ডেথ শুড বি লাইক এ মাউন্টেইন

প্রকাশিত: ১২:০০ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৯, ২০২৪

ডেথ শুড বি লাইক এ মাউন্টেইন

Manual3 Ad Code

লুবনা মরিয়ম |

আপনার শৈশবের স্মৃতি–

আমি খুবই লাজুক প্রকৃতির ছিলাম। কারও সঙ্গে মেলামেশা করতে চাইতাম না, খেলাধুলা করতাম না। আমার চিন্তিত মা একদিন আমাকে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে (বাফা) নিয়ে গিয়ে নাচের ক্লাসে ভর্তি করে দিলেন। আমি তো একটা নাচের স্কুল চালাই; ক্লাসে যে বাচ্চাটা মন খারাপ করে একদম শেষে দাঁড়িয়ে থাকে– আমি ছিলাম সেই বাচ্চাটা। কিন্তু ধীরে ধীরে নাচের মঞ্চ ভালোবেসে ফেলি। প্রথম মঞ্চ থেকে নামার পর বাবাকে বলেছিলাম, বাবা, একটা সিক্রেট– মাকে বোলো না। মঞ্চে উঠলে কাউকে দেখা যায় না।

শৈশব–কৈশোরের বন্ধু যারা–

একমাত্র বন্ধু– বই। মানুষ বন্ধু ছিল খুব কম।

যে ব্যক্তিগত ঘটনা বা পরিবেশের প্রভাব আপনাকে নৃত্যশিল্পী করে তুলেছে–

১৯৬৩-৬৪ সালে বোধ হয় ছয় মাসের জন্য একজন বিদেশি চিত্রশিল্পী বাফায় এসেছিলেন। পোল্যান্ডে তাঁর বাড়ি। বাফার সমস্ত বাচ্চাকে তিনি ছবি আঁকার ক্লাসে নিয়ে এসেছিলেন। কাগজ, রং, মাটি সমস্ত কিছু দিয়ে বলতেন– যা খুশি করো। তিনি লক্ষ্য করলেন, নাচের ক্লাসের আমি নাচের চেয়ে ছবির ক্লাসেই বেশি আসি। একদিন জিজ্ঞেস করলেন– নাচের ক্লাস কেন করো না? আমি বললাম, আমি নাচ পারি না। তিনি তখন একটা কথা বললেন যেটা আমি কোনোদিন ভুলিনি। বললেন, কেউ কিছু পেরে জন্মায় না। ১ শতাংশ প্রতিভা আর ৯৯ শতাংশ কঠোর পরিশ্রম– এই নিয়ে আর্ট। আমি পরিশ্রম করতে শুরু করি। ওনার এ কথাটিই পরবর্তী সময়ে আমাকে নৃত্যশিল্পী করে তোলে। পরবর্তী জীবনে সেই পোলিশ শিল্পীকে আমি আর কোথাও খুঁজে পাইনি।

প্রথম নৃত্য পরিবেশনের স্মৃতি–

বাফার একজন শিক্ষক ছিলেন অজিত সাহা। তিনি বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে নাচতেন। আমাদের মতো ছোট বাচ্চাদের নিয়ে একটা নৃত্যনাট্য লিখেছিলেন, নাম প্রকৃতির লীলা। মঞ্চে একটু পর হরিণ ঢুকছে, ময়ূর ঢুকছে– ভারি চমৎকার। আমি তো নাচতে পারতাম না, তাই আমাকে একটা ফুল বানিয়ে মঞ্চের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। আমি শুধু ফুল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সবাই আমাকে ঘিরে নাচল। সবার সে কী ঈর্ষা!

