতার প্রতিক, ছোটখাট গড়নের এক দুর্দান্ত মেধাবী ছাত্রনেতা জামিল আকতার রতন ছিলেন মধ্যমনি। আজন্ম বিপ্লবী জামিলের চোখে মুখে ছিলো এক গভীর স্বপ্ন, শ্রেনীহীন, শোষনহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। তাকে ঘিরেই আবর্তিত হতো রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্রগতিশীল আন্দোলন আর চিন্তার চর্চা। হয়ত্ত সে কারনেই এই তিব্র আঘাতের টার্গেট করা হয় জামিল আকতার রতনকে।
৩০ মে রাত। ঘটনার সুত্রপাত হয় সে রাতেই। শিবির মিছিল করছে। এমন সময় অন্ধকারে কে বা কারা আওয়াজ তোলে ‘ধর ধর’। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে কোনো সংগঠন মিছিল করলে কেউ ‘ধর ধর’ এমন সংস্কৃতি কখনো ছিলোনা।
একটা মেডিকেল কলেজে সব মিলিয়ে কয়েকশো ছাত্র থাকে। রাজনৈতিক রেষারেষি হয়ত থাকে, কিন্তু সেটা খুন পর্যন্ত গড়ানো সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে একটু অস্বাভাবিক ছিলো।
সে সময়ে রাজশাহী মেডিকেলে শিবির সমর্থন করতো সব মিলিয়ে ৩০/৪০ জন ছাত্র। এই ‘ধর ধর’ শব্দের পরেই শিবিরের সেই মিছিলে এসে জুটলো শতাধিক লোক, সবার হাতেই অস্ত্র। সেই অস্ত্র নিয়ে তারা সারারাত চালালো মধ্যযুগীয় মহড়া।
সকাল হতেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মিছিল নিয়ে অধ্যক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিলো এবং অভিযোগ করলো, মেন হোস্টেলের কলাপসিবল গেট বন্ধ করে অস্ত্রসহ শিবিরের অনেক বহিরাগত অবস্থান করছে। ততক্ষনে একাডেমিক কাউন্সিল এই উত্তেজকর পরিস্থিতিতে করনীয়, তার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য শিক্ষকদের নিয়ে মিটিংয়ে বসে গেছেন। সেই মিটিং থেকেই অধ্যক্ষ্য সহ ৩৫ জন শিক্ষকের একটি দল মেইন হোস্টেলে যান। কয়েকজন ছাত্রের সংগে জামিল আকতার রতনও ছিলেন।
শিক্ষকরা যখন মেইন হোস্টেলে ঢুকতে যান, তখনই বাধা আসে অবস্থানরত শিবিরের ক্যাডারদের কাছ থেকে। এর মধ্যথেকে কয়েকজন বহিরাগত শিক্ষকদের সাথে উদ্ধতভাবে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। জামিল আকতার সেই বহিরাগতদের দেখিয়ে বলেন, “ঐ দেখুন স্যার বাইরের লোক”।
এর মধ্যেই হঠাত এক তীব্র হুইসেলের শব্দ আর ” নারায়ে তাকবির” বলে শিবিরের শতাধিক গুন্ডা শিক্ষকদের সামনেই কাপুরুষের মত নিরস্ত্র জামিল আকতার রতনকে ধাওয়া করে, কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।

এর পরের অংশ জানুন একাডেমিক কাউন্সিলের বিবৃতি থেকে:
বিবৃতি
———
জামিল আকতার রতনের হত্যাকান্ডের ব্যাপারে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কাউন্সিল এক বিবৃতি দিয়েছে, এতে বলা হয়, প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে ;- ” ৩১ শে মে বেলা আনুমানিক ১১টায় কলেজের সাধারন ছাত্র-ছাত্রী মিছিল সহকারে একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় এসে অভিযোগ করে, ইসলামি ছাত্র শিবিরের ছত্র-ছায়ায় একদল বহিরাগত অস্ত্রশস্ত্র সহ প্রধান ছাত্রবাসে পশ্চিম উত্তর ব্লকে অবস্থান করছে এবং কলেজে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তখন একামেডিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কাউন্সিলের সদস্য, ও অন্যান্য শিক্ষক অবস্থা দেখার জন্য ছাত্রাবাসে যান। ছাত্রাবাসে দুটি ব্লক দেখে পশ্চিম উত্তর ব্লকে যাবার সময় কিছু ছাত্র তাদের বাধা দেয়। এদেরকে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সদস্য ও সমর্থক বলে চিহ্নিত করা হয়।যারা বাধা দেয় তারা দাবী করে যে তাদের প্রত্যকের ৫ জন করে অতিথি আছে এবং কোন মতেই ঐ ব্লক পরিদর্শন করা যাবেনা।
এরপর সেদিকে যাবার সময় তারা বাঁশী বাজিয়ে, “নারায়ে তাকবির” শ্লোগান দিয়ে মারাত্বক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে এসে নিচে দন্ডায়মান সাধারন ছাত্রদের ধাওয়া করে। ঐ অবস্থায় জামিল আকতার রতন নামে ৫ম বর্ষের একজন ছাত্রকে মারাত্বকভাবে আহত করে। তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার পর সে মারা যায়। ছাত্রাবাস থেকে আসার সময় ঐ শিবিরের উশৃংখল হামলাকারীরা আবার বাধা দেয়। এ সময় গাড়ী ভাংচুর এবং বোমা নিক্ষেপ করা হয়।”
২রা জুন দৈনিক সংবাদে জামিল হত্যার প্রতিবাদে, বিভিন্ন বিভিন্ন কর্মসুচির শেষে প্রকাশিত হয় সেই বিবৃতি।