প্রিয় নৃত্যশিল্পী–

আমার মনে হয়, একটা ছেলের ভালো নাচের মতো সুন্দর আর কিছু হতে পারে না। আমার ভীষণ প্রিয় একজন নৃত্যশিল্পী মিখাইল ব্যারিশনিকভ (জন্ম ২৭ জানুয়ারি ১৯৪৮)। কানাডার টরন্টোতে তাঁর দল হোয়াইট ওক-এর নৃত্য পরিবেশনা দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। অবিস্মরণীয় তাঁর নৃত্যশৈলী। আরেকজন প্রিয়– আকরাম খান। তিনিও ভীষণ গুণী নৃত্যশিল্পী। যেখানে তাঁর পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়, আমি যেতে চেষ্টা করি। সাংহাইয়ের এক নৃত্যানুষ্ঠানে মুগ্ধ দর্শক তাঁকে চল্লিশ মিনিট স্ট্যান্ডিং ওভেশন (দাঁড়িয়ে করতালি নিয়ে সম্মান) দিয়েছে।

Manual1 Ad Code

যে বইগুলো বারবার পড়েছেন–

বই পড়া আমার প্রাণের অনুষঙ্গ। প্রচুর বই বারংবার পড়েছি। বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথের কথা বলব। রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীল সাহিত্যের চেয়ে কিন্তু মননশীল সাহিত্য আমার বেশি ভালো লাগে।

Manual2 Ad Code

এখন কী পড়ছেন?

বর্তমানে আমি পড়ছি Hevajra Tantra [বৌদ্ধ ধর্মতন্ত্রের বজ্রযান শাখার একটি গ্রন্থ]। বইটিকে বাংলার সহজিয়া দর্শনের একটি আকরগ্রন্থ বলা যেতে পারে। বইটির ইংরেজি অনুবাদ আছে, হিন্দি অনুবাদ আছে। কিন্তু যে অঞ্চলের জন্য বইটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বাংলা অঞ্চল, সেই অঞ্চলের ভাষায় এটির কোনো অনুবাদ আমি পাইনি। প্রতিদিন একটু একটু করে অনুবাদের চেষ্টা করছি।
নিজের যে অক্ষমতার জন্য নিজের ওপর রাগ হয়–
আমি খুব সহজে মানুষের সাথে মিশতে পারি না।

Manual4 Ad Code

আপনার চরিত্রের শক্তিশালী দিক–

অদম্যতা। যে কোনো বাধাকে উতরে জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি আমার আছে। আমার সহ্যক্ষমতা প্রচণ্ড।

সবচেয়ে বেশি পাওয়া প্রশংসা ও অভিযোগ–

মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রবণতা আছে আমার, তাঁরা বলেন। সবার কাছ থেকে দূরে থাকার প্রবণতা আছে আমার– তাঁদের অভিযোগ।

মানুষের যে গুণ আপনাকে আকৃষ্ট করে–

আমাদের সনাতনী শাস্ত্র বলে পুরুষতত্ত্ব ও নারীতত্ত্ব মিলে পূর্ণাঙ্গতা। পুরুষতত্ত্ব হলো মুক্ত ইচ্ছা। নারীতত্ত্ব হলো জ্ঞান। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ বলেন, মুক্ত ইচ্ছা ভালো পরিবেশ দিতে পারে না। তাঁর মতে পুরুষতত্ত্ব হলো করুণা। জ্ঞানের সঙ্গে করুণা মিলে আসে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান। মানুষের মাঝে করুণার বোধ দেখতে পেলে সবচেয়ে আকৃষ্ট হই।

এপিটাফে যা লেখা থাকতে পারে-

Manual7 Ad Code

আমার বাবা বামপন্থি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মাও সেতুং এর রেডবুক বাসায় থাকত। বাবার কাছ থেকে শোনা মাও সেতুংয়ের উক্তির একটা অংশ আমি চিরকাল আমার ছেলেমেয়েদের বলে এসেছি- ডেথ শুড বি লাইক এ মাউন্টেইন। মৃত্যুকে হতে হবে পর্বতসম।

লেখক পরিচিতি :

লুবনা মরিয়ম (৮ জুলাই ১৯৫৪) বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পীদের অন্যতম। একইসঙ্গে তিনি একজন শিল্প পরিচালক ও নৃত্য গবেষক। দক্ষিণ এশিয়াভিত্তিক শিল্প-সংগঠন ‘সাধনা’র সাধারণ সম্পাদক তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী ক্যাম্প ও ‘মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নৃত্যশিল্পে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০১৯ সালে শিল্পকলা পদক প্রদান করে।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code