শহিদ জামিলকে শতকোটি শ্রদ্ধাঞ্জলী
———————————————–

আজ ৩১ মে’ ২০২০।।

সালটা ১৯৮৮, তারিখ ৩১ মে’ । ৩২ বছর পার হয়ে গেলো ।
জামিল আখতার রতন ভাইকে নিশ্চয়ই সবার মনে আছে । আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন । আমরা কেউ কি এক মুহূর্তের জন্যে ভুলতে পেড়েছি ? আমাদের সবার কাছেই এক দুর্বিষহ স্মৃতির একটা যন্ত্রণাদায়ক দিন । এখন শুধুই স্মৃতি ।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি জামিল আখতার রতন ভাই, তখন পঞ্চম বর্ষের ছাত্র । প্রকাশ্যে দিনের শদি
সেই সময়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হয়ে উঠেছিলো সে সময়ের প্রগতিশীলতার প্রতীক । আর তারই মধ্যমণি ছিলেন দুর্দান্ত , মেধাবী , একনিষ্ঠ , বন্ধুপরায়ণ জামিল আখতার রতন । আজন্মবিপ্লবী এক যুবকের মুখে ছিল এক গভীর স্বপ্ন, শ্রেণীহীন, শোষণহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। তাই তাঁকে ঘিরেই রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্রগতিশীল আন্দোলন আর সুস্থ ও সুষ্ঠ চিন্তার চর্চা । হয়তো সেকারণেই এই তীব্র আঘাতের টার্গেট করা হয় জামিল ভাইকে।
দলগতভাবে রাজশাহী মেডিকেল এ রেষারেষি থাকলেও কখনও খুন পর্যন্ত গড়ায় নাই । শিবির সমর্থক বেশী ছিল না । সব মিলিয়ে বড়জোর ৩০-৪০ জন ছাত্র । ৩০ মে, রাতে “ধর- ধর ” শব্দের পরেই শিবিরের সেই মিছিলে এসে জুটল শতাধিক লোক, সবার হাতেই অস্ত্র। সেই অস্ত্র নিয়ে তারা সারারাত চালালো মধ্যযুগীয় মহড়া ।

সকাল হতেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মিছিল নিয়ে অধ্যক্ষের কাছে স্মারক লিপি দিলো এবং অভিযোগ করলো, মেইন হোস্টেলের কলাপ্সিবল গেট বন্ধ করে অস্ত্রসহ শিবিরের অনেক বহিরাগত অবস্থান করছে। ততক্ষণে একাডেমিক কাউন্সিল এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে করণীয় কি, তার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য নিয়ে মিটিংয়ে বসে গেছেন। ছাত্রদের অভিযোগ শুনে একাডেমিক কাউন্সিল সরেজমিনে গিয়ে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই মিটিং থেকেই অধ্যক্ষ সহ প্রায় তিরিশ জন শিক্ষকের একটি দল মেইন হোস্টেলে যান। কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে জামিল ভাইও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষকরা যখন মেইন হোস্টেলে ঢুকতে যান, তখনই বাঁধা আসে সেখানে অবস্থানরত শিবিরের ক্যাডারদের কাছে থেকে। এর মধ্য থেকে কয়েকজন বহিরাগত শিক্ষকদের সাথে উদ্ধতভাবে তর্কে জড়িয়ে পড়ে।
এর মধ্যেই হঠাৎ এক তীব্র হুইসেলের শব্দ আর “নারায়ে তাকবীর” বলে শিবিরের শতাধিক অস্ত্রধারী গুণ্ডা শিক্ষকদের সামনেই কাপুরুষের মতো নিরস্ত্র জামিল ভাইকে ধাওয়া করে। এর পরে শিক্ষকদের সামনেই “নারায়ে তাকবীর” শ্লোগান দিয়ে নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর শিবিরের অস্ত্রধারীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিছু দূর দৌড়ে গিয়ে অস্ত্রের আঘাতে জামিল ভাই মাটিতে পড়ে যায়। আহত জামিলকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা নিশ্চিত করে দুর্বৃত্তরা। মৃত্যু নিশ্চিত করে যখন হত্যাকারীরা ফিরে যাচ্ছিলো, তখন মৃত্যু যন্ত্রণায় জামিল একটু নড়ে ওঠে। তখন কয়েকজন আবারো ফিরে এসে তাকে কোপায় । খুনিরা মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা তবে জায়গা ত্যাগ করে । জামিল ভাইয়ের রক্তাক্ত দেহ টা পড়ে থাকে মাটিতে ।
এই হত্যাকাণ্ড ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত। স্বৈরাচার বিরোধী অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনীতির সবচেয়ে তীক্ষ্ণ নেতৃত্বকে সরিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার রাজনীতি ।
আমাদের সবার সামনে দিবালোকে যেভাবে খুন হলেন , আমরা কিছুই করতে পারলাম না । এ ব্যর্থতা এখনও আমাদেরকে অপরাধী করে রেখেছে। ৩২ বছর পার হয়ে গেছে । আজও তার কোন বিচার হল না । আজও খুনিরা দাপটে ঘুরে বেড়ায় । এই লজ্জা আমাদের । জামিল ভাই কি আমাদের ক্ষমা করতে পারবেন ??
জামিল ভাইয়ের সেই আত্মদান আজকের প্রজন্মের কাছে অবশ্যই হতে পারে এক অবিস্মরণীয় প্রেরণা । আজকের নতুন প্রজন্ম অনেকেই জানে না সেদিনের ঘটনা । জামাত – শিবির আজ নতুন নয় , বহু আগে থেকেই ওরা যেখানেই দেখেছে ভাল কিছু , সেখানেই হায়েনাদের মত করাল থাবায় আঘাত হেনেছে , ধ্বংস করতে চেয়েছে সমাজকে , দেশকে ।
সবার কাছে অনুরোধ করবো জামিল ভাইয়ের জন্যে দোয়া করতে আল্লাহ্‌ তাকে অবশ্যই জান্নাতবাসী করবেন । তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি ।

রগকাটা থেকে গলাকাটা
=================
————————-হাফিজ সরকার

ছাত্রসংঘ থেকে ছাত্রশিবিরে রূপান্তরিত এই সংগঠন সব সময়ই বর্বর হত্যাকা- চালিয়ে আসছে
দেশে টার্গেট কিলিং বা গুপ্ত হত্যা বন্ধ করাই হচ্ছে এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের কিন্তু এই টার্গেট কিলিং বা গুপ্ত হত্যা চালাচ্ছে কারা? জামায়াত-শিবিরের রগ কাটার সহিংস সন্ত্রাসী রাজনীতি থেকে জন্ম নেয়া গলা কাটার রাজনীতিই এখন টার্গেট কিলিং বা গুপ্ত হত্যাকা- ঘটানো হচ্ছে, যা দিয়ে সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানানো হচ্ছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠন দমনে তারা শুরু করে রগ কাটার সহিংস সন্ত্রাসী রাজনীতি। জামায়াত-শিবির টার্গেট কিলিং নামের এই সহিংস সন্ত্রাসী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে জঙ্গী গোষ্ঠীকে। আর এ জন্য তারা সহায়তা পাচ্ছে জোটের রাজনীতির সহযোগী দল বিএনপি ও আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা ইসরায়েলের মোসাদ ও পাকিস্তানের আইএসআই। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দাখিল করা প্রতিবেদনে এই ধরনের তথ্যের কথা উল্লেখ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে জানা গেছে, ১৯৮১ সাল থেকে গত ৩৫ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারের জন্য অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো দমনে রগকাটার সহিংস সন্ত্রাসী রাজনীতি করে আসছে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবির। ২০১১ সাল থেকে গত ৫ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীর বিচারে বাধা ও রায় বানচাল করতে তারাই শুরু করে রগকাটা থেকে গলাকাটার সহিংস সন্ত্রাসী রাজনীতির সূচনা। মূলত যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ স্থাপিত হওয়ার পর ব্লগার প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে পল্লবী নিজ বাড়ির সামনে শিবিরের সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে শিবিরের গলাকাটার রাজনীতিতে যুক্ত করে জঙ্গী গোষ্ঠীকে। এই গুপ্ত হত্যার নির্দেশদাতা ছিল জামায়াতের এক নেতা, যার নাম রানা বলে পরিচিত। এই হত্যাকান্ডের অন্যতম নেতা ফারাবি যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের নেতা। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৩ বছর ধরে এখন কুপিয়ে হত্যার টার্গেট কিলিং বা গুপ্ত হত্যা অব্যাহত আছে।

রগকাটা শিবিরের গলাকাটা ইতিহাস॥
———————————————

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাক হানাদারদের যারা সহযোগিতা করত সেই জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংস্থার নাম ছিল ‘ইসলামী ছাত্র সংঘ’। ১৯৭৭ সালে পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তারা ইসলামী ছাত্রশিবির নামে আত্মপ্রকাশ করে। বর্বরোচিত সন্ত্রাসী কর্মকা- চালানোর জন্য সর্বস্তরে নিন্দিত জামায়াতে ইসলামীর এই ছাত্র সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায় জবাই করে হত্যার রাজনীতি শুরু করে চট্টগ্রাম থেকে। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে হামলা-সহিংসতা-সংঘর্ষ নতুন কিছু নয়। তবে এক্ষেত্রে অপরাপর ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে শিবিরের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। শিবির সরাসরি হত্যার মিশনে নামে। তাছাড়া এরা যাকে আঘাত করে তাকে চিরতরে পঙ্গু-অচল করে দেয়। এর মাধ্যমে তারা সংশ্লিষ্ট কর্মীটিকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার এবং অন্যদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তাদের সাবধান করে। এজন্য শিবিরের নৃশংসতার সাথে অন্য কারও তুলনা হয় না। হাতুড়ি, রড, ইট, মুগুর দিয়ে হাড় গুঁড়ো করে দেয়া, রিকশার স্পোক কানের ভেতর ঢুকিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মগজ বের করে আনা, হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয়া, চোখ উপড়ে ফেলা, মেরুদ- ভেঙ্গে ফেলা, কব্জি কেটে নেয়া, কিরিচ, ছোরা, কুড়াল ব্যবহার করে হত্যা করার মতো নৃশংসতা এদেশের ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে কেবল শিবিরের নামের সাথেই যুক্ত, যা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে ‘৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-সহ রাজাকার, আলবদর আল সামস গঠন করে নির্মম ও নৃশংস হত্যাকা-ের সূচনা করে। জামায়াতের সেই নির্মম ও নৃশংস হত্যাকা-ের রাজনীতিরই উত্তরাধিকার হিসাবে গ্রহণ করেছে তাদের ছাত্র সংগঠন শিবির।

পেছনে ফিরে তাকানো যাক শিবিরের বর্বরতার দিকে ॥
——————————————————————

সেই প্রায় ৩৯ বছর আগের কথা। ১৯৮১ সালের মার্চ মাস। প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মাথায় শিবির ক্যাডাররা চট্টগ্রাম সিটি কলেজের নির্বাচিত এজিএস ছাত্রলীগ নেতা তবারক হোসেনকে কলেজ ক্যাম্পাসেই কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। কিরিচের এলোপাতাড়ি কোপে মুমূর্ষু তবারক যখন পানি পানি করে কাতরাচ্ছিল তখন এক শিবিরকর্মী তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়। ১৯৮২ সালের মার্চ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ৩ বাস বহিরাগত সন্ত্রাসী নিয়ে এসে শিবির ক্যাডাররা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের উপর হামলা চালায়। এই সহিংস ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম কলেজের সোহরাওয়ার্দী হলের ১৫ নম্বর কক্ষে শিবিরেরকর্মীরা ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও মেধাবী ছাত্র শাহাদাত হোসেনকে জবাই করে হত্যা করে। ১৯৮৬ সালে শিবির ডান হাতের কবজি কেটে নেয় জাতীয় ছাত্রসমাজের নেতা আবদুল হামিদের। পরবর্তীতে ঐ কর্তিত হাত বর্ষার ফলায় গেঁথে তারা উল্লাস প্রকাশ করে। ১৯৮৮ সালে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ মেইন হোস্টেলের সামনে, কলেজের প্রিন্সিপাল ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যবৃন্দ ও শত শত শিক্ষাথীদের সামনে ছাত্রমৈত্রী নেতা ডাক্তার জামিল আক্তার রতনকে কুপিয়ে ও হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা করে শিবিরের ক্যাডাররা। ১৯৮৮ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জাসদ নেতা জালালকে তার নিজ বাড়ির সামনে কুপিয়ে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা। ১৯৮৮ সালে বহিরাগত শিবির ক্যাডারদের হামলায় আমির আলী হল ছাত্র সংসদের জিএস ও জাসদ ছাত্রলীগ নেতা প্রিন্সসহ ২০-২৫ জন আহত হয়। ১৯৮৮ সালে ভোর সাড়ে চারটার দিকে এস এম হলে বহিরাগত শিবির ক্যাডাররা হামলা চালায় এবং জাসদ ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সভাপতি ও সিনেট সদস্য আইয়ূব আলী খান, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সিনেট সদস্য আহসানুল কবির বাদল এবং হল সংসদের ভিপি নওশাদের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়। ১৯৮৮ সালে সিলেটে শিবির ক্যাডাররা মুনীর, জুয়েল ও তপনকে বর্বরভাবে হত্যা করে। আগস্ট, ১৯৮৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোঃ ইউনুসের বাসভবনে ছাত্র শিবির বোমা হামলা করে। এতে অধ্যাপক ইউনুস বেঁচে গেলেও তার বাড়ির কর্মচারী আহত হয়। রমজান মাস, ১৯৮৯ সালে ছাত্র ইউনিয়নের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফাকে বিশ্ববিদ্যালয় পার্শ¦বতী চকপাড়ায় ইফতারের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে গিয়ে হাতের রগ কেটে দেয় শিবির ক্যাডাররা। নবেম্বর, ১৯৮৯ সালে নজরুল ইসলাম মিলনায়তনের সামনে সন্ধ্যায় জাসদ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ওপর শিবিরের বোমা হামলায় বাবু, রফিকসহ ১০ জন আহত হয়। ২২ ডিসেম্বর, ১৯৯০ সালে ছাত্রমৈত্রীর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহসভাপতি ফারুকুজ্জামান ফারুককে শিবিরের ক্যাডাররা জবেহ করে হত্যা করে। ১৭ মার্চ, ১৯৯২ সালে পবিত্র রমজান মাসে চট্টগ্রামের কুখ্যাত সিরাজুস সালেহীন বাহিনীসহ কয়েক হাজার সশস্ত্র বহিরাগত শিবীর সন্ত্রাসী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বেলা ১১টার সময় অতর্কিত হামলা চালালে জাসদ ছাত্রলীগ নেতা ইয়াসীর আরাফাত পিটু নিহত হয় এবং জাসদ ছাত্রলীগের আইভি, নির্মল, লেমন, রুশো, জাফু, ফারুক এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের রাজেশসহ দেড়শাতাধিক ছাত্র-ছাত্রী আহত হয়। এদের অধিকাংশেরই হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়া হয় এবং রাজেশের কব্জি কেটে ফেলা হয়। এই হামলার সময় শিবির ক্যাডাররা এস এম হল, আনোয়ার হল এবং লতিফ হল আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। ব্যাপক আকারে গান পাউডারের ব্যবহার করায় হলের জানালার কাঁচগুলো গলে গিয়েছিল। লতিফ হলের অনেক কক্ষ এখনো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। এই হামলার তীব্রতা এতই ছিল যে, বেলা ১১টায় শুরু হওয়া হামলা রাত ৩টায় বিডিআর নামানোর আগ পর্যন্ত বন্ধ হয়নি। মে, ১৯৯২ সালে ইসলামী ছাত্রী সংস্থা রাজশাহী কলেজ শাখার নেত্রী মুনীরা বোমা বহন করার সময় বিস্ফোরণে মারা যায় এবং তার সহযাত্রী-সহকমী আপন খালা এবং ঐ রিক্সাওয়ালা আহত হয়। ১৯ জুন, ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে হরতাল কর্মসূচী সফল করার লক্ষ্যে জাসদের মিছিল চলাকালে শিবিরের সশস্ত্র হামলায় সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে জাসদ নেতা মুকিম মারাত্মক আহত হন এবং ২৪ জুন তিনি মারা যান। আগস্ট, ১৯৯২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পার্শ¦বর্তী নতুন বুথপাড়ায় শিবির ক্যাডার মোজাম্মেলের বাড়িতে বোমা বানানোর সময় শিবির ক্যাডার আজিবরসহ অজ্ঞাতনামা অন্তত আরও তিন জন নিহত হয়। বিস্ফোরণে পুরো ঘর মাটির সাথে মিশে যায় এবং টিনের চাল কয়েক শ’ গজ দূরে গাছের ডালে ঝুলতে দেখা যায়। পরবর্তীতে পুলিশ মহলার একটি ডোবা থেকে অনেক খ-িত হাত-পা উদ্ধার করে। যদিও শিবির আজিবর ছাড়া আর কারও মৃত্যুর কথা স্বীকার করেনি। পুলিশ বাদী হয়ে মতিহার থানায় শিবির ক্যাডার মোজাম্মেলকে প্রধান আসামি করে বিস্ফোরক ও হত্যা মামলা দায়ের করে। প্রায় ৫ বছর পলাতক থাকার পর মামলা ম্যানেজ করে মোজাম্মেল এলাকায় ফিরে আসে এবং জামাতের রাজনীতিতে পুনরায় সক্রিয় হয়। ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালালে ছাত্রদল ও সাবেক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মিলে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ওপর শিবিরের হামলায় ছাত্রদল নেতা বিশ্বজিৎ, সাধারণ ছাত্র নতুন এবং ছাত্র ইউনিয়নের তপনসহ ৫ জন ছাত্র নিহত হয়। ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এনামুল হকের ছেলে ও ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ মুছাকে শিবিরকমীরা নৃশংসভাবে হত্যা করে। ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৩ সালে বহিরাগত সশস্ত্র শিবির কর্মীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শেরেবাংলা হলে হামলা চালিয়ে ছাত্রমৈত্রী নেতা বিশ্ববিদ্যালয় টিমের মেধাবী ক্রিকেটার জুবায়েদ চৌধুরী রিমুকে হাত-পায়ের রগ কেটে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। ১৯৯৪ সালে পরীক্ষা দিতে আসার পথে তৃতীয় বিজ্ঞান ভবনের সামনের রাস্তায় ছাত্রমৈত্রী নেতা প্রদ্যুৎ রুদ্র চৈতীর হাতের কব্জি কেটে নেয় শিবির কর্মীরা। ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫ সালে শিবির কমীরা বিশ্ববিদ্যালয় পার্শ্ববতী চৌদ্দপাই নামক স্থানে রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী সকাল-সন্ধ্যা বাসে হামলা চালিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী নেতা দেবাশীষ ভট্টাচার্য রূপমকে বাসের মধ্যে যাত্রীদের সামনে কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যার আগে বর্বর শিবির ক্যাডাররা তার হাত ও পায়ের রগ কেটে নেয়। জুলাই, ১৯৯৫ সালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ওপর সশস্ত্র শিবির কর্মীরা হামলা করে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছাত্রনেতা ফরহাদের হাতের কব্জি কেটে নেয়। এ হামলায় প্রায় ২৫ জন ছাত্রদল নেতা-কর্মীর হাত-পায়ের রগ কেটে নেয় শিবির ক্যাডাররা। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট দখল করার জন্য শিবির ক্যাডাররা ছাত্র সংসদের ভিপি মোহাম্মদ জমির ও কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ফরিদউদ্দিন আহমদকে গুলি করার পর পায়ের রগ কেটে হত্যা করে। ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু পরিষদের রাবি শাখার সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল খালেকসহ প্রায় বিশ জন শিক্ষকের বাসায় বোমা হামলা ও অগ্নি সংযোগ করে ছাত্র শিবির। ১৯৯৭ সালে গভীর রাতে রাবি ক্যাম্পাসে বহিরাগত শিবির সন্ত্রাসীদের হামলায় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা আহত হয়। রাবি জিমনেসিয়াম পুলিশ ক্যাম্পেও বোমা হামলা করে শিবির। ১৯৯৮ সালে শিক্ষক সমিতির মিটিং থেকে ফেরার পথে রাবি শহীদ মিনারের সামনে অধ্যাপক মোঃ ইউনুসের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় ছাত্র শিবির। ছাত্র-কর্মচারীদের প্রতিরোধে অধ্যাপক ইউনুস প্রাণে বেঁচে গেলেও মারাত্মক আহত হন তিনি। ১৯৯৯ সালে রাবিতে অবস্থিত ’৭১ এর গণকবরে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য স্থাপিত ভিত্তি প্রস্তর রাতের আঁধারে ছাত্রশিবির ভাঙতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারী বাধা দেন। ফলে শিবির ক্যাডাররা ভিত্তিপ্রস্তর ভেঙ্গে ফেলে তাকে কুপিয়ে আহত করে। ২২ আগস্ট, ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী সঞ্জয় তলাপাত্রকে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা। ২০০০ সালে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে শিবির ক্যাডাররা মাইক্রোবাসের মধ্যে থাকা ৮ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে প্রকাশ্য দিবালোকে ব্রাশফায়ার করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ, ২০০১ সালে রাবি অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহাকে ছাত্রশিবির কর্মীরা হাত-পা বেঁধে জবাই করার চেষ্টা করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা টের পাওয়ার ফলে তাদের হস্তক্ষেপে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। ২০০২ সালে রাবি সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট নেতা সুশান্ত সিনহাকে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে দেয় শিবির কর্মীরা। ২০০৪ সালে অধ্যাপক মোঃ ইউনুসকে ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় কুপিয়ে হত্যা করে শিবির, যদিও এই হত্যা মামলায় জেএমবির দুইজন সদস্যকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। তারপরও এলাকাবাসী অনেকেরই মতামত হচ্ছে ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররাই তাকে হত্যা করেছে।
উল্লেখ্য, ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে দুই দফায় ছাত্রশিবির তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৪ সালে বরিশালের বাবুগঞ্জের আগরপুর ইউনিয়নের ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি শামীম আহমেদকে শিবির ক্যাডাররা হত্যা করে। ১০ ডিসেম্বর, ২০০৫ সালে সন্ধ্যায় জুবেরী ভবনের সামনে রাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এস এম চন্দনের ওপর হামলা চালিয়ে তার রগ কেটে নেয়ার চেষ্টা চালায় শিবির ক্যাডাররা। ২ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াতপন্থী শিক্ষক মহিউদ্দিন এবং রাবি ছাত্রশিবির সভাপতি মাহবুব আলম সালেহীনসহ আরও দুইজন শিবির ক্যাডার মিলে একযোগে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে রাবির ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবু তাহেরকে হত্যা করে। ২১ আগস্ট, ২০০৬ সালে রাবিতে অনুষ্ঠিত ‘সেকুলারিজম ও শিক্ষা’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য দেয়ার অপরাধে অধ্যাপক হাসান আজিজুল হককে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে শিবির। প্রকাশ্য সমাবেশে তারা অধ্যাপক হাসান আজিজুল হকের গলা কেটে বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেয়ার ঘোষণা দেয়। ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেনকে হত্যা করে ম্যানহোলের মধ্যে ফেলে রাখে শিবিরের ক্যাডাররা।
জামায়াতের সহযোগী সংগঠন শিবিরের নির্মম ও নৃশংসতার যে ইতিহাস রয়েছে তার বর্ণনা করলে উপন্যাসও হার মেনে যাবে, যা গোয়েন্দা সংস্থার রেকর্ডে রয়েছে।

পুলিশের কলিজায় হাত ॥
——————————-

পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা বলেছেন, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপারের স্ত্রী মাহমুদা আকতার মিতুকে কুপিয়ে ও গুলি করে খুন করার ঘটনায় শিবির এবার পুলিশের কলিজায় হাত দিয়েছে। চট্টগ্রামের এই পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীর হত্যাকান্ডের জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে শিবিরের সাবেক স্থানীয় নেতা আবু নসুর গুন্নু। সেই সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছে রবিনও। জঙ্গী গোষ্ঠীর সহায়তায় শিবিরই যে এই নির্মম হত্যাকা- ঘটিয়েছে সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। শুধু পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী খুনই নয়, গত কয়েক দিনে পাবনার হেমায়েতপুরে শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র আশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পা-ে (৬২), নাটোরে মুদি দোকানি সুনীল গোমেজ। এর আগে খুন হন ঝিনাইদহে পুরোহিত আনন্দ গোপালসহ যে কয়েকজনকে খুন করা হয়েছে তার সঙ্গে শিবিরের সম্পৃক্ততার বিষয়টিই গুরুত্ব দিচ্ছে তদন্তকারীরা।

টার্গেট কিলিংয়ের নামে গলাকাটা ॥
——————————————-

Manual2 Ad Code

জঙ্গী গোষ্ঠীর নামের আড়ালে এখন রগ কাটা থেকে গলা কাটায় নেমেছে জামায়াত-শিবির। প্রায় ৩৯ বছর ধরে জামায়াত-শিবিরের রগ কাটার ইতিহাস। প্রায় ৫ বছর ধরে তারা রগ কাটা থেকে গলা কাটার ইতিহাসে পদার্পণ করেছে। গলা কাটার সঙ্গে তাদের প্রযুক্তিতে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। বাহন হিসেবে তারা ব্যবহার করছে মোটরসাইকেল। গলা কাটার পর ফেসবুক ও টুইটারে জামায়াত-শিবিরের নাম আড়াল করে আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠী আইএস বা আল কায়েদার নাম ব্যবহার করছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী মহলের সহায়তায় রগ কাটা থেকে গলা কাটায় উত্তরণ ঘটিয়েছে জামায়াতÑশিবির। এখন দেশব্যাপী প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, শিক্ষক, বিদেশী নাগরিক, মানবাধিকার কর্মী, ধর্মযাজক, ভিন্নমতাবলম্বীদের গলা কেটে জামায়াত-শিবির হত্যাকা- ঘটাচ্ছে জামায়াত-শিবির।

সরকারের পতন ঘটানোই লক্ষ্য ॥
—————————————-

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারের পতন ঘটাতে গত ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপি-জামায়াত জোটের ঢাকা অবরোধ-হরতালের নামে পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়িয়ে মারার সহিংস সন্ত্রাসে নিহত হয়েছে দেড় শতাধিক। এর মধ্যে পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়িয়ে মারা গেছে ৬৪ জন। বন্দুকযুদ্ধ ও গণপিটুনিতে মারা গেছে ৩৭ জন। সংঘর্ষ, গুলিবিদ্ধ লাশ ও সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ১৮ জন। যানবাহনে আগুন ও ভাংচুর হয়েছে ১ হাজার ১শ’ ২১টি। নিহতের মধ্যে বেশিরভাগই দিনমজুর, পথচারী, প্রবাসী, শিশু ও নারী। তবে গত ১৫ দিন ধরে পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়িয়ে মারার সহিংস সন্ত্রাস বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিএনপি-জামায়াত জোটে সহিংস সন্ত্রাস চালিয়েও অবরোধ-হরতাল অনির্দিষ্টকাল চালিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই বিএনপি-জামায়াত জোটই এখন আবার নতুন কৌশলে সংখ্যালঘু হিন্দু, খ্রীস্টান ও ভিন্নমতাবলম্বীদের কুপিয়ে হত্যাকা- ঘটাচ্ছে। সরকারের পতন ঘটাতে ব্যর্থ হয়ে এখন তারাই দেশে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য টার্গেট কিলিং বা গুপ্ত হত্যার পথ বেছে নিয়েছে।

যুদ্ধাপরাধের সহিংসতা থেকেই টার্গেট কিলিং ॥
———————————————————-
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বন্ধে ও রায় বানচালে সহিংস সন্ত্রাসের পর এখন টার্গেট কিলিংয়ের পথ বেছে নেয়া হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিবাদে তো বটেই, এমনকি আদালতের রায়ের আদেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল, হরতাল, সহিংস সন্ত্রাস করা অব্যাহত রেখেছে যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠীর দল জামায়াতÑশিবির। দেশের প্রচলিত আইন, আদালত, থানা, পুলিশ, কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করেনি তারা। যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও রায় ঘোষণার পর থেকে যুদ্ধাপরাধীর মামলায় আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের সহিংস সন্ত্রাসে সারাদেশে ১৫ পুলিশ, ২ বিজিবিসহ ৭১ জন খুন হয়েছে। আহত হয়েছে সহস্রাধিক। পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা, পুলিশের অস্ত্র লুট, পুলিশের গাড়ি, বাড়ি, বিদ্যুত কেন্দ্রে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করেছে জামায়াতÑশিবির। এ ঘটনায় সারাদেশের থানাগুলোতে দায়েরকৃত মামলায় আসামি করা হয়েছে হাজার হাজার জনকে। কিন্তু এতদিন আসামিরা গ্রেফতার হয়নি। এখন সারাদেশে যে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে তাতে আগের মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেফতারে প্রাধান্য ও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

টার্গেট কিলিংয়ের সহায়তায় ॥
————————————-
একই কায়দায় ২০১৩ সাল থেকে গত ৩ বছরে সারাদেশে ৪৯টি জঙ্গী গোষ্ঠীর হামলায় প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, শিক্ষক, পুরোহিত, মুয়াজ্জিন, ধর্মযাজক, বিদেশী, মানবাধিকার কর্মী, সেবক, দর্জি, মুদি দোকানি, পুলিশ ও পুলিশ পরিবারের সদস্য, হিন্দু, খ্রীস্টান, ভিন্নধর্মাবলম্বী ও মতাবলম্বীসহ ৫২ জনকে গুপ্তহত্যা করেছে খুনী চক্র, যাদের পরিচয় বলা হচ্ছে জঙ্গী গোষ্ঠী। তারাই যুদ্ধাপরাধীর বিচার, বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই বিএনপি-জামায়াত রাজনীতির নামে যে সহিংস সন্ত্রাসে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটিয়েছে তাতে নেপথ্য থেকে মদদ দিয়েছে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এর মধ্যে জঙ্গী অর্থায়নে সহায়তা করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ইতোমধ্যেই ঢাকার পাকিস্তান দূতাবাসের দুই কূটনৈতিককে বহিষ্কার ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও রায় কার্যকর নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতির ঘটনাই তার প্রমাণ। এছাড়াও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকার কথা স্বীকার করেছেন। জঙ্গী সংগঠন জেএমবি ও এবিটিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের ভেতর থেকে কেউ কেউ মদদ দিচ্ছে, যা জেএমবি ও এবিটির মাধ্যমে জঙ্গী তৎপরতা চালিয়ে পুনরায় দেশব্যাপী উগ্রপন্থী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে গুপ্তহত্যা বা টার্গেট কিলিং করানো হচ্ছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

টার্গেট কিলিং বন্ধই চ্যালেঞ্জ ॥
————————————-
গোয়েন্দা সংস্থার একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, এই সময়ে দেশের সাধারণ বা গতানুগতিক যেসব অপরাধ সংঘটিত হয় সেই ধরনের অপরাধ কমে গেছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও মোটামুটি ভাল। দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযানে আরও অপরাধ কমে যাবে এবং মানুষজনের জানমাল রক্ষা করা সহজ হবে। শুধু সরকার বা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টায় একের পর এক টার্গেট কিলিং বা গুপ্তহত্যাকা- ঘটানো হচ্ছে সেটার নিয়ন্ত্রণ করাই এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, এটা একটু সময় নিলেও সম্ভব। যেভাবে পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়িয়ে মারার সহিংস সন্ত্রাস দমন করা হয়েছে, ঠিক একই কায়দায় টার্গেট কিলিং বা গুপ্তহত্যা বন্ধে কার্যকর পরিকল্পনা নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে, যার দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যাবে।

তথ্যসুত্রঃ
১) গোয়েন্দা প্রতিবেদন-দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।
২) শংকর কুমার দের গবেষণা প্রতিবেদন।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